DMCA.com Protection Status
title="৭

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করিঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর হাফিজ

hafiz copy

মেজর(অবঃ) হাফিজউদ্দীন আহমেদ,বীর বিক্রমঃ  ৩০শে মার্চ, ১৯৭১ সাল। সকাল সাড়ে ৭টা। ভোরের আলো সবেমাত্র ফুটেছে। যশোর ক্যান্টনমেন্টের পরিবেশ তখন সুনসান। বাথরুম থেকে বের হতেই আমার সামনে এসে দাঁড়ালো অর্ডারলি। চেহারায় উত্তেজনার ছাপ। চোখের কোণে টলমল করছে পানি।

সে আমাকে বললো- ‘স্যার সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমরা হাতিয়ার সাফ করতে কোতে (অস্ত্রাগার) গিয়েছিলাম। কিন্তু ব্রিগেড কমান্ডার আমাদের হাতিয়ার ধরতে বারণ করেছেন। শিগগিরই নাকি বালুচ রেজিমেন্ট এসে আমাদের সব অস্ত্র নিয়ে যাবে।’ তখন আমি তাকে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলাম। এবং তাড়াতাড়ি উর্দি পোশাকে তৈরি হতে বললাম।

যশোরের ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে তখন আমরা তিনজন মাত্র বাঙালি অফিসার ছিলাম। ঘটনাটা রুমমেট বাঙালি অফিসার আনোয়ারকে বললাম। শুনে সেও উত্তেজিত হয়ে উঠলো। ইউনিফর্ম পরে দ্রুত অফিসের দিকে দৌড়ালাম। অফিসের ভেতর ঢুকেই দেখি চারদিকে ইতস্তত দৌড়াদৌড়ি। বাঙালি অফিসার কর্নেল জলিল উদ্ভ্রান্তের মতো পাঁয়চারি করছেন। পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন বর্ষীয়ান সহ-অধিনায়ক পাঞ্জাবি অফিসার মেজর ইকবাল কোরেশি।

কর্নেল জলিলকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, ব্রিগেড কমান্ডার একটু আগে এসেছিলেন। আমাদের নিরস্ত্র করা হয়েছে। তার চোখ অশ্রুসিক্ত, কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ। ঠিক ওই সময় চারদিকে শুরু হয়ে গেল দ্রিম দ্রিম, ঠা-ঠা-ঠা, ট্যাট-ট্যাট তুমুল গুলিবর্ষণ। রাইফেল, মেশিনগান, স্টেন কারবাইন, মর্টার সব ধরনের মারণাস্ত্র থেকে অবিরাম গুলিবর্ষণ চলছে। মাঝে-মধ্যে আমাদের অফিসের দেয়ালে এসে বুলেট বিদ্ধ হচ্ছে।

হুড়মুড় করে দৌড়ে এসে রুমে ঢুকলো পাকিস্তানি সুবেদার মেজর আজিম। বললো- ‘স্যার গজব হোগিয়া’ (সর্বনাশ হয়ে গেছে)। আমাদের জওয়ানরা চরম উত্তেজিত হয়ে অস্ত্রাগার ভেঙে ফেলেছে। অস্ত্র বের করে ওরা চারদিকে ফায়ার করছে। সবাই স্তব্ধ, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অফিস রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালাম। তখনও গুলিবর্ষণ চলছে। বারান্দায় একটি থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে ভাবছি- কেন এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো।

পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছিল। নিরস্ত্র করার উদ্যোগ নেয়ায় তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। অফিসের পেছনে একটা ছোট ডোবা। চারদিকে আম, কাঁঠাল, খেজুর আর নানা গাছগাছালির বাগান। ঘটনা ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য ধীরে ধীরে এগুলাম বাগানের প্রান্তসীমায়। আমাদের সৈন্যরা উত্তেজিত হয়ে ছোটাছুটি করছে।

পরিখার মধ্যে অবস্থান নিয়ে বাইরের দিকে গুলি ছুড়ছে। একটু এগিয়ে দেখলাম- আমাদের তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। ২৫ বালুচ এবং ৩ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সৈন্যরা আমাদের অবস্থানে আক্রমণ চালানোর জন্য প্রাথমিক প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের আর আমাদের মধ্যে দূরত্ব মাত্র এক হাজার গজ। কোথাও পাঁচশ’ আবার কোথাও তিনশ’।

