DMCA.com Protection Status
title=""

ড.তুহিন মালিকের কলামঃ সমগ্র বাংলাদেশ এক রুপি

tuhin1ড.তুহিন মালিকঃ এক. গত ৪ নভেম্বর দৈনিক প্রথম আলো আখাউড়া সীমান্ত পারাপারের সময় ভারতীয় পণ্যবাহী একটি ট্রাকের ছবি প্রকাশ করে। ছবিটির শিরোনাম ছিল ‘এক রুপিতে ট্রানজিট’।

নিউজে বলা হয়, ‘পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে একটি পণ্যবাহী ট্রাক সড়কপথে ঢাকা হয়ে ত্রিপুরার আগরতলা গেল। … মাশুল সম্পর্কে জানতে চাইলে আখাউড়া শুল্ক বিভাগের সহকারী কমিশনার মিহির কিরণ চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, দুই দেশের সরকারের পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে চালানে এক রুপি মাশুল নেয়া হয়। যেহেতু পণ্যগুলো বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করেনি, তাই কোনো শুল্ক নেওয়া হয়নি।’

খবরটি নতুন হলেও এ রকম ঘটনা অবশ্য নতুন কিছু নয়। কারণ গত চার বছরে ভারতকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বেশ কয়েকবার বিনাশুল্কে পণ্য পরিবহনের সুযোগ করে দিয়েছি আমরা। ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভারী যন্ত্রাংশ থেকে শুরু করে চালের একাধিক চালান ত্রিপুরায় পৌঁছাতে বাংলাদেশের ভেতর দিয়েই ভারতীয় ট্রাকগুলো হরহর করে চলেছে এতদিন।

কখনো ভারতকে ‘মানবিক কারণ’ দেখিয়ে, কখনোবা ‘প্রতীকী মাশুল’ ধরে এই সুবিধাগুলো দেয়া হয়েছে; কিন্তু কলকাতা থেকে এক হাজার ৫৫৯ কিলোমিটার দূরত্বের আগরতলায় এতদিন যে পণ্য পরিবহনে সময় লাগত আট দিন, আমাদের ‘মানবিক কারণে’ এই দূরত্ব এখন প্রায় এক হাজার কিলোমিটার কমে মাত্র ৫১ ঘণ্টায় পৌঁছে যাচ্ছে আগরতলায়। বিনিময়ে আমাদের ভাগ্যে জুটল মাত্র এক রুপি! অথচ আমরা চাতক পাখির মতো ভারতের কাছ থেকে ‘মানবিক কারণে’ একফোঁটা তিস্তার ন্যায্য পানি পাই না !

আমাদের সরকার টাকার অন্বেষণে শিক্ষার ওপর ভ্যাট বসালেও ভারতের কাছ থেকে ন্যায্য পাওনা আদায়ে ‘মানবিক’ হয়ে যায়। অথচ ক’দিন আগেও আমাদের মন্ত্রীরা বলে বেড়াতেন, ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশের আয় বাড়বে। এ দেশ হবে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া। আর বাস্তবে এখন হাজার হাজার কোটি টাকা আয় তো দূরের কথা, বিনাশুল্কে আর এক রুপিতে ট্রানজিট দিলাম আমরা। এ যেন ভারতীয় ট্রাকে এখন বাংলা হরফে লেখা ‘সমগ্র বাংলাদেশ এক রুপি’।

দুই. ক’দিন আগে দিল্লিতে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে এসওপি সই হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে নৌপরিবহন প্রটোকলের আওতায় প্রতি মেট্রিক টনের ট্রানজিট মাশুল বাবদ ১৩০ টাকা দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। অথচ ২০১০ সালে এনবিআর থেকে ট্রানজিটের মাশুল বাবদ বিশ ফুট কনটেইনারের জন্য ১০ হাজার টাকা এবং ট্রাকে টনপ্রতি এক হাজার টাকা ফি নির্ধারণের প্রস্তাব দেয়া হয়।

এর প্রেক্ষাপটে এনবিআর থেকে তখন একটি এসআরও জারি পর্যন্ত করা হয়েছিল; কিন্তু সরকারি উচ্চমহলের ধমকে এই এসআরও তখন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় আমাদের এনবিআর। এরপর ২০১২ সালে এনবিআর থেকে এই মাশুল অর্ধেকের মতো কমিয়ে এনে টনপ্রতি ৫৮০ টাকার প্রস্তাব দেয়া হয়। এর মধ্যে স্ক্যানিংয়ের জন্য ৩০০ টাকা, ট্রানশিপমেন্ট বাবদ ২০ টাকা ও নথি প্রক্রিয়াকরণ বাবদ ১০ টাকাসহ আটটি খাতে এ টাকা ধরা হয়। এ ছাড়া পণ্যের বিপরীতে ব্যাংক গ্যারান্টি দেয়ার কথাও তখন বলা হয়; কিন্তু এখন স্ক্যানিংয়ের জন্য কোনো ফি বরাদ্দ রাখা হয়নি। এর অর্থ স্ক্যানিং না করেই কি আমরা তাদের পণ্য আসা-যাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছি?

