DMCA.com Protection Status
title="৭

বীর উত্তম জিয়াউর রহমানের জীবন ও কর্ম

ziaur-rahman-bnpমেজর জেনারেল(অবঃ)সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিম,বীর প্রতীকঃ স্বাধীনতার ঘোষণা। শব্দগুলো হুবহু এরকম নয়; কিন্ত আমি সহজ করে উপস্থাপন করার নিমিত্তে এরকম করে সাজিয়েছি উদ্বৃতি চিহ্নের মধ্যে।

“আমি মেজর জিয়া; আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। আমি মেজর জিয়া; আমি আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। আমি আপনাদেরকে আশ্বস্ত করতে চাই, যে দখলদার বাহিনীর হাত থেকে আমাদের দেশকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ ইতোমধ্যই শুরু হয়ে গিয়েছে। স্বাধীনতাকামী দেশবাসী এবং মানবতাবাদী বিশ্ববাসীর প্রতি আমার আহ্বান, আমাদের এই যুদ্ধে আপনারা আমাদের পাশে দাঁড়ান; আমাদের এই যুদ্ধে আমাদেরকে সহায়তা করুন; আমাদের সরকার এবং রাষ্ট্রকে আপনারা স্বীকৃতি দিন।”

২৭ মার্চ ১৯৭১, চট্টগ্রাম মহানগরের উপকণ্ঠে অবস্থিত তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানের কালুরঘাট সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে, তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান এইরূপ কথাগুলোই নিজের কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত করেছিলেন। তার আগের দিন, ঘড়ির কাঁটা ২৬ মার্চ ১৯৭১-এর আগমন ঘোষণা করেছিল, তার কয়েক মিনিটের মধ্যেই অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান পিএসসি, ব্যাটালিয়নের সৈনিকদের সামনে একটি শূন্য ড্রামের উপর দাঁড়িয়ে উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন অনেকটা এরকম, “আমরা বিদ্রোহ করলাম; আমরা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করলাম।” ব্যাটালিয়নের সকলেই উচ্চস্বরে সম্মতি দিয়েছিল।

বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম মহান ব্যক্তিত্ব শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান-এর জন্মদিনে, সম্মানিত পাঠকের বরাবর আমার বিনীত নিবেদন এই কলাম।

১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশের বগুড়া জেলায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জনাব মনসুর রহমান ছিলেন সরকারি দপ্তরে চাকরিরত একজন রসায়নবিদ। তাঁর মাতার নাম ছিল জাহানারা খাতুন (প্রকাশ রানী)। ৫ ভাইয়ের মধ্যে জিয়াউর রহমান ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর শৈশবের কিছু-কাল বগুড়ার গ্রামে ও কিছু-কাল কলকাতা শহরে অতিবাহিত হয়। পাকিস্তান এবং ভারত আলাদা হওয়ার পর তিনি প্রথমে পরিবারের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন অতঃপর তাঁর পিতার সঙ্গে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচী নগরীতে চলে যান। সেখান থেকে তিনি পরবর্তী ধাপের লেখাপড়া শেষ করেন এবং ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমী কাকুল-এ যোগদান করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনে যেমন অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ তারিখের মধ্যে, ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ৬ দফা উপস্থাপনের দিনটি অথবা ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণের দিনটি, অধিকতর স্মরণীয় এবং অধিকতর উজ্জ্বল; তেমনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জীবনের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ তারিখের মধ্যে ২৬ ও ২৭ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার দিনটি অথবা ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের দিনটি অধিকতর স্মরণীয় এবং অধিকতর উজ্জ্বল। জিয়াউর রহমান যেহেতু সেনাবাহিনীতে ছিলেন, সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই তাঁর সঙ্গে আমার মতো ক্ষুদ্র ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা সেনাবাহিনীর মাধ্যমেই শুরু। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমী কাকুল থেকে কমিশন পেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান।

তাঁর সঙ্গে আরও বাঙালি তরুণ ছিলেন যারা একইদিনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পেয়েছিলেন; একজনকে অনেকেই সহজে চিনবেন যথা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম সেনাবাহিনী প্রধান বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ বীর উত্তম। কমিশনের পরদিন থেকে জিয়াউর রহমান পাকিন্তান সেনাবাহিনীতে একজন অফিসার হিসেবে চাকরি করেন।