শত্রুপক্ষের তিন ইঞ্চি মর্টারের গোলা এসে আমাদের সামনে ফাটছে। একটা আম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ভাবছি- এই মুহূর্তে আমার কি করণীয়। বিদ্রোহী সেনাদের সঙ্গে যোগ দেব নাকি একান্ত বাধ্যগত সৈনিক হিসেবে চুপচাপ সিও অফিস ঘরে অন্য অফিসারদের সঙ্গে বসে থাকবো। এসময় ধীর পায়ে এগিয়ে এলো সুবেদার মজিদসহ আরও দুজন।

বললো- আমরা পাক সেনাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি। বাঙালি অফিসার হিসেবে আপনি আমাদের নেতা। এখন এই যুদ্ধে আপনাকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। একজন অফিসারের নেতৃত্ববিহীন আমাদের পক্ষে বেশিক্ষণ লড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। উপলব্ধি করলাম- দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সারা দেশে কোথায় কি হচ্ছে তার কিছুই জানি না। আমাদের বিদ্রোহ দেশের মানুষ কিভাবে নেবে সে সম্পর্কেও কোন ধারণা নেই। শৃঙ্খলা রক্ষা করাই সৈনিক জীবনের মূলমন্ত্র। সেনা কর্তৃপক্ষের বিদ্রোহের শাস্তি মৃত্যুদন্ড । মিনিটখানেক চিন্তা করে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম বিদ্রোহের পক্ষে।

নিজের সেনাদলের পাশে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাদের নেতৃত্ব দেবো। বাঙালিদের প্রতি দীর্ঘদিনের অন্যায় শোষণ আর বঞ্চনার মোকাবিলা করার জন্য সংকল্পবদ্ধ হলাম।

সবাইকে ডেকে জানিয়ে দিলাম- এখন থেকে যুদ্ধ চলবে আমার নির্দেশে। ব্যক্তিগত খেয়ালখুশির কোন অবকাশ নেই। প্রতিটি গুলি মূল্যবান। তাই দেখে-শুনে ছুড়তে হবে। এসময় সকল জেসিওকে (জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার, নায়েব সুবেদার ও সুবেদার) ডেকে সংক্ষেপে যুদ্ধ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলাম।

নিজেদের সংখ্যা, অস্ত্রশস্ত্র, শত্রু সেনাদের অবস্থান ইত্যাদি মূল্যায়ন করে নির্দেশ দিলাম কিভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করতে হবে। কোথায় ভারি অস্ত্র বসাতে হবে। এতে সৈনিকদের মনোবল চাঙ্গা হলো। ফিরে এলো শৃঙ্খলা। শুরু হলো এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের নতুন অধ্যায়। কোন রকম পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই ঘটে এই বিদ্রোহ।

১০৭ ব্রিগেডের কামান্ডার ব্রিগেডিয়ার দুররানি পল্টনকে নিরস্ত্র করার নির্দেশ দিয়েছেন। এই সংবাদ পেয়েই সৈনিকরা আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠে। অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে হালকা অস্ত্র রাইফেল, স্টেন, লাইট হেভি মেশিনগান সংগ্রহ করে আমাদের সৈনিকরা প্রথমে পার্শ্ববর্তী পাঞ্জাবি ব্যারাকের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। সপ্তম ফিল্ড এম্বুলেন্সের বাঙালি বেশ কয়েকজন সৈনিক আমাদের বিদ্রোহে যোগ দেয়।

যশোরের ছাউনির পাঞ্জাবি পাঠান সৈনিকরা আমাদের এই বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত ছিল। কারণ ইতিমধ্যেই চট্টগ্রাম, জয়দেবপুর, রংপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকরা বিদ্রোহ করেছিল। কিন্তু এই খবর আমরা জানতাম না। পার্শ্ববর্তী ইউনিটগুলো আমাদের দ্রুতগতিতে ঘিরে ফেলে। মর্টার এবং অন্যান্য ভারী অস্ত্র দিয়ে গুলিবর্ষণ শুরু করে। তারা এতদ্রুত আক্রমণের প্রস্তুতি নেয় যে আমাদের সৈন্যরা পর্যাপ্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করতে পারেনি। তবে আমাদের অফিস ও ব্যারাক এলাকার চারদিকে আগে থেকেই পরিখা খনন করা ছিল।