আশ্চর্য, কার স্বার্থে কাদের পরামর্শে ৫৮০ টাকা প্রস্তাবের পরিবর্তে এখন প্রায় ৭৮ শতাংশ কমে ভারতকে ট্রানজিট দিতে যাচ্ছি আমরা। তা হলে প্রতি কেজিতে মাত্র ১৩ পয়সায় ট্রানজিট! বাংলাদেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় রাস্তা নির্মাণ করে আর কোটি কোটি টাকা রক্ষণাবেক্ষণের খরচ জুগিয়ে ভারতকে নামমাত্র মূল্যে ভারী ভারী ট্রাক চলাচলের সুযোগ করে দিচ্ছি। আর মাশুল পাচ্ছি মাত্র এক রুপি!

ভারত কি আমাদের নষ্ট রাস্তাগুলো নিজেদের টাকায় ঠিক করে দেবে? অথচ ভারত থেকে বাংলাদেশী কোনো ব্যবসায়ী যদি সড়কপথে পণ্য আমদানি করে তবে ভারতকে সড়ক কর বাবদ পণ্যমূল্যের ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত মাশুল দিতে হয়। তা ছাড়া সেলস ট্যাক্স তো সাথে আছেই। বন্ধুত্বের সুবাদে প্রশ্ন জাগতেই পারে, বাংলাদেশের পণ্যও কি নেপালে কিংবা ভুটানে যেতে কেজিপ্রতি এই ১৩ পয়সাই নেয়া হবে?

ভারতের সাথে চুক্তি করার আগে নেপাল-ভুটানে আমাদের পণ্য পরিবহনের জন্যও একই রকমের ফি নির্ধারণ করাটা কি সঙ্গত ছিল না। তা ছাড়া নৌপথের জন্য ভারত কত টাকা বিনিয়োগ করবে সেটাও চুক্তিতে উল্লেখ থাকাটা কি প্রয়োজন ছিল না। দুই দেশের সরকার বলছে, আন্তঃরাষ্ট্রীয় যোগাযোগব্যবস্থা উন্নয়নের কথা। অথচ আমরা তো শুধু দেখছি, এই যোগাযোগ বলতে শুধুই ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে পূর্বের সাত রাজ্যের সহজতম যোগাযোগের উন্নয়ন। তা হলে আমাদেরটা কোথায় গেল?

তিন. আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়াকে গভীর রাতে কালো কাচের আঁধারে জিপে করে কাশিমপুর কারাগার থেকে ভারতীয় হাইকমিশনের হাতে তুলে দেয় বাংলাদেশ সরকার। সাথে তার দুই সহযোগী লক্ষ্মী প্রসাদ গোস্বামী ও বাবুল শর্মাকেও হস্তান্তর করা হয়। এর আগে ২০০৯ সালে উলফার চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজাখোয়াসহ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকেও ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়।

যদিও আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথমে এ বিষয়টিকে স্বীকারই করতে চাননি। তবে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনুপ চেটিয়াকে ভারতের কাছে হস্তান্তরের বিষয়টি নিশ্চিত করলে আমাদের সরকার আর এটা অস্বীকার করতে পারেনি।

আমাদের নূর হোসেনকে ফেরত দিতে ভারতীয় আদালতের নির্দেশ প্রয়োজন হলেও অনুপ চেটিয়াকে ফেরত পাঠাতে আমাদের আদালতের নির্দেশের প্রয়োজন পড়েনি কেন? আমাদের সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ সব স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীকে সমর্থন দিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেও অনুপ চেটিয়ার বিষয়ে সংবিধানের এই বাণী নীরব থেকেছে কেন?

