DMCA.com Protection Status
title="৭

তনু হত্যাঃ কারা সেই ৩জন, যাদের পালাতে দেখেছিলেন তনুর বাবা ?

 

দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ প্রতিবেদনঃ সেই রাতে মেয়েকে খোঁজার সময় তিন ব্যক্তিকে দৌড়ে যেতে দেখেছিলেন সোহাগী জাহান তনুর বাবা, যাদের তিনি চেনেন না বলে জানিয়েছেন।

গত ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকার ভেতরে এই কলেজছাত্রীর লাশ পাওয়ার কিছুক্ষণ আগে ওই তিনজনকে দেখেন বলে সাংবাদিকদের জানান ইয়ার হোসেন। ভিক্টোরিয়া কলেজের ইতিহাসের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তনু থাকতেন ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের কর্মচারী বাবার সরকারি কোয়ার্টারে পরিবারের সঙ্গে।বাসার তিনশ গজ দূরে আরেকটি কোয়ার্টারে দুই স্কুলশিক্ষার্থীকে পড়াতে যেতেন তিনি।

২০ মার্চ সন্ধ্যায় ছাত্র পড়িয়ে ফেরার পথে খুন হন তিনি। খুনের আগে তাকে ধর্ষণ করা হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে।সেনানিবাসের মধ্যে এই কলেজছাত্রী হত্যাকাণ্ড নিয়ে সারাদেশে তোলপাড়ের মধ্যে বুধবার একদল সাংবাদিককে ঘটনাস্থল ঘুরে দেখায় সেনা কর্তৃপক্ষ। সেখানে তনুর বাবা ইয়ার হোসেনও ছিলেন। তিনি সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দেন।

আলোচিত এই ঘটনা নিয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরও দেন তিনি। ইয়ার হোসেন বলেন, তার মেয়ে দুটি টিউশনি করতে প্রতিদিন বিকাল ৫টার দিকে অলিপুর স্টাফ কোয়ার্টারে যেতেন, ফিরতেন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে। দুই কোয়ার্টারের মাঝের তিনশ গজ পথটি নির্জন বলে বাসা থেকে ৯০ গজ দূরের কালভার্টে গিয়ে প্রতিদিন তনুকে এগিয়ে আনতেন তার মা আনোয়ারা বেগম। তবে সেই সন্ধ্যায় মেয়েকে আনতে যাননি তিনি।

ইয়ার হোসেন বলেন, ২৬ মার্চ এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার আনতে যাওয়ার কথা ছিল তনুর। সেজন্য তনু মাকে বলেছিলেন, তিনি যেন দর্জির দোকানে গিয়ে মেয়ের জামাটি নিয়ে আসেন। রাত ১০টার দিকে বাসায় ফেরার পর ইয়ার হোসেন মেয়ে এখনও ফেরেনি শুনেই খুঁজতে বের হন। তার সঙ্গে ছিলেন এলাকারই এক স্কুলশিক্ষক।

ইয়ার হোসেন বলেন, “আমি আর সেকান্দার স্যার কালভার্ট পেরিয়ে অলিপুরের চারতলা স্টাফ কোয়ার্টারের কাছে চলে যাই। সেখানে একজনকে রাস্তায় হাঁটতে দেখে বলি, কোনো মেয়েকে দেখছেন। “ঠিক ওই সময় তিনজনকে অনেকটা দৌড়ি যেতে দেখি। ওই ব্যক্তির কাছে জানতে চাইলে সে বলে, এরা এখানকারই।” ওই তিন ব্যক্তির কথা যাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাকেও চেনেন না বলে সাংবাদিকদের জানান তনুর বাবা।

