ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ নিজের জারীকৃত নির্দেশনা নিজেই লঙ্ঘন করেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। কথার সঙ্গে কাজের ব্যাপক অমিলের কারণেই ঘটে এই বিপত্তি। বিচারের ক্ষেত্রে তা হয়ে উঠে আরো প্রকট। এমনটিই ঘটেছে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের অবসরে যাওয়ার পর লেখা রায়কে নিয়ে।
তিনি প্রধান বিচারপতি থাকার সময় নির্দেশন জারী করে বলেছিলেন, বিচারপতিদের যে কোনো মামলার কার্যক্রম শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করতেই হবে,অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে ।
অথচ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ে অন্যতম আলোচিত রায় সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে তিনিই রায় ঘোষণার পর অবসরে গিয়ে দির্ঘদিন সেই রায় লেখেন। আর তার অবসরে যাওয়ার ১৭ মাস পর এ সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়।
বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বিচারপতিদের প্রতি নিজের আহ্বানের প্রতিফলন তার নিজের ক্ষেত্রে দেখাতে পারেননি।
সম্প্রতি এ বিষয়টি আবারও আলোচনায় আসে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার এক বক্তব্যের পর।
তিনি বলেন, অবসরের পর বিচারপতিদের রায় লেখা অসাংবিধানিক। আর এই বক্তব্য আদালত পাড়া তো বটেই উত্তাপ ছড়িয়েছে সংসদ সহ সারা দেশ ব্যাপি।
বিশিষ্ট আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনের সমর্থন প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের পক্ষেই।
তিনিও বলেন, অবসরের পর রায় লেখা শপথ ভঙ্গের সামিল। দেশের সংবিধান আর বিদ্যমান আইনে বিচার বিভাগের ক্ষমতা আর বিচারপতিদের কাজের পরিধি নিয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা না থাকায় বিতর্কটি তুঙ্গে উঠেছে বলে মনে করছেন অনেকেই। এছাড়া অবসরের পরে বিচারপতিরা রায় লিখতে পারেন কি না তা নিয়েও আইনজ্ঞদের মধ্যেই রয়েছে ভিন্ন মত।
তবে দেশের ইতিহাসে অনেক বড় কিংবা আলোচিত মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় অবসরে যাবার পর লিখেছেন বিচারপতিরা। আর এ দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিচার প্রার্থীদের দুর্ভোগ নিয়েও কম হয়নি আলোচনা-সমালোচনা। এই বাস্তবতায় মামলার কার্যক্রম শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করতে বিচারপতিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক।
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে বিচারপতি এমবিএম খায়রুল হক রায় ঘোষণার পর তার অবসরে যাওয়ার ১৭ মাস পরে এ সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়।
সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকের মতামতের ভিত্তিতে অর্থাৎ বিভক্ত রায়ে ২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগ। বিচারপতি খায়রুল হক অবসরে যান ২০১১ সালের ১৭ মে। আর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয় ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর।
আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির ওই রায়কে ভিত্তি ধরে ২০১১ সালের ৩ জুলাই সংবিধান সংশোধন করে প্রথম মহাজোট সরকার, যাতে বিলুপ্ত হয় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা।
সে সময় সংক্ষিপ্ত রায়ে সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন হতে পারে বলে মত দেয় এবং আরো অভিমত দেয় যে, বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের বিচারপতিদের বাদ রেখে সংসদ এ সরকার পদ্ধতি সংস্কার করতে পারে।
আপিল বিভাগের রায়ের পর তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলোপের দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়।
এর প্রতিবাদে ২০১৩ ও ২০১৪ সালজুড়ে রাজপথে ছিল বিএনপি-জামায়াত। এতে নিহত হয় বহু মানুষ। সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ের পর থেকে বিএনপিসহ বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি পুনর্বহালের দাবি জানিয়ে আসছে। সংবিধানের এই সংশোধনের বিরোধিতা করে আসছে বিএনপি।
তারা বলছে, সরকার রায়ের একটি অংশ ধরে সংবিধান সংশোধন করলেও অন্য অংশটি উপেক্ষা করেছে। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী ও তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আপিল বিভাগের দেয়া চূড়ান্ত পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয় ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর।
ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায়ের সময় প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। রায়ে চারজন বিচারক ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে মত দিয়েছেন, বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন দুজন আর বিষয়টি জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দেয়ার রায় দিয়েছেন একজন।
রায়ের ৩৪২ পৃষ্ঠার মূল অংশ বাংলায় লিখেছেন বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, তার সঙ্গে একমত হয়েছেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, আপিল বিভাগের সিনিয়র বিচারপতি এস কে সিনহা ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।