ভারতের চোখে হয়তো অনুপ চেটিয়া একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী; কিন্তু বিশ্বের কাছে অনুপ চেটিয়া স্বাধীনতাকামী একজন নেতা। অথচ আমরা নূর হোসেনের মতো একজন খুনি সন্ত্রাসীর বিনিময়ে এ রকম একজন স্বাধীনতাকামী নেতাকে ভারতের হাতে তুলে দিলাম ! কাতল দিয়ে পুঁটি পেলাম! সরকার হয়তো ভুলেই গেছে, আমরাও একদিন স্বাধীনতাকামী ছিলাম। অথচ এই আসামের মানুষেরাই ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিফৌজকে সর্বাত্মক সহযোগিতা ও আশ্রয় দিয়েছিল। চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা সন্তু লারমাকে কি ভারত সরকার বাংলাদেশের হাতে কখনো তুলে দিয়েছিল? ১৯৭১ সালে ভারত কি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নেতাদের পাকিস্তানের হাতে তুলে দিয়েছিল ? ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্য যদি স্বাধীন হতো তবে ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণই হতেন স্বাধীন তামিল রাষ্ট্রের প্রধান; কিন্তু তিনি আজ কেবলই একজন মৃত সন্ত্রাসী।

আমরা কখনোই চাই না আমাদের মাটি ব্যবহার করে কেউ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটাক। ভারতের শান্তি ও নিরাপত্তায় কোনো রকমের হুমকি আমাদের মাটিতে করতে দেয়া যাবে না। তা ছাড়া ভারতের মতো একটি বন্ধু প্রতিবেশী আমাদের শত্র“ হতে যাবে কেন?

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান কখনোই ভোলার মতো নয়; কিন্তু তাই বলে আমাদের জাতীয় স্বার্থে ও আমাদের ন্যায্য দাবি আদায়ে আমরা কারো কাছে তো দাসখত লিখে দিতে পারি না।

চার. বাংলাদেশের কাছ থেকে প্রত্যাশার পুরোটাই পেয়েছে ভারতীয়রা। বাংলাদেশের নিজ ভূখণ্ডের ভেতর জঙ্গি ও বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে শক্তহাতে নির্মূল করেছি আমরা।

তাদের মোস্ট ওয়ান্টেড উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছি। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহনের সব দুয়ার খুলে দিয়েছি। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে আগরতলা-কলকাতা বাস সার্ভিস চালু করেছি আমরা। শিলং-গুয়াহাটি বাস সার্ভিসও চালু করে দিয়েছি ভারতের স্বার্থেই। খুলনা-মংলা-কুলাউড়া-শাহবাজপুর থেকে রেল সার্ভিসও দিচ্ছি তাদের। আশুগঞ্জ বন্দরকে পোর্ট অব কল ঘোষণা করে সেখানে তাদের জন্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। ১৩ পয়সা কেজিতে নৌ ট্রানজিট পেতে যাচ্ছে তারা। আমাদের নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারী যন্ত্রপাতি এক অংশ থেকে অন্য অংশে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছি।

গত সোমবার ভারত নিজেদের জন্য তরলীকৃত পেট্রলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) আমদানি করতে আমাদের চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করার প্রস্তাব দিয়েছে। আমাদের পুঁজিবাজার সুরক্ষার নামে গত সপ্তাহে ভারতের সাথে আমাদের পুঁজিবাজারের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।

দুই দিন আগে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন ভারতের সাথে বন্ধ সব পথ খুলে দেয়ার জন্য। বিপরীতে নিজেদের টাকায় চড়া মূল্যে ভারত থেকে যে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার কথা ছিল, তা-ও এখনো পুরোপুরি পাইনি আমরা। সাথে শুধু আশ্বাসই পেয়েছি ভুঁরিভুঁরি। পাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা শুধু পেলাম ১০০ কোটি ডলারের ঋণ। অথচ যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকার রিজার্ভের কথা বলে আমরা বুক ফুলিয়ে বড়াই করি, সেখানে ১০০ কোটি ডলার ধার নিয়ে আমরা তাদের জন্যই অবকাঠামো তৈরি করে দিতে যাচ্ছি।

আমাদের যে নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে নদীকে মেরে ফেলা হয়েছে আজ সেই মৃত নদীপথেই তাদের নৌ ট্রানজিট দিচ্ছি। আমাদের অপ্রতুল ভাঙা রাস্তাগুলোকে ‘মানবতার স্বার্থে’ উন্মুক্ত করে দিলাম তাদের জন্যই। অপর দিকে ভারত প্রতিবেশীর ন্যায্য অধিকারকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজেদের পাওয়াটাকেই বড় করে দেখেছে। আমরাও ভারতের সাথে চুক্তি করার আগে তিস্তাসহ ৫৪টি অভিন্ন নদ-নদীর ন্যায্য হিস্যায় পানিবণ্টন এবং সীমান্ত হত্যাসহ সব সমস্যার সমাধান আদায় করে নিতে পারিনি।