১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় তিনি প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর একজন কোম্পানী কমান্ডার ছিলেন এবং বীরত্বের সঙ্গে বর্তমান পাকিস্তানের লাহোরের সন্নিকটে ভারতীয় সীমান্তে প্রতিরক্ষা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের পরে ১৯৭১ এর আগে, জিয়াউর রহমান চারটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বর্তমান পাকিস্তানের কোয়েটা নগরীতে অবস্থিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্টাফ কলেজে স্টাফ কোর্স সম্পন্ন করে পিএসসি ডিগ্রী অর্জন করেন।

দ্বিতীয়ত, তিনি পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমী কাকুল-এ একজন প্রশিক্ষক-এর দায়িত্ব পালন করেন। তৃতীয়ত, সেনাবাহিনী কর্তৃক মনোনীত হয়ে তিনি ছয় মাসের জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে জার্মানী গমন করেন। চতুর্থত, তিনি ঢাকার অদূরে জয়দেবপুর (গাজীপুর)-এ দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং চট্টগ্রাম মহানগরীর ষোলোশহরে নব প্রতিষ্ঠিত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে উপ-অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৬৫’র পরে ১৯৭১’র আগে সময়টা ছিল উত্তাল। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবিনামা উপস্থাপন করেন। ১৯৬৮-এর শেষাংশ থেকে পুরো ১৯৬৯ ছিল গণআন্দোলনের বছর। ১৯৭০-এর ৭ ডিসেম্বর ছিল তৎকালীন সমগ্র পাকিস্তানব্যাপী সাধারণ নির্বাচন; যেই নির্বাচনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ ভূমিধ্বস সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। নির্বাচনের ফলাফলের তাৎপর্য ছিল এই যে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ৬ দফার ভিত্তিতে স্বাধীকার চান তথা পাকিস্তানের সংবিধানকে সংশোধন করে নতুন শাসনতান্ত্রিক কাঠামো চান। তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের রায়কে উপেক্ষা করেন এবং মানতে অস্বীকার করেন।

এই ষড়যন্ত্রমূলক আচরণের প্রথম আনুষ্ঠানিক বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ১ মার্চ ১৯৭১ তারিখে, যেইদিন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা-সরকার আসন্ন জাতীয় সংসদের অধিবেশনকে স্থগিত ঘোষণা করে। এরপর আসে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ।

উপরের অনুচ্ছেদে একটু রাজনৈতিক বর্ণনা দিলাম। তার আগের অনুচ্ছেদে জিয়াউর রহমানের সামরিক জীবনের বর্ণনা দিলাম। এই দুটি অনুচ্ছেদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয় যে, তিনি ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠছিলেন। তিনি ক্রমান্বয়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে নিজের হৃদয়ে স্থান দিয়েছিলেন। নিজে সামরিক কর্মকর্তা হলেও শৃংখলার কঠিন বেড়াজালে আবদ্ধ হলেও তিনি নিজেকে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের নিমিত্তে কী খেদমত করা যায় সেই প্রসঙ্গে চিন্তা-ভাবনা শুরু করার সুযোগ ও পরিবেশ পেয়েছিলেন।

আমার চাকরি জীবনে, ১৯৯৩ সালের মে মাস থেকে ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমি চট্টগ্রাম মহানগরী থেকে ১০ মাইল উত্তরে ভাটিয়ারি নামক স্থানে অবস্থিত বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমী-তে কমান্ডান্ট-এর দায়িত্ব পালন করেছি। আমার দায়িত্ব মেয়াদের শেষ ছয় মাস আমি ব্যস্ত ছিলাম একটি অতিরিক্ত কাজে। চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অবস্থিত ২৪ পদাতিক ডিভিশনের সদর দপ্তরের উল্টো দিকে একটি পুরানো একতলা দালানকে সংস্কার করে সেখানে স্থাপন করা হচ্ছিল এক মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পুরো চট্টগ্রাম জেলা ছিল ১ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন।