তনুকে যেখানে পাওয়া গিয়েছিল, সেই পথ পেরিয়েই অলিপুর স্টাফ কোয়ার্টারে গিয়েছিলেন ইয়ার হোসেন। তবে যাওয়ার পথে কিছু খেয়াল করেননি। মেয়েকে খুঁজে না পেয়ে মিলিটারি পুলিশকে তা জানিয়ে ওই পথে ফেরার সময় কালভার্টটির কাছেই তনুকে পাওয়ার কথা জানান ইয়ার হোসেন। সেকথা বলতে গিয়ে ভারী হয়ে আসে তার কণ্ঠ। “কালভার্টের পূর্বপাশে তনুর একটি স্যান্ডেল দেখতে পাই। এরপর পশ্চিমপাশে ঝোঁপের কাছে দেখি তার মোবাইল, একটু দূরে পাই ব্যাগ। আরও সামনে এগিয়ে দেখি তনুর পা দেখা যাচ্ছে।” “তনু চেয়ে ছিল, কিন্তু কিছুই বলতে পারছিল না। তার নাক থেতলানো ছিল, মাথার কিছু চুল ছিল কাটা।” মিলিটারি পুলিশের সহায়তায় তনুকে সিএমএইচে নেওয়ার পর মারা যায় তনু।

রাস্তায় কিছু বলেছে কি না- জানতে চাইলে ইয়ার হোসেন বলেন, “অচেতন ছিল, কোনো কথা বলতে পারেনি।” তনু হত্যার পরদিন ইয়ার হোসেন কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করেছেন অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে। থানা পুলিশের পর ডিবি তদন্তের দায়িত্ব নিলেও আটদিনেও শনাক্ত হয়নি কোনো খুনি। গ্রেপ্তারও হয়নি কেউ। সেনানিবাসের মতো স্পর্শকাতর স্থানে হত্যাকাণ্ড বলে তদন্ত বাধাগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে। তবে সেনা কর্তৃপক্ষ এই তদন্তে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে।

তনুর তার ফেইসবুক পাতায় একটি মোবাইল নম্বর থেকে তাকে উত্ত্যক্ত করার লিখেছিলেন কিছু দিন আগে। তবে সেই বিষয়েও কোনো অগ্রগতির কথা পুলিশ জানায়নি। কাউকে সন্দেহ হয় কি না- জানতে চাইলে তনুর মা আনোয়ার সাংবাদিকদের বলেন, “প্রায়ই তনুকে জিজ্ঞাসা করতাম, রাস্তা-ঘাটে কেউ ডিস্টার্ব করে কি না। ও ‘না’ বলত।”

ভিক্টোরিয়া কলেজ থিয়েটারে যুক্ত ছিলেন তনু। নানা সাংস্কৃতিক কার্যক্রমেও সম্পৃক্ত ছিলেন। তার মা বলেন, “তনু নানা অনুষ্ঠানে গান গাইত। বড় বড় স্যারেরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য নিয়ে যেত। বাসায় ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা আসত তার কাছে গান ও নাচ শিখতে।”ওই বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ইস্পাহানী পাবলিক স্কুল ও কলেজের অষ্টম শ্রেণির দুই ছাত্রীর কাছে তনুর বিষয়ে জানতে চাইলে দুজনই বলেন, “আপু অনেক ভাল ছিল। সবার সঙ্গে মিশত।”

দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত সেনানিবাসে ঘটনাস্থল ও তনুর পরিবারের সঙ্গে কথা বলার পুরোটা সময় স্টেশন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী শওকত আলম, কর্নেল সাজ্জাদ হোসেন, মাসুদুর রহমানসহ সেনা কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের সঙ্গে ছিলেন। ব্রিগেডিয়ার শওকত বলেন, “তনু আমাদেরই সন্তান। কষ্ট আমাদেরও হচ্ছে। “আপনারা (সাংবাদিক) যাকে তনু বলছেন, তাকে আমরা সোহাগী বলে জানতাম। সে আমাদের অনুষ্ঠানে যেত।

তার বাবা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের একজন বেসামরিক কর্মচারী। তিনি তো আমাদেরই সদস্য। সুতরাং আমরাও চাই, সঠিক তদন্ত শেষে অপরাধীরা ধরা পড়ুক।” তনু হত্যাকাণ্ডে সেনানিবাসের কেউ জড়িত কি না- সেই প্রশ্নের প্রেক্ষাপটে এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, “যেই জড়িত থাকুক, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।” তনু হত্যাকাণ্ডের তদন্তের দায়িত্ব এখন সিআইডির হাতে গেছে।