এগুলো আদায়ে আমাদের রাজনৈতিক দৈন্য প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। ১৯৭৫ সালে ‘মাত্র ৪১ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হবে বলে ফারাক্কা ব্যারাজ চালু করেছিল ভারত । ৪০ বছর পার হলেও এই পরীক্ষামূলক পানি প্রত্যাহার আজো চালুই রয়ে গেল। এবার তিস্তার সাথে জুড়ে দেয়া হলো ফেনী নদী ও মুহুরির চরের সমস্যার বিষয়টিকে। তিস্তার পানি পেতে হলে এখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা এই দুই রাজ্যের মুখাপেক্ষীও হতে হবে আমাদের।

পাঁচ. দেশে এখন কোনো শক্তিরই অস্তিত্ব নেই যে, জাতীয় স্বার্থে এগুলোর প্রতিবাদ করবে। তা হলে আমাদের জাতীয় স্বার্থের কথাগুলো বলবেটা কে? স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি হয়ে যাওয়ার ভয়ে সবাই যেন জাতীয় স্বার্থে মুখ খুলতে নারাজ। ভারতের সাথে আন্তঃরাষ্ট্রীয় কিংবা ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট যা-ই থাকুক না কেন, জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আমাদের জনগণের রয়েছে প্রচণ্ড আবেগ আর ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তির প্রত্যাশা ।

ভারতকে আমরা বন্ধুই ভাবি। তবে ভারত আমাদের সমমর্যাদার ভিত্তিতে না দেখার কারণে জাতীয় মর্যাদার প্রশ্নে আমরা ভারতের কাছ থেকে বরাবর দুঃখটাই বেশি পেয়েছি। গত কয়েক বছরে আমরা ভারতকে যথেষ্ট দিয়েছি; কিন্তু ভারত আমাদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।

সেই ১৯৭২ সাল থেকেই তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে তারা আমাদের মুলা ঝুলিয়ে রেখেছে। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও তারা বারবার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে চলেছে। পদ্মায় আজ পানিশূন্যতা। পদ্মা ও তিস্তাপারের মানুষের অনিবার্য নিয়তি লাঘবে দুই দেশের বন্ধুত্ব কোনো কাজেই আসেনি। সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি। কাঁটাতারে ঝুলন্ত ফেলানীরা আজো ন্যায়বিচার পায়নি।

ছয়. ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যে আকাশ-পাতাল ভারসাম্যহীনতা কেন কমছে না? শুল্ক-অশুল্ক বাধায় জর্জরিত আমাদের পণ্য ভারতের বাজারে ঢুকতে পারছে না কেন?

বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলগুলো পশ্চিমবঙ্গে পর্যন্ত দেখানোর অনুমতি নেই। ভারতীয় ভিসার জন্য অবর্ণনীয় দুর্ভোগের কোনো সীমা নেই। আমাদের যুবসমাজের মাদক সেবনের রসদ সরবরাহের জন্য সীমান্তজুড়ে ভারত সৃষ্টি করে রেখেছে অজস্র ফেনসিডিলের কারখানা। ভারত বারবার বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের কথা বললেও বর্তমানে ১৫ লাখেরও বেশি ভারতীয় অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছে।

অথচ ভারতের প্রবাসী আয়ের পঞ্চম বৃহত্তম অঙ্ক আয় করে বাংলাদেশ থেকেই। যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ থেকে ভারতের প্রবাসী আয়ের পরিমাণ প্রায় সমান। এ দিকে কোটি কোটি পাঠ্যপুস্তক ভারত থেকে ছাপিয়ে বিতরণ করছি আমরা। দেশের প্রকাশনা শিল্প এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করার সাহসই নাকি রাখে না। অথচ আমরা পুরো বাংলাদেশকে ভারতীয় পণ্যের বাজারে পরিণত করেছি।

ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ যে ২৫ ক্যাটাগরির পণ্য শুল্কের সুবিধা চাইছে এতদিন তা ভারত ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট আদায়ের বেড়াজালে আবদ্ধ রাখলেও এখন আর সেগুলোর কোনো খবর নেই। উপরন্তু বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন এবং টেলিকমিউনিকেশন লাইন টানার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বৃহৎ শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ ভারতের রফতানির বড় বাজার হচ্ছে বাংলাদেশ। রফতানির পাশাপাশি ভারতের রয়েছে অবৈধ চোরাচালান বাণিজ্য।

তার পরিমাণও বৈধ বাজারের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এই অবৈধ বাণিজ্যের কারণেও বাংলাদেশ বৈধ শুল্ক থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ভারতের মোট আমদানির ক্ষুদ্র এক অংশ (.০১%) আসে বাংলাদেশ থেকে। পক্ষান্তরে ভারত থেকে বাংলাদেশের মোট আমদানি হয় ১৫ শতাংশ। ভারতে তৈরী পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে ভারত কাউন্টার ভেইরিং ডিউটি আরোপ করে রেখেছে। পাটের ব্যাগ রফতানিতে ‘কান্ট্রি অব অরিজিন’ লেখার বাধ্যবাধকতা জারি করে রেখেছে। ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করলেও ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশী পণ্য নেপাল ও ভুটানে ঢুকতে দেয়া যাচ্ছে না।

যমুনা সেতুতে দেশের মানুষকে টোল দিতে হলেও টোল দিতে হয় না শুধু ভারতকে। নিজেদের স্বার্থ বিসর্জন দিয়েই আমরা বন্ধুত্বকে টিকিয়ে রেখেছি। অথচ বন্ধুত্বে দাবি দুই দিকেই সমান হতে হয়। একজনের বিসর্জন আর আরেকজনের শুধুই অর্জন কখনো বন্ধুত্ব হতে পারে না।

সাত. সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে, যা বর্তমানে বাংলাদেশ, কোনো সমুদ্রবন্দর ছিল না। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ছয় মাসের জন্য ভারত সরকারের কাছ থেকে কলকাতা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছিল। ভারত সরকার তখন প্রত্যুত্তরে বলেছিল, ছয় মাস কেন, ছয় ঘণ্টার জন্যও কলকাতা বন্দর ব্যবহার করতে দেয়া হবে না।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশকে কলকাতা বন্দর ব্যবহারের সব প্রস্তাবকে তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল ভারত সরকার। অথচ সেই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই ভারত সরকার চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করার চেষ্টা চালিয়ে আসছে। এতদিন পর এরা এই সরকারের আমলে এসে সেটা অর্জন করল। ভারতকে আমরা যেভাবে ট্রানজিট সুবিধা দিচ্ছি ,তা একমাত্র আফ্রিকান লেসোথো রাষ্ট্রের সাথেই তুলনা করা যেতে পারে। যেখানে দক্ষিণ আফ্রিকা দিয়ে চার দিকে ঘেরাও হয়ে থাকা ক্ষুদ্ররাষ্ট্র লেসোথো সোনার খনির মালিক হয়েও আজ দক্ষিণ আফ্রিকার দশম প্রদেশ হওয়ার জন্য নিজেরাই আবেদন জানাচ্ছে।

নিজেদের দেশের ক্ষতি করে অন্যের স্বার্থে নিজেকে বিসর্জন দেয়াটা কখনো বন্ধুত্বের নামান্তর হতে পারে না। আর মোদ্দা কথা হচ্ছে, এসব জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট কার্যকলাপে জনগণের সম্মতি আছে কি না? একটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অজুহাতে ক্ষমতায় আসা জবাবদিহিবিহীন অগণতান্ত্রিক সরকার নিজেদের গদি রক্ষার্থে যেভাবে জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে তারা স্বাভাবিকভাবেই ভারতের সাথে দরকষাকষি করার সব যোগ্যতাকে হারিয়ে ফেলেছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ফোন করে যেভাবে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানালেন তাতে বোঝা যায় অনুপ চেটিয়া ভারতের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমাদের ন্যায্য দাবিগুলো আদায়ের জন্য অনুপ চেটিয়া বড় একটা হাতের পাঁচ ছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটাকেও আমরা ক্ষমতায় থাকার প্রলোভনে বিনামূল্যে বিকিয়ে দিলাম! তবে এতে কারোই কোনো লাভ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ ভৃত্যের জন্য চরম বিপদের সময় সেটাই, যখন প্রভুকে দেয়ার মতো আর কিছুই তার কাছে অবশিষ্ট না থাকে।

লেখক : আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ [email protected]

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!