সেই ১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতিকে নতুন প্রজন্মের নিকট উদ্ভাসিত রাখার জন্য আমরা ঐ মুক্তিযুদ্ধ-জাদুঘর স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান মুক্তিযোদ্ধা লে. জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম বীর বিক্রম এবং তৎকালীন চট্টগ্রাম অঞ্চলের এরিয়া কমান্ডার ও ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল আজিজুর রহমান বীর উত্তম এর প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায়, আমার সার্বিকি নেতৃত্বে ও পরিচালনায় ঐ জাদুঘরটি স্থাপিত হয়। ঐ জাদুঘরের নাম স্মৃতি অম্লান। সেই জাদুঘর স্থাপনের কাজ করতে গিয়ে আমরা অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও মেজর জিয়াউর রহমান এর প্রসঙ্গে অনেক কিছু জানতে পারি।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শুরু থেকেই মেজর জিয়াউর রহমান সন্ধ্যার পরে রাত্রেবেলা একটি টয়োটা কার-এ করে শহরের বিভিন্ন জায়গায় যেতেন। উদ্দেশ্য পাকিস্তানী গোয়েন্দা বাহিনীদের চোখ এড়িয়ে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জনগণকে নিয়ে কী করা যায় সেই প্রসঙ্গে পরিকল্পনা করা। ঐ টয়োটা কারের মালিক, ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর মাসে, চট্টগ্রাম সেনানিবাসের কর্তৃপক্ষের কাছে, মিউজিয়ামে প্রদর্শনের নিমিত্তে, ঐ কারটি অফেরৎযোগ্য উপহারস্বরূপ প্রদান করেন। সেনানিবাসের স্বাভাবিক বিধি-নিষেধ মান্য করা সাপেক্ষে, যে কেউ ইচ্ছা করলে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে প্রবেশের বায়েজিদবোস্তামী-গেইট দিয়ে প্রবেশ করলেই, একশো গজ মাত্র যাওয়ার পর ঐ মিউজিয়ামের একতলা ভবনটি দেখতে পাবেন এবং তার সামনে কারটি দণ্ডাময়মান দেখতে পাবেন।

১৯৭১-এর এপ্রিল মাসের ৪ তারিখ, তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজারের বাসভবনে অনুষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধের প্রথম অপারেশনাল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সভাপতিত্ব ও নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন তৎকালীন কর্নেল এমএজি ওসমানী। মেজর জিয়াউর রহমান সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

১৯৭১-এর জুন-জুলাই মাসে যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনের নিমিত্তে, প্রথম ব্রিগেইড প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন পড়লো, তখন লে. কর্নেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে জেড ফোর্স গঠন করা হয়। জেড ফোর্স বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এবং উত্তর-পূর্ব এলাকায় যুদ্ধ করে। ঢাকা পতনের চারদিন আগেই জেড ফোর্স বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাংশ শত্রুমুক্ত করেন। আরও অনেকের সঙ্গে তিনি বীর উত্তম খেতাব পান। প্রথম তিন মাস তিনি জেড ফোর্স থেকে রূপান্তরিত হওয়া ৪৪ পদাতিক ব্রিগেড এর ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন, কুমিল্লা সেনানিবাসে। কুমিল্লা সেনানিবাসের তৎকালীন নাম ছিল ময়নামতি সেনানিবাস। এখনও সর্ব দক্ষিণের প্রবেশপথ দিয়ে সেনানিবাসে ঢুকতে গেলেই হাতের বায়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ দেখা যাবে, যেটি জিয়াউর রহমানের নির্দেশে ঐ তিন মাসের মধ্যেই স্থাপিত হয়েছিল।

