ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ হাসিনা সরকারের তরফ থেকে প্রতিবন্ধকতার আশংকা সত্ত্বেও মার্চে অনুষ্ঠিতব্য দলের ৬ষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল ঘিরে চাঙ্গা হয়ে উঠছে বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
যারা এতদিন আত্মগোপনে ছিলেন বা নিষ্ক্রিয় ছিলেন তারাও এখন সক্রিয় হয়ে উঠছেন। সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার প্রতিবাদে ঘোষিত বিক্ষোভ কর্মসূচিতে দলের নেতাকর্মীদের রাজপথে দেখা গেছে। অনেকস্থানে তাদের পুলিশের সাথে বাক-বিতন্ডায় লিপ্ত হতে দেখা গেছে। যা সাম্প্রতিককালে দেখা যায়নি।
বিএনপির নেতারা মনে করেন, সরকারের দমনপীড়নের কারণে নেতাকর্মীরা প্রাকাশ্যে আসতে পারছেন না। কাউন্সিল করার ঘোষণার পর দেশব্যাপী নেতাকর্মীদের মাঝে উৎসাহের আমেজ সৃষ্টি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির সহ-প্রচার সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স আশা করে বলেন, এ কাউন্সিলে সরকার কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না ।
সূত্র মতে, মার্চে সম্ভাব্য ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র ব্যবহারের জন্য গত ২৭ জানুয়ারি চিঠি দিয়েছে বিএনপি। ১৯ মার্চ সম্ভাব্য তারিখ রেখে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কাছে এই ভেন্যু চাওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির এক নেতা জানান, প্রথমত আমরা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে কাউন্সিল করতে চাই। এজন্য বুকিংয়ের জন্য গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ১৯ মার্চ কাউন্সিলের তারিখ রেখে অনুমোদন চাওয়া হয়েছে। ওইদিন যদি সেখানে অন্য প্রোগ্রাম থাকে তাহলে ২০ বা ২১ তারিখেও হতে পারে।
তিনি আরো বলেন, আশা করছি সরকার অনুমোদন দিবে। তবে, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র ছাড়াও কাউন্সিলের জন্য আরো কি বিকল্প ভেন্যু হতে পারে সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে।
বিএনপির একাধিক নেতা জানান, ষষ্ঠ কাউন্সিল অনুষ্ঠানের নানা প্রস্তুতি শুরু করেছে তারা। এজন্য একাধিক সাব কমিটিও চূড়ান্ত। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, তরিকুল ইসলাম অথবা নজরুল ইসলাম খানকে কাউন্সিল বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক করা হতে পারে।
এছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকেও দায়িত্ব দেয়া হতে পারে।
জানা গেছে, কাউন্সিল সামনে রেখে সাংগঠনিক ভিত মজবুত করতে দলের হাই কমান্ডে নতুন নতুন চিন্তাভাবনা চলছে। দলের নির্বাহী কমিটিতেও আসছে নানা পরিবর্তন।
পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে একটি ভিডিও বার্তার মাধ্যমে দীর্ঘ বক্তব্য দিয়েছিলেন দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমান। তার সে বক্তব্য নেতাকর্মীদের করেছিল দারুণভাবে উজ্জীবিত।
এবারের কাউন্সিলেও তিনি একটি ভিডিও বক্তব্য দেবেন বলে জানিয়েছেন একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র। তিন বছর পর পর কাউন্সিল করার কথা থাকলেও এবারের কাউন্সিল হতে যাচ্ছে ছয় বছর পর।
সর্বশেষ ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে কাউন্সিল হয়েছিল। মধ্যে ২০১৩ সালের মার্চে কাউন্সিলের ঘোষণা দিলেও তা করতে পারেনি বিএনপি।
নেতারা জানান, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দু’দফায় প্রাথমিক প্রস্তুতি নেয়ার পরও সরকারের নানা পদক্ষেপের কারণে কাউন্সিল আয়োজন থেকে সরে আসতে হয়েছে বিএনপিকে। এবারও সরকারের তরফ থেকে যে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে এমন আশঙ্কা করছেন তারা।
দলের গঠনতন্ত্রে বলা আছে, জাতীয় কাউন্সিলের সদস্যদের সরাসরি ভোটে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে তিন বছরের জন্য দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন।
দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, চেয়ারপার্সন পদে খালেদা জিয়ার বিপরীতে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ইচ্ছা প্রকাশ করবেন না বা ফরম নেবেন না। সে ক্ষেত্রে এখানে আর কাউন্সিলরদের ভোটাভুটিতে যেতে হবে না। খালেদা জিয়া বিনা প্রতিদ্বন্দি¦তায় আবার দলের চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হবেন।