এতে আমরা সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলাম। সকাল ৯টায় সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ চালিয়ে শত্রুরা আমাদের এলাকায় প্রবেশ করতে পারেনি। ইতিমধ্যে আমাদের গোলা-বারুদ শেষ হয়ে আসে। উভয় পক্ষের গুলিবিনিময়ে আমাদের জনাবিশেক হতাহত হয়।

ওই সময় লেফটেন্যান্ট আনোয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে বাগানে আসে। তাকে বললাম, আমি বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিচ্ছি। আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়ার কথা বলায় সে রাজি হলো। তাকে উত্তর প্রান্তের রক্ষণব্যূহ পরিচালনার দায়িত্ব দিলাম। আমরা সমানে লড়ে চলেছি। বেলা সাড়ে তিনটা।

সুবেদার মজিদ এসে জানালেন- গুলি শেষ। এখন কি করা যায়। আনোয়ার ও আরও কয়েকজন জেসিওকে ডেকে পরামর্শ করলাম ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে। অবশেষে নির্দেশ দিলাম- সবাইকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে যেতে হবে ৩-৪ জনের ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে। একত্র হতে হবে চৌগাছা বাজারে। শত্রু তিনদিক দিয়ে পজিশন নিয়ে ঘিরে রেখেছে আমাদের। শুধু পশ্চিমের মাঠ খোলা। প্রায় দেড় হাজার গজ বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। কিন্তু উত্তরদিকের মেশিনগানের গুলির সাহায্যে এই এলাকাটি কাভার করে রেখেছে। তাদের অবিরাম গুলিবর্ষণে ক্ষেতের ধুলো উড়ছে। শত্রুর বেষ্টনী থেকে বের হওয়ার আর কোন পথ নেই।

সিদ্ধান্ত নিলাম- এই পথ দিয়ে গুলিবৃষ্টির মধ্যেই বেরুতে হবে। যার ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। আমাদের সবগুলো মেশিনগান এনে উত্তর ও দক্ষিণদিকে স্থাপন করলাম। নির্দেশ দিলাম মেশিনগানারদের, একসঙ্গে ফায়ার করে শত্রুকে বিপর্যস্ত করার জন্য। যাতে মাথা তুলে আমাদের নিশানা ঠিক করে ফায়ার করতে না পারে। তারপর ফায়ার অ্যান্ড মুভ পদ্ধতিতে ছোট ছোট গ্রুপে সৈনিকদের বেরিয়ে যাওয়ার আদেশ দিলাম।

গাছগাছালির আড়াল ও পরিখা থেকে বেরিয়ে ক্ষেতে নামামাত্রই শত্রুর মেশিনগানের ফায়ারের মধ্যে পড়ে আমাদের সৈনিকরা। আমাদের মেশিনগানগুলো প্রতিউত্তর দিয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে চৌগাছার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম বেরুনোর। আনোয়ার, সুবেদার মজিদসহ আমরা তিনজন আলাদাভাবে এগুতে লাগলাম।

আম বাগান থেকে বেরিয়ে মাঠে নামতেই বৃষ্টির মতো গুলির মধ্যে পড়লাম। মিনিট দশেকের মধ্যেই দৌড়ে গাছগাছালিতে ঢাকা গ্রামের মধ্যে ঢুকে গেলাম। সেখানে দেখলাম- অবিস্মরণীয় ঘটনা। গ্রামবাসী দা, খন্তা, বর্ষা, কুড়াল হাতে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে আমাদের বুকে জড়িয়ে ধরলো তারা। রাতে এক দরিদ্র কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় নিলাম আমরা জনা দশেক। রাতে শুয়ে আছি চোখে ঘুম নেই। জীবনের একটি স্মরণীয় দিন কেটে গেল। সারা দেশে কি হচ্ছে কিছুই জানি না।

ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অন্যান্য ব্যাটালিয়ন কি করছে তাও জানি না। তবে কি সারা দেশে আমিই একমাত্র বিদ্রোহী অফিসার। ভবিষ্যতের ভাগ্যে কি আছে কে জানে। জনসমর্থন কতদিন থাকবে সেনা দলের প্রতি? লে. আনোয়ার আসছে না কেন? নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মনে। বাইরে দুজন সেন্ট্রি ডিউটি করছে। ঘরের ভাঙা বেড়া দিয়ে আসছে শীতের বাতাস। চিন্তায় ডুবে আছি আমরা। এই বিদ্রোহের পরিণতি কি হবে শেষ পর্যন্ত।

৩১শে মার্চ সকাল হতেই মাছলিয়া বিওপিতে পৌঁছলাম। এখানেই একজন সাংবাদিক এসে জানালেন, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিভিন্ন ব্যাটালিয়নের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন।

সেখানে চা পানের পর হাবিলদার তাজুল এসে জানালো- দুঃসংবাদ। ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরুনোর সময় ক্ষেতের মাঝামাঝি এলে লে. আনোয়ারের কোমরে মেশিনগানের একটি বার্স্ট বিদ্ধ হয়। প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে সে শহীদ হয়। তাকে আমাদের সৈনিকরা বহন করে নিয়ে যায় হযরতপুর গ্রামে। সেখানে নজরুল ইসলাম কলেজের সামনে তাকে সমাহিত করা হয়। বিষাদে ছেয়ে গেল মন। রক্তেভেজা কোমরের বেল্টটা একজন তুলে দিলেন আমার হাতে। নীরবে আমার বেল্টটি খুলে শহীদ আনোয়ারের রক্তমাখা বেল্টটি পরে নিলাম।

এভাবেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল। প্রাথমিকভাবে চৌগাছা এলাকায় রক্ষণব্যূহ স্থাপন করি যশোরের দিকে মুখ করে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে চুয়াডাঙ্গায় দেখা হয় ইপিআরের বিদ্রোহী উইং কমান্ডার মেজর ওসমানের সঙ্গে। তার কাছ থেকে ট্যাংক বিধ্বংসী বিকোয়েলস রাইফেল, চাইনিজ অস্ত্রের অমুনিশন সংগ্রহ করি।

ইতিমধ্যে বিএসএফের ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লে. কর্নেল মেঘ সিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তাদের পরামর্শে আমার ব্যাটালিয়নকে বেনাপোল-যশোর সড়কের কাগজপুকুর এলাকায় শক্ত রক্ষণব্যূহ গড়ে তুলি। পুরো এপ্রিল মাস জুড়ে পাক বাহিনীর বেনাপোল দখলের মরিয়া হয়ে বারবার কামানের সাহায্য নিয়ে আমাদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়।

আমরা প্রতিটি আক্রমণ প্রতিহত করি এবং বেনাপোল এলাকায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা স্বমহিমায় উড্ডীন থাকে। ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরে বৈদ্যনাথতলায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে। ওই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল। সদ্য রিক্রুট করা ৬শ’ সৈনিককে প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য নিয়ে আসা হলো মেঘালয়ের তেলঢালায়।

আমাদের বেতার যন্ত্র, ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করা হলো। দেড় মাস ট্রেনিং লাভের পর এই তরুণ সৈনিকরা এক দুর্ধর্ষ সেনাদলে পরিণত হলো। এখানেই প্রথম, তৃতীয় ও অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সমন্বয়ে গঠিত হলো মুক্তিবাহিনীর প্রথম ব্রিগেড ‘জেডফোর্স’। মেজর জিয়া এই বাহিনীর প্রথম কমান্ডার নিযুক্ত হলেন। মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও সিলেটের বিভিন্ন রণাঙ্গনে জেডফোর্স সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে ইতিহাস সৃষ্টি করে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সর্বাধিক ‘সাহসিকতা পদক’ (বীরশ্রেষ্ঠসহ) অর্জন করে আমার অধীনস্থ প্রথম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ২৮শে নভেম্বর জকিগঞ্জের গৌরিপুরে পাক বাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব ব্যাটালিয়নের সঙ্গে আমাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি কোম্পানি কমান্ডার মেজর সরোয়ারসহ ৫০ জন সৈনিক নিহত হয়। ৩০ জন জীবিত অবস্থায় আমাদের হাতে বন্দি হয়। আমাদের পক্ষে আলফা কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন মাহবুবসহ ১৫ জন শহীদ হন।