১৯৭২ এর এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপ-সেনাবাহিনী প্রধান নিযুক্ত হন। যদিও তিনি জিয়াউর রহমান থেকে কনিষ্ঠ ছিলেন, তথাপি সফিউল্লাহকেই তৎকালীন সরকার সেনাবাহিনী প্রধান নিয়োগ করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে বঙ্গবন্ধু নিহত (শহীদ) হওয়ার ঘটনার পর সমগ্র দেশে ও প্রশাসনে অনেককিছু ওলট-পালট হয়। প্রায় তিন বছর চার মাস আট দিন চাকরির পর, তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ (বীর উত্তম)কে সরিয়ে তার জায়গায় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম)কে সেনাবাহিনী প্রধান নিয়োগ করা হয়। একই বছরের নভেম্বরের ৩ তারিখ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৎকালী চীফ অফ দি জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম এর নেতৃত্বে একটি কু-দ্যতা অনুষ্ঠিত হয়। এই কু-এর নেতৃবৃন্দ ৩ নভেম্বর শুরু হওয়া মাত্রই, জিয়াউর রহমানকে নিজ বাসভবনে বন্দি করেন। জিয়াউর রহমান কোনো প্রকার অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে চাননি; তিনি সেনাবাহিনী প্রধানের পদ থেকে ইস্তফা দেন; এই শূন্যস্থানে ৫ নভেম্বর তারিখে খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম সেনাবাহিনী প্রধান হয়ে যান।

ইতোমধ্যে, ৭ নভেম্বর তারিখে সিপাহী জনতার বিপ্লব সাধিত হয়। স্বাধীনতাকামী, জাতীয়তাবাদী, মুক্তিযুদ্ধমুখী সাধারণ সৈনিকগণ, তৎকালীন জাসদের ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করেই, জিয়াউর রহমানকে বন্দি দশা থেকে মুক্ত করেন এবং সেনাবাহিনী প্রধানের পদে পুনরায় আসীন করেন। ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা পুনরুজ্জীবনের দিন। বিশৃংখলা থেকে শৃংখলা ফিরিয়ে এনে, জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর কাঠামো অস্তিত্ব এবং আনুগত্য পুন:প্রতিষ্ঠা করেন।

৩ মাস আগে খন্দকার মোশতাক কর্তৃক জারি করা মার্শাল ল শাসন মোতাবেক, মোস্তাক ছিলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ ছিলেন অন্যতম উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। নভেম্বরের ৭ তারিখের পর, নতুন প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম হলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং নতুন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম হলেন অন্যতম উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। কালক্রমে, দেশের প্রশাসন জিয়াউর রহমানের প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। প্রথমে গণভোটের মাধ্যমে, পরে প্রকাশ্য নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৮১ সালের মে মাসের ৩০ তারিখ, অতি প্রত্যুষে, চট্টগ্রাম মহানগরীতে সরকারি সার্কিট হাউজে অবস্থানকালে, একটি সেনাবিদ্রোহের ফলশ্রুতিতে জিয়াউর রহমান নিহত (শহীদ) হন।

বীর উত্তম জিয়াউর রহমান, প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশে অনেকগুলো দূরদর্শী ও তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। এই সংক্ষিপ্ত কলামে অনেককিছু লেখা যাবে না। তারপরও, তারিখের ধারাবাহিতকা বজায় না রেখেই আমি এরকম কিছু দূরদর্শী ও তাৎপর্যপূর্ণ কাজ বা কিছু সিদ্ধান্ত বা কিছু অর্জনের কথা বর্তমান প্রজন্মের উপকারার্থে জন্য তথা এই কলামের সম্মানিত পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করছি।

এক. ১৯৭২-এ প্রতিষ্ঠিত জাতীয় রক্ষী বাহিনী জনগণের মানসপটে একটি ভীতিকর বাহিনী ছিল এবং তৎকালীন সেনাবাহিনীর মানসপটে একটি প্রতিদ্বন্দ্বী বাহিনী ছিল। সেনাবাহিনী প্রধান হওয়ার পরপরই জিয়াউর রহমানের তৎপরতায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, রক্ষী বাহিনীকে ভেঙে দেওয়া হবে না বরং তাদেরকে দেশের সেবার জন্য নতুন সুযোগ দেওয়া হবে। রক্ষী বাহিনীকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে একীভূত বা আত্মীকৃত তথা ইন্টিগ্রেইট করা হয়। পরিহাসের বিষয় যদিও, এই মুহূর্তে (২০০৯ থেকে ২০১৬) জিয়াউর রহমানের একনিষ্ঠ সমালোচনাকারীদের মধ্যে, সাবেক রক্ষী বাহিনীর ও পরে সেনাবাহিনীর কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ অফিসার আছেন।

