ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ প্রায় ১ মাস আগে হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আটশ’ কোটি টাকা চুরি (হ্যাক) করেছে ,কিন্তু এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক দায়ী বলে প্রকৃত ঘটনা চেপে রাখার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রকৃত ঘটনা হলো, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব সুইফট কোডের মাধ্যমেই টাকা লুটের ঘটনা ঘটেছে। আর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের এই সুইফট কোডের নিয়ন্ত্রণ করা হয় ভারত থেকে।
টাকা লুটের পর এই নিয়ন্ত্রণে জড়িতদের বাংলাদেশে আসতে বলা হলেও তারা আসছে না। সুইফট তথা সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন হলো বেলজিয়ামভিত্তিক আন্তব্যাংক আর্থিক লেনদেনের নেটওয়ার্ক।
এর মাধ্যমে আন্তব্যাংক লেনদেনের পরিচিতি শনাক্ত করা হয়। যা মূলতঃ সংকেতলিপি তথা কোডের মাধ্যমে করা হয়। এক্ষেত্রে লেনদেনের তারবার্তা (ওয়ার) এই কোডের মাধ্যমে আদান প্রদান করা হয়।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুইফট কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় প্রেরণকারী ও গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যে বার্তা (ওয়ার) বিনিময় হয়েছে, সেটি ছিল বিশ্বাসযোগ্য (অথেনটিক)। এখন পর্যন্ত আমাদের নেটওয়ার্ক অপব্যবহার হয়েছে, এ রকম কোনো লক্ষণ পাওয়া যায়নি।
যার মানে দাঁড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাঠানো সুইফট কোড দিয়েই এই টাকা সরানো হয়েছে। এক্ষেত্রে সহজেই ধারণা করা সম্ভব যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ এই কোড পাঠানোর সঙ্গে জড়িত।
এখন প্রশ্ন হলো কে জড়িত? বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা দাবি করেছেন, ‘সার্ভার বাংলাদেশ থেকে হ্যাকড হয়নি। এটি দেশের বাইরে থেকে হয়েছে, যা আমাদের আওতার বাইরে। তদন্তের স্বার্থে এর চেয়ে বেশি কিছু বলা যাবে না।’ দেশের বাইরে কোথা থেকে এবং কারা টাকা চুরি করেছে তা শুভঙ্কর না বললেও ফাঁকিবাজি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেই।
ব্যাংকের একটি সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে সুইফটের নিয়ন্ত্রণ হয় ভারত থেকে। রিজার্ভ অর্থ চুরির ঘটনার পরপর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ভারতে সুইফটের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের কর্মকর্তাদের দ্রুত এ দেশে আসার আহ্বান জানানো হয়। প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংকের দিক থেকে অন অ্যারাইভেল ভিসার ব্যবস্থার কথা জানানো হয়।
কিন্তু তাতেও প্রত্যাশিত সাড়া মেলেনি। জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে মজুদ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ থেকে প্রায় ১ বিলিয়ন (১০০) কোটি ডলার বা ৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা লুট করতে সুইফট কোডের মাধ্যমে ৩৫টি ‘অ্যাডভাইস’ (পরামর্শ) পাঠানো হয়েছিল।
এর মধ্যে গত ৫ ফেব্রুয়ারি ৫টি অ্যাডভাইস কার্যকর হয়। যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক থেকে রিজার্ভের মোট ১০১ মিলিয়ন বা ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার ( ৮৮০ কোটি টাকা) শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনে পাচার করা হয়। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কায় গেছে ২ কোটি ডলার আর ফিলিপাইনে গেছে ৮ কোটি ১০ লাখ লাখ ডলার।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক নির্ভরশীল সূত্রে জানা গেছে, শ্রীলঙ্কা থেকে উদ্ধার করা দুই কোটি ডলার গিয়েছিল সে দেশের একটি ব্যাংকে নতুন খোলা এনজিও (বেসরকারি সংস্থা) হিসাবে। কনসালট্যান্সি বা পরামর্শক ফি হিসেবে ওই অর্থ স্থানান্তরের ‘পরামর্শ’ গিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সংকেতলিপি থেকে। কিন্তু শ্রীলঙ্কায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন শক্তিশালী হওয়ায় নতুন একটি হিসাবে বড় অঙ্কের অর্থের লেনদেনের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সন্দেহের চোখে দেখে। তখন ওই ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিষয়টি শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরে আনা হলে সেই অর্থ আটকে দেওয়া হয়। তাতে ওই টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হয়।
সূত্রটি আরও জানায়, ফিলিপাইনেও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা ব্যাংক হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ব্যাংক থেকে অর্থ স্থানান্তর হয়ে জমা হয়। পরে সেখান থেকে অন্য হিসাবে সেসব অর্থ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ফিলিপাইনের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের দুর্বলতা এবং ঘটনার সঙ্গে ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা জড়িত থাকায় বড় অঙ্কের বৈদেশিক লেনদেন সত্ত্বেও তা অনায়াসে এক হিসাব থেকে অন্য হিসাবে চলে যায়।
ফিলিপাইনের সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, চুরি করা অর্থের বড় অংশই কয়েকটি ক্যাসিনোর হাত ঘুরে ফিলিপাইন থেকে বেরিয়ে হংকংয়ে চলে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, চুরি যাওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অ্যান্টি মানি লন্ডারিং কর্তৃপক্ষের বেশ সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া চুরি যাওয়া অর্থ ফেরত আনতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও বাংলাদেশ ব্যাংকের যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবারও এ দুই ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় মতবিনিময়ের কথা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের লুকোচুরি গত ৫ ফেব্রুয়ারি সুইফট কোডের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকে মজুদ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে মোট ১০ কোটি ১০ লাখা ডলার শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনে পাচার করা হয়।
টাকা পাচারের পরপরই বাংলাদেশ ব্যাংককে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘটনা জানায় এবং পাচার হওয়া অর্থ ফেরত দেয়। কিন্তু ফিলিপাইনে পাচার হওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ লাখ ডলার লুটেরা নিয়ে যেতে পেরেছে।
তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো ৫ ফেব্রুয়ারির এ ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংক এক মাসেরও বেশি সময় ধামাচাপা দিয়ে রাখে। এমনকি গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনের সংবাদপত্র দি ফিলিপিন্স ডেইলি ইনকোয়ারার টাকা পাচারের প্রতিবেদন ছাপলেও ৭ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংক লিখিত এক বিবৃতির মাধ্যমে দেশে-বিদেশে আলোচিত এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে।
এদিকে একই দিন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানান, তিনি সংবাদপত্র থেকে টাকা পাচারের কথা জেনেছেন, এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক তাকে কিছুই জানায়নি।
প্রশ্ন হলো এতবড় ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংক কেন এতদিন চেপে রেখেছিল এবং এক মাসেরও বেশি সময় খোদ অর্থমন্ত্রীকেও তারা ঘটনা অবহিত করেনি কেন?