এ যুদ্ধের পর সিলেট অঞ্চলে পাক বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ে এবং তারা সিলেটের দিকে দ্রুত পশ্চাৎপসারণ শুরু করে। যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মেজর জিয়া প্রথম ইস্ট বেঙ্গল ও দুটি এফএফ কোম্পানিসহ শত্রু বাহিনীকে এড়িয়ে চা বাগানের মধ্য দিয়ে সিলেট দখলের উদ্দেশে অগ্রসর হতে থাকেন। ১৪ই ডিসেম্বর সিলেটের এমসি কলেজ এলাকায় পাক বাহিনীর সঙ্গে আমাদের তুমুল যুদ্ধ হয়।

এ যুদ্ধে পাক বাহিনীর ৪০ জন নিহত হয়। আমার কোম্পানির সুবেদার ফয়েজ আহমদসহ ১৪ জন শহীদ হন। আমরাই সিলেট শহরে মিত্র বাহিনীর পূর্বে প্রবেশ করি এবং তুমুল যুদ্ধের পর সিলেট দখল করি। ১৭ই ডিসেম্বর ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার রানার নেতৃত্বে পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেশপ্রেমিক সাধারণ মানুষের যুদ্ধ, বাঙালির পরম গৌরব। ২৫শে মার্চের বর্বর গণহত্যার কারণে জাতি দিশাহারা হয়ে পড়ে। রাজনীতিকরা দেশত্যাগ করে নিরাপদ অশ্রয়ে চলে যান।

এহেন সময়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি অফিসার এবং সৈনিকবৃন্দ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে প্রতিরোধ সংগ্রামে লিপ্ত হন। এরাই হাজার হাজার তরুণকে সমরবিদ্যায় প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলে মুক্তি বাহিনী। এদের বীরত্ব, ত্যাগ, তিতিক্ষার কারণেই জাতি অর্জন করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র।

যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা সেদিন জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলাম সে গণতন্ত্র আজ নির্বাসিত। কারণ স্বাধীনতার পরপর যে রাজনৈতিক দলটি ক্ষমতায় আসে তারা মনে-মননে গণতন্ত্রকে ধারণ করেননি। রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল। সেকারণেই ক্ষমতায় আসার সাড়ে তিন বছরের মাথায় গণতন্ত্রকে হত্যা করে একদলীয় বাকশাল কায়েম করে।

আজও একই দল ক্ষমতায় আছে। সেজন্যই দেশ থেকে গণতন্ত্র বিতাড়িত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা আজ যারা বলছে তারা কেউই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি সুযোগ থাকা সত্ত্বে। এটি কেবল একটি দলকে ক্ষমতায় রাখার জন্য বাকসর্বস্ব বুলি হিসেবে আওড়ানো হচ্ছে। প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল দেশের সাধারণ মানুষ।

তাদেরও একটিই লক্ষ্য ছিল- গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার, সুশাসন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন। গণতন্ত্র না থাকলে এদেশে ধীরে ধীরে জঙ্গিবাদ বিস্তার লাভ করবে। সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবে রূপ লাভ করবে না। মুসলিম বিশ্বেও অনেক দেশে গণতন্ত্র না থাকায় জঙ্গিবাদের বিস্তার লাভ করেছে। সুতরাং বাংলাদেশেও এ ধরনের পরিস্থিতি হতে পারে।

আমরা যে স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম রাজনীতিবিদদের একটি অংশের দুঃশাসনের কারণে সেই স্বপ্ন আজ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। তবে বাঙালি বীরের জাতি। রাজপথে সংগ্রামের মাধ্যমেই এদেশে আবার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান, সাবেক মন্ত্রী।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!