দুই. ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সাংগঠনিক পর্যায় ছিল ব্যাটালিয়ন, তার উপরে ব্রিগেড এবং তার উপরে সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর। জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ এর শুরুতেই, নবম পদাতিক ডিভিশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাংগঠনিক স্তরকে এক ধাপ উপরে নিয়ে যান।

তিন. জিয়াউর রহমান বিশ্বাস করতেন যে, বাংলাদেশে স্বাধীনতা অর্জন যেমন সেনা সদস্য ও জনগণের সম্মিলিত প্রয়াস ছিল, তেমনই, দুর্যোগকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্বও যৌথভাবে সামরিক বাহিনী ও জনগণকে পালন করতে হবে। অতএব জনগণকে মৌলিক সামরিক ট্রেনিং দিতে হবে। তার জন্য তিনি ভিলেজ ডিফেন্স পার্টি বা ভিডিপি নামে একটি সংগঠন সৃষ্টি করেন এবং দশ বছরের মধ্যে এক কোটি বাংলাদেশীকে ভিডিপি ট্রেনিং দেবেন এই লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেন। ভিডিপি ট্রেনিংয়ের মৌলিক অংশ ছিল একেবারেই প্রাথমিক সামরিক প্রশিক্ষণ অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ এবং দ্বিতীয় অংশ ছিল জীবিকা নির্বাহের উন্নতির জন্য একটি সেকেন্ডারী পেশা যথা হাস মুরগী পালন যথা ক্ষেত-খামার করণ ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ।

চার. জিয়াউর রহমান পর্যায়ক্রমে সামরিক আইন শাসনকে শিথিল করেন এবং আড়াই বছরের মাথায় এটি পূর্ণাঙ্গভাবে প্রত্যাহার করেন।

পাঁচ. ১৯৭৫ সালে আনীত বাংলাদেশ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে যেই বহুদলীয় গণতন্ত্র নিষিদ্ধ হয়েছিল, জিয়াউর রহমান পুনরায় সেই বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করেন এবং বাকশাল হওয়ার আগে যে সকল রাজনৈতিক দল বাংলাদেশে বিদ্যমান ও সক্রিয় ছিল, সবগুলোকে নতুনভাবে রাজনীতি করার সুযোগ দেন। তিনি নতুন রাজনৈতিক দল চালু করার অনুমতি দেন এবং উদ্যোগও নেন। বহুদলীয়, সংসদ নির্বাচন এবং সার্বজনীন ভোটের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বন্দোবস্ত করেন। সংবাদ পত্রের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন।

ছয়. বিদেশ সম্পর্কের অঙ্গনে, জিয়াউর রহমান সার্ক (বা দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থা) এর স্বপ্নদ্রষ্টা। অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কনফারেন্স, নন এলাইন মুভমেন্ট এবং বৃটিশ কমনওয়েলথ অব নেশনস—এই তিনটি সংগঠনেই বাংলাদেশের অবস্থানকে সুদৃঢ় করেন। তিনি আল কুদস কমিটির সদস্য ছিলেন।

সাত. শিল্পাঙ্গনে, পূর্বে অনুসৃত জাতীয়করণ নীতি স্থগিত করেন। ব্যক্তি উদ্যোগে শিল্প প্রসারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বর্তমান ঢাকা মহানগরের মতিঝিলে অবস্থিত শিল্প ভবন নামক বহুতল দালানটি জিয়াউর রহমানের আমলেই করা।

আট. সরকারি কর্মকাণ্ডের সম্প্রসার ঘটান। তিনি ধর্ম মন্ত্রণালয় যুব উন্নয়ন মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করেন। শিশু একাডেমী জিয়াউর রহমানেরই উদ্যোগ।

নয়. তিনি পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ড, হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, শিশু হাসপাতল, নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করেন। দশ. মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার অন্যতম নির্দশন স্বরূপ তিনি রাষ্ট্রীয় সম্মান হিসেবে ‘একুশে পদক’ প্রদান প্রবর্তন করেন। এগারো. বহুধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি সম্মানের নির্দশন স্বরূপ তিনি চীন থেকে, অতিশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান-এর দেহভস্ম বাংলাদেশে আনেন এবং একটি স্মৃতিসৌধ স্থাপন করে রক্ষণাবেক্ষণ করেন।