আদালতের নির্দেশে পুনরায় ময়নাতদন্তের জন্য বুধবার লাশ তোলা হয়েছে। খুনিদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের দাবিতে বুধবারও সারাদেশে নানা কর্মসূচি পালিত হয়। গণজাগরণ মঞ্চের ডাকে এক ঘণ্টা ধর্মঘট পালন করে সারাদেশের শিক্ষার্থীরা। এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বুধবার এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেছেন, “তনু হত্যার ঘটনার তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে প্রকৃত ঘটনা সবাই জানতে পারবে।”

সেনানিবাসের মতো এলাকায় তনু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দেশবাসীর মনে প্রশ্নের জন্ম দিলেও সামরিক কর্তৃপক্ষ বলছে, ঘটনাস্থল সংলগ্ন এলাকাটি সুরক্ষিত নয়। বাদিকদের ঘটনাস্থল দেখানোর সময় অরক্ষিত থাকার বিষয়টি তুলে ধরে বলা হয়, ওই এলাকায় স্থায়ী সীমানা প্রাচীর নির্মাণের কাজ চলছিল।তনুর বাসা থেকে বের হয়ে দক্ষিণে অলিপুরের পথ, ওই পথ ধরে একটু গেলেই বামপাশে পাহাড় এবং ডানে ঝোঁপঝাড়।

তিনশ গজ দূরে কোয়ার্টার, যেখানে তনু পড়াতে যেতেন। ওই পথের দুইশ গজের মধ্যে দুই পাশে শুধু ঝোঁপ-ঝাড়। পথে প্রতিটি বৈদ্যুতিক খুঁটিতে লাইট দেখা গেছে। তবে পথটি বেশ নির্জন। একপাশে পাহাড় রেখে অন্য পাশে (পশ্চিম পাশে) ৩০ গজের মধ্যে কুমিল্লা সেনানিবাসের সীমানা বেড়া (কাঁটাতারের)। তার ওপাশে বুধইর গ্রাম। সীমানা বেড়া থেকে তিনশ গজের মতো দূরে ওই গ্রামের ঘর-বাড়ি দেখা যায়।

কাঁটাতারের বেড়া ও ঘর-বাড়ির মাঝে ফসলি জমি। কোনো রাস্তা না থাকলেও কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে চলাচলের চিহ্ন হয়ে একটি মেঠোপথ নজরে আসে। একটি শিশুকে সেখানে সেনানিবাস এলাকার ভেতরে দেখে প্রশ্ন করে জানা যায়, বুধইর গ্রাম থেকেই সে এসেছে। কীভাবে এসেছ- জানতে চাইলে শিশুটি  বলে, তারের ফাঁক দিয়ে তাদের আসতে কোনো সমস্যা হয় না। সীমানা বেড়ার এই অবস্থার বিষয়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের স্টেশন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার কাজী শওকত বলেন, আগে কাঁটাতারের বেড়া ছিল সীমানায়। তা বাদ দিয়ে ৬ মাস ধরে স্থায়ী সীমানা করার কাজ চলছে।

১৫ কিলোমিটার সীমান্তের পশ্চিমাংশের প্রায় সাড়ে ৫ কিলোমিটারের বেশিরভাগ স্থানে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ শেষ হলেও তনুকে পাওয়ার স্থানটিতে এখনও হয়নি বলে জানান। ঘটনাস্থলের কাছেই সেনানিবাস এলাকার একটি ছোট্ট মাঠে একটি ছাউনী বানিয়ে কয়েকজন শ্রমিককে সীমানা তৈরির কাজ করতে দেখা যায়।

২০ দিন আগে এই ছাউনী করা হয় বলে জানান এক শ্রমিক। ছাউনীতে কেউ থাকে কি না-  প্রশ্নে ওই শ্রমিক বলেন, “রাতে আমরা কেউ থাকি না।”

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!