ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বহু প্রতিক্ষার পর অবশেষে আজ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল। রাজধানীর রমনা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে দুই অধিবেশনে এ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে।
দীর্ঘ ছয় বছরে কয়েক দফা চেষ্টা করেও নানা প্রতিকূল অবস্থার কারণে কাউন্সিল করতে পারেনি দলটি। কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অপেক্ষাকৃত স্বাভাবিক হওয়ায় কাউন্সিলের প্রস্তুতি নিতে বেগ পেতে হয়নি বিএনপিকে।
কাউন্সিল উপলক্ষে বর্ণিল সাজে সাজানো হয়েছে রাজধানীর রমনা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণ।
নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও রংবেরঙের পোস্টারে ছেয়ে গেছে। সম্মেলনস্থলে মঞ্চ তৈরির কাজও সম্পন্ন। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট-সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একাংশও ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
সকাল ১০টায় কাউন্সিলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হবে। এতে বক্তব্য দেবেন বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেবেন তিনি। গণতন্ত্র সুসংহত করতে নতুন নির্বাচন দাবি করবেন খালেদা জিয়া। বিএনপির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা দেশনায়ক তারেক রহমান ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কাউন্সিলে অংশ নেবেন এবং মূল্যবান বক্তব্য রাখবেন বলে জানা গেছে।
দুপুরের বিরতির পর দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হবে বিকাল ৩টায়। তা দীর্ঘ রাত অবধিও গড়াতে পারে। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপস্থিতিতে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে দলের গঠনমূলক সমালোচনা হবে। খোলা মনে বক্তৃতা করার সুযোগ পাবেন কাউন্সিলররা। এবার কাউন্সিলের স্লোগান হচ্ছে ‘দুর্নীতি দুঃশাসন হবেই শেষ, গণতন্ত্রের বাংলাদেশ’।
প্রায় ৩ হাজার কাউন্সিলর এ রুদ্ধদ্বার বৈঠকে অংশ নেবেন। কাউন্সিল উপলক্ষে ডেলিগেট কার্ড ৫০ হাজারেরও বেশি বিতরণ করা হয়েছে।
কাউন্সিল ঘিরে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনের আশপাশে দেড় লাখ লোকের সমাগম ঘটবে বলে বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক নেতা জানিয়েছেন। আগত অতিথিদের দুপুরে পুরান ঢাকার ‘মোরগ পোলাও’ খাওয়ানো হবে বলে জানিয়েছেন আপ্যায়ন উপকমিটির আহ্বায়ক আবদুস সালাম।
এদিকে গতকাল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহ ও গয়েশ্বরচন্দ্র রায় সর্বশেষ কাউন্সিল স্থান পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা কাউন্সিলের সামগ্রিক প্রস্তুতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
জানা যায়, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, ভারতসহ কয়েকটি দেশের রাজনৈতিক নেতাকে কাউন্সিলে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
একজন ব্রিটিশ এমপিসহ কয়েকজন অতিথি এরই মধ্যে ঢাকায় এসে পৌঁছেছেন। কাউন্সিলে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদসহ দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
কাউন্সিল প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে বিএনপি আজ কাউন্সিল করতে যাচ্ছে।
চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ওয়ান-ইলেভেনের মতো কঠিন সময় শক্ত হাতে মোকাবিলা করেছেন। দল পরিচালনায় কিছুটা হোঁচট খেতে হয়েছে। কিন্তু বিএনপি থেমে যায়নি, ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আশা করি, কাউন্সিলের মাধ্যমেও বিএনপি আরও গতিশীল হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলের খসড়া গঠনতন্ত্র অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। দলের মহাসচিব কে হবেন, অতিরিক্ত মহাসচিব পদ সৃষ্টি হবে কিনা, তা স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হয়নি। স্থায়ী কমিটির বৈঠক চলাকালেও আমি সংবাদ সম্মেলনে এ ব্যাপারে পরিষ্কার বলেছি।’
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, ‘সারা দেশ থেকে কাউন্সিলর ও ডেলিগেটরা ইতিমধ্যে ঢাকায় পৌঁছেছেন। বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও ইউনিট থেকে আগত নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে ডেলিগেট ও কাউন্সিলর কার্ড সংগ্রহ করেছেন।’
চট্টগ্রাম থেকে ৫ শতাধিক ডেলিগেট ও কাউন্সিলর নিয়ে ঢাকায় পৌঁছেছেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন। স্থায়ী কমিটির বৈঠকসূত্র জানায়, এবারের কাউন্সিলে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির কলেবর বাড়ছে। ত্যাগী সব নেতাকে জায়গা করে দিতেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। ভাইস চেয়ারম্যানের সংখ্যা ১৫ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ জন করা হচ্ছে।
স্থায়ী কমিটির সদস্যসংখ্যা আগের মতোই থাকছে। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব ও কর্তব্য আগের মতোই থাকছে।
জানা যায়, ১১টি সাংগঠনিক বিভাগে একজন সম্পাদক ও দুজন সহসম্পাদকের পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। সাতজন আন্তর্জাতিক সম্পাদকের সঙ্গে একটি করে সহ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদ বাড়ানো হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ভিত্তিক ১৭টি উপকমিটিও গঠন করা হবে। এতে একজন সম্পাদক, একজন সহসম্পাদকসহ মোট ১২ জন সদস্য থাকবেন ওই কমিটিতে। তারা পদমর্যাদায় নির্বাহী কমিটির সদস্য হবেন।
৭৫টি সাংগঠনিক জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে নির্বাহী কমিটির সদস্যপদের মর্যাদা দেওয়ার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, বিএনপির নির্বাহী কমিটি ৩৮৬ থেকে বেড়ে ৫ শতাধিক হতে পারে। বৃহস্পতিবার রাতে ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র সংশোধন উপকমিটির বেশ কিছু প্রস্তাব দলের স্থায়ী কমিটি অনুমোদন দিয়েছে। আজ কাউন্সিলে তা পাস হলে গঠনতন্ত্রে যুক্ত হবে।
দলের নির্বাহী কমিটির সদস্যরা দলের জেলা নেতৃত্বের শীর্ষপদে থাকতে পারবেন না। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ছাড়াও বিএনপি উপদেষ্টা পরিষদ সৃষ্টি করা হয়েছে। দলের স্থায়ী কমিটি, যুগ্ম-মহাসচিব পদের সংখ্যা বৃদ্ধি, অতিরিক্ত মহাসচিব পদ সৃষ্টি, সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব পদ বিলুপ্তি, যুব মহিলা দল ও মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম দলকে বিএনপির অঙ্গসংগঠন করার প্রস্তাব এলেও তা অনুমোদন দেয়নি স্থায়ী কমিটি।
বিএনপির বর্তমান গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলটির বর্তমান জাতীয় নির্বাহী কমিটি ৩৫১ সদস্যের। এর বাইরে দলের চেয়ারপারসন চাইলে ৩৫১-এর ১০ শতাংশ বাড়াতে পারেন।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বলেন, বিএনপির কমিটির আকার কেমন হবে তা নির্ধারণের অধিকার কাউন্সিলরদের। অনুষ্ঠেয় জাতীয় কাউন্সিলে তারা এ সিদ্ধান্ত নেবেন।
তিনি বলেন, বিষয়ভিত্তিক উপকমিটি গঠনের বিষয়টি এখনো গঠনতন্ত্রে আছে। জিয়াউর রহমানের সময় এটি অনুসরণ করা হয়েছিল। পরে আর সেভাবে অনুসরণ করা হয়নি। কাউন্সিলে কমিটি ঘোষণার সম্ভাবনা ক্ষীণ : আজকের এ কাউন্সিলে নবনির্বাচিত চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নাম ঘোষণা করা হবে।