সূত্র মতে, কাউন্সিলের তারিখ চূড়ান্ত হলেই গঠনতন্ত্রে পরিবর্তনের জন্য কাউন্সিলরদের কাছে প্রস্তাবনা আহ্বান করা হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মহাসচিবের কাছে জমাকৃত প্রস্তাবনাগুলো গঠনতন্ত্র সংশোধন কমিটি প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ের পর দলের স্থায়ী কমিটিতে উত্থাপন করবেন। কাউন্সিলে সবার মতামতের ভিত্তিতে সেগুলোর সংযোজন-বিয়োজন করা হবে গঠনতন্ত্রে। তবে কাউন্সিলের আগেই দলের তৃণমূলে চলমান পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সরকারের প্রতিবন্ধকতা এড়াতে এবারের কাউন্সিল নিয়ে খুব বেশি হাঁকডাক থাকবে না। গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে সাংগঠনিক কাঠামোতে কয়েকটি নীতিগত পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত আসতে পারে কাউন্সিলে।
ইতিমধ্যে বিভিন্ন মতবিনিময় সভা ও দলীয় ফোরামে চেয়ারপার্সনের কাছে উত্থাপিত কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রস্তাবনাগুলো হচ্ছে- এক নেতা এক পদ নীতিতে কমিটি গঠন, জাতীয় নির্বাচনে এমপি প্রার্থীদের স্থানীয় কমিটির পদে না রাখা, দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব পদটি সংরক্ষিত রাখা, জাতীয় নির্বাহী কমিটির পরিধি কমানো, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টামন্ডলীকে বিএনপির উপদেষ্টামন্ডলীতে পরিণত এবং মন্ত্রণালয় ভিত্তিক চেয়ারপার্সনের পরামর্শক কমিটি গঠন।
পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলের পর ইতিমধ্যে দলের স্থায়ী কমিটিসহ ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা, যুগ্ম মহাসচিব, সম্পাদকমন্ডলী ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির বেশ কয়েকজন নেতা মৃত্যুবরণ করেছেন।
দীর্ঘ অর্ধযুগের এ সময়ে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়েছেন অনেকেই। সেইসঙ্গে ছাত্রদলের রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়া সাবেক ছাত্রনেতা ও যুবনেতারা সাংগঠনিক কাঠামোতে আসার অপেক্ষায় রয়েছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একাধিক মতবিনিময় সভায় সক্রিয় নেতাদের পদোন্নতি, নিষ্ক্রিয় নেতাদের বাদ দিয়ে নতুনদের সুযোগ দেয়ার কথা বলেছেন চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। সূত্র জানায়, আগামী কাউন্সিলে কাউন্সিলর হিসেবে অংশ নেবেন অন্তত ৩ হাজার কাউন্সিলর। কাউন্সিলর তালিকা চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পর চেয়ারপার্সনের কোটায় মনোনীত কাউন্সিলরসহ সবার কাছে আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হবে।
এছাড়া কাউন্সিলের প্রথম সেশনে ২০ দলীয় জোটের শরিক দল, বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল, বিএনপির জেলা, মহানগর, থানা, উপজেলা ও পৌর ইউনিটের নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। বিগত কাউন্সিলে অংশ নিয়েছিলেন কয়েকটি দেশের বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা।
এবারের কাউন্সিলেও যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, শ্রীলঙ্কা, চীনসহ কয়েকটি দেশের রাজনৈতিক নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হবে।
দলীয় সূত্র জানায়, কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে দলের নেতাদের বিগত ৬ বছরের কর্মকাণ্ড, অবদান, সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে চলার ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ ও বিচার বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে বিগত ৬ বছরে নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা-হামলার একটি তালিকা তৈরি করে চেয়ারপার্সনের কাছে জমা দেয়া হয়েছে। কাউন্সিলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্ধারণের জন্য দলের কেন্দ্রীয় দপ্তরের তালিকা ছাড়াও নানামুখী খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।
এছাড়া লন্ডন সফরকালে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও ভবিষ্যৎ কর্ণধার তারেক রহমানের সঙ্গে সাংগঠনিক পুনর্গঠন ইস্যুতে আলোচনা করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
নেতারা জানান, আগামী কাউন্সিলেই সে আলোচনার একটি প্রতিফলন ঘটবে দলের নেতৃত্ব নির্বাচনে।