১৯৭৬ সালের ১৩ মার্চ তারিখে, ঢাকা মহানগরের রামপুরায় অবস্থিত টেলিভিশন ভবনে, তৎকালীন বেতার ও তথ্য বিভাগের পদস্থ অফিসারদের এক সমাবেশে জেনারেল জিয়াউর রহমান বলেছিলেন (দৈনিক বাংলা ১৪ মার্চ ১৯৭৬): “আমরা সকলে বাংলাদেশি। আমরা প্রথমে বাংলাদেশি এবং শেষেও বাংলাদেশি। এই মাটি আমাদের, এই মাটি থেকে আমাদের অনুপ্রেরণা আহরণ করতে হবে। জাতিকে শক্তিশালী করায় আমাদের লক্ষ্য। ঐক্য, শৃংখলা, দেশপ্রেম, নিষ্ঠা ও কঠোর মেহনতের মাধ্যমেই তা সম্ভব।”

ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনালের সাংবাদিক ‘সুজান গ্রীন’, ঢাকা থেকে পাঠানো এক ডেসপাচে লিখেছিলেন, “সাম্যের প্রতীক ও সৎ লোকরূপে ব্যাপকভাবে গণ্য জিয়াউর রহমান, স্বনির্ভর সংস্কার কর্মসূচী শুরু করে বাংলাদেশের ভিক্ষার ঝুলি ভাঙার প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছেন।” মালয়েশিয়া দৈনিক ‘বিজনেস টাইমস’-এ প্রকাশিত ঐ ডেসপাচে বলা হয়: “অতীতে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে পরিচিত করেছিল যে মহাপ্লাবী সমস্যাগুলো, প্রেসিডেন্ট জিয়া কার্যত সেগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন (দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ নভেম্বর ১৯৭৯)।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরোক্ষ নেতৃত্বে, প্রবাসী সরকারের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে, রণাঙ্গণের লক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের জ্যেষ্ঠতম অধিনায়কদের অন্যতম ছিলেন সেক্টর কমান্ডার ও ফোর্স কমান্ডার মেজর, পরবর্তীতে লে. কর্নেল জিয়াউর রহমান্। একান্ত শৃংখলা অনুরাগী দেশপ্রেমিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে তিনি বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলেই উপ-সেনাবাহিনী হিসেবে আন্তরিক দায়িত্ব পালন করেন। পরিবেশ এবং জনআকাংখা যখন তাঁকে জাতির চালকের আসনে বসায়, তখনও, বীর উত্তম জিয়াউর রহমান একান্তই আন্তরিক দেশপ্রেমিকতার সঙ্গে দেশের সেবা করেন। তিনি ছিলেন সামরিক জেনারেল, রূপান্তরিত হয়েছিলেন একজন রাজনীতিবিদে এবং সঙ্গতভাবেই উন্নীত হয়েছিলেন একজন রাষ্ট্রনায়কের মর্যাদায়।

এতদসত্ত্বেও চিরন্তন ঘোষণা হবে এইরূপ: জিয়াউর রহমান একজন মানুষ ছিলেন; মানুষ হিসেবে তাঁরও ভুলভ্রান্তি ছিল; ভুলভ্রান্তি থাকাটাই স্বাভাবিকদ; কিন্তু তাঁর অর্জন ছিল অনেক বেশি, অনেক মহৎ ও অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯ জানুয়ারি বীর উত্তম জিয়াউর রহমানের জন্মদিনে আমরা, তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করছি; তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করছি; তাঁর পিতামাতার রুহের মাগফিরাত কামনা করছি; তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র আরাফাত রহমান কোকো’র রুহের মাগফিরাত কামনা করছি; তাঁর সম্মানিত সহধর্মীনির দেশনেত্রীর সুস্বাস্থ্য ও সম্মান কামনা করছি এবং তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রের সুস্বাস্থ্য ও সম্মান কামনা করছি। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপির সাংগঠনিক সুস্বাস্থ্য ও সম্মান কামনা করছি; আমরা বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটেরই অংশ।

ibrahimলেখকঃ অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা,রাজনীতিবীদ এবং চেয়ারম্যান,বাংলাদেশ কল্যান পার্টি।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!