দ্বিতীয় অধিবেশনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব করার ঘোষণাও আসতে পারে। তবে স্থায়ী কমিটির কোনো কোনো সদস্য বলছেন, কাউন্সিলের কয়েক দিন পর স্থায়ী মহাসচিবের নাম ঘোষণা হবে। পূর্ণাঙ্গ নতুন কমিটি গঠন করতে এক মাসের বেশি লাগতে পারে। তবে সব কিছুই নির্ভর করছে খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্তের ওপর।
সংস্কারপন্থি সাবেক এমপিরাও আমন্ত্রিত : কাউন্সিলে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বিএনপির কথিত সংস্কারপন্থি সাবেক এমপিদেরও। কাউন্সিলের মাধ্যমে ওয়ান-ইলেভেনের বিভক্তির সঙ্গে চলমান বিভক্তিও দূর করতে চান বেগম খালেদা জিয়া। এ মুহূর্তে কাউকে বাদ দিয়ে নয়, সবাইকে সঙ্গে নিয়েই সামনে পথ চলতে চান তিনি।
দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নির্দেশক্রমে বিগত চারদলীয় জোট সরকার আমলের দলীয় সব সংসদ সদস্যকে কাউন্সিলে আমন্ত্রণও জানানো হয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাদের কাছে খালেদা জিয়ার বার্তা পৌঁছে দেন বলে জানা গেছে। হাতে গোনা দু-এক জন ছাড়া বাকিদের পরবর্তী কমিটিতে যোগ্যতা অনুযায়ী জায়গাও দেওয়া হবে।
আমন্ত্রণ পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন সাবেক এমপি জহির উদ্দিন স্বপন ও নজির হোসেন। তবে কাউন্সিলর বা ডেলিডেট কার্ড গতকাল পর্যন্ত পাননি বলেও জানান তারা।
স্যুভেনিরের মোড়ক উন্মোচন : কাউন্সিল উপলক্ষে গতকাল বিকালে স্যুভেনিরসহ ১১টি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। রাজধানীর পুরানা পল্টনে ‘আদর্শ ঢাকা আন্দোলন’-এর অফিসে তিনি এসব বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন।
এ সময় মির্জা আলমগীর বলেন, ‘ছিনিয়ে নেওয়া গণতন্ত্র এবং কেড়ে নেওয়া মানবাধিকার ফিরে পেতে আমাদের আন্দোলন চলবে।’
উন্মোচিত বইগুলো হলো— ‘শতাব্দীর শ্রেষ্ঠনায়ক জিয়াউর রহমান’, ‘যুগনায়ক জিয়া’, ‘দেশবাসীর প্রতি দেশনেত্রী’, ‘বেগম খালেদা জিয়া : বিএনপি ও বাংলাদেশ’, ‘তারেক রহমান এবং বাংলাদেশ’, ‘শোকার্ত স্বদেশ : আরাফাত রহমান কোকো’, ‘রাইট টু লাইফ : এ ফ্যার ক্রাই ইন বাংলাদেশ ২০০৯-২০১৬’, ‘ইরোসন অব ডেমোক্রেসি ইন বাংলাদেশ’, ‘এ ন্যাশনাল স্ট্রাটেজি টু কাউন্টার টেরোরিজম’, ‘সাদা চোখে পত্রিকার পাতা থেকে’ এবং ‘উন্নয়ন অর্জনে বিএনপি’।
এ বইগুলো কাউন্সিলরদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। এ ছাড়া তাদের একটি টি-শার্ট, ক্যাপ, কলম ও প্যাডসহ একটি চটের ব্যাগ দেওয়া হবে। এ সময় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের পাশে কাউন্সিলের প্রকাশনা উপকমিটির আহ্বায়ক ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ, কবি আবদুল হাই শিকদার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সোহরাওয়ার্দী পেয়ে বিএনপির সাধুবাদ : কাউন্সিলের জন্য রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন-সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একাংশ ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সাধুবাদ জানিয়েছে বিএনপি।
পাশাপাশি কাউন্সিল অনুষ্ঠানে সরকারের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছে দলটি। গতকাল নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সরকারকে সাধুবাদ জানান বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
এ সময় অন্যদের মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, সানাউল্লাহ মিয়া, আবদুল লতিফ জনি, আসাদুল করীম শাহিন, কাজী আবুল বাশার, শিরিন সুলতানা, আবুল কালাম আজাদ, মাসুদ অরুণ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।