ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সরকার প্রাক্কলিত মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)এর ৭ ভাগেরও বেশী প্রবৃদ্ধি নিয়ে আবারও সংশয় প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক।
হাসিনা সরকারের দাবি, অর্থবছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ০৫ শতাংশ যা বাজেট ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও দশমিক ০৫ শতাংশ বেশি।
কিন্তু বিশ্বব্যাংকের বক্তব্য, বাংলাদেশের অর্থনীতির ৯টি সূচকের মধ্যে ৭টিই এখন নিম্মমুখী। এর মধ্যে রফতানি এবং ব্যক্তি খাতের ঋণপ্রবাহ ছাড়া বাকি সব সূচকেই গত বছরের চেয়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে। এ অবস্থায় জাতীয় প্রবৃদ্ধি কীভাবে বাড়বে তা পরিষ্কার নয়।
বিশ্বব্যাংকের মতে, প্রবৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ( বিবিএস)-এর হিসাব বাস্তবসম্মত নয়।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ‘চলতি অর্থবছরে নয়, আগামী ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৮ শতাংশ।’
গত শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিশ্বব্যাংক এসব সংশয় প্রকাশ করে।
সংবাদ সম্মেলনে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের বক্তব্য আপনারা বুঝে নিন। বুদ্ধিমানদের জন্য ইশারাই যথেষ্ট।’
তবে তিনি যুক্তি দিয়ে যথার্থই বুঝিয়ে দেন, সাধারণত প্রাথমিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে জিডিপি প্রাক্কলন করা হয়। এবার সব তথ্য আগে পাওয়ায় প্রাক্কলনের হিসাব দেয়া হয়েছে। যেসব তথ্যের ভিত্তিতে বিবিএস জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ০৫ শতাংশের হিসাব দিয়েছে, তার সঙ্গে প্রকৃত তথ্যের মিল নেই।
অন্যদিকে সরকার ঘোষিত প্রবৃদ্ধিই টেকসই নয়। কারণ ৭ দশমিক ০৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির মধ্যে দশমিক ০৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির কারণে। প্রতি বছর যেহেতু বেতন বাড়ার সম্ভাবনা নেই, তাই প্রবৃদ্ধির এই ধারা অব্যাহত থাকবে না। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশের চলতি অর্থবছরে (২০১৫-১৬) প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ।
তাতে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের দাবির ব্যবধান দশমিক সাড়ে ৭ শতাংশ। শতাংশের হিসাবে এ পার্থক্য সামান্য মনেহলেও আর্থিক অঙ্কে বিশাল।
বিশ্বব্যাংক তার এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার থেকে ছয় মাসে অর্থনৈতিক বিভিন্ন সূচক ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়েছে। রাজস্ব আহরণে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের গতিও ধীর। পাশাপাশি নিম্নমুখী ব্যক্তিখাতে ভোগ প্রবৃদ্ধি। এসবের প্রভাবেই চলতি ( ২০১৫-১৬) অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংক তার পূর্বাভাসে এটাও উল্লেখ করেছে যে, বর্তমানে তেলের সর্বনিম্ন মূল্য। এই অবস্থায় প্রবৃদ্ধি যা তা তুলনামূলকভাবে ধীরগতি। তাছাড়া তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণও কমতে শুরু হয়েছে। ফলে সামনে অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে।
তবে কেবল বিশ্বব্যাংক নয়, আন্তর্জাতিক সবগুলো সংস্থাই বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৭ শতাংশের নিচে রেখেছে। এছাড়া দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরাও মনে করেন, সরকার প্রবৃদ্ধির যে হিসাব দিচ্ছে তা স্বচ্ছ নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের মতে, প্রবৃদ্ধি নিয়ে সরকারের যে দাবি তা একেবারে অসম্ভব এবং অবাস্তব।
এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ অর্জনের কথা বলছে এটাও প্রশ্নবিদ্ধ। ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির জন্য মোট দেশজ উৎপাদনের ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ বিনিয়োগ দরকার। কিন্তু সরকারি হিসাবই বলছে, বিনিয়োগ হচ্ছে ২৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদও মনে করেন, সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে প্রাক্কলন দিয়েছে সেটি মাত্রাতিরিক্ত। সরকার ৭ দশমিক ০৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের দাবি করছে। কিন্তু সে অনুযায়ী দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন হয়নি। কর্মসংস্থান হয়েছে কম। বিনিয়োগ প্রত্যাশিত নয়। বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধিও সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন হার খুব কম।
কৃষিতেও আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি কমেছে। যুক্তিসঙ্গত কারণেই সরকারের পূর্বাভাস মাত্রাতিরিক্ত। মোটকথা- এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, ক্ষমতাসীন সরকার ৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের নামে তিলকে তাল বানিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চাইছে। এটাকে ধাপ্পাবাজি বা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা বললেও অতিরঞ্জিত হবে না।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতে, সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করছে। সম্প্রতি তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে মন্তব্য করেন, বিবিএস জাতীয় আয় ও প্রবৃদ্ধির ওপর ২০১৫-১৬ অর্থবছরের যে সাময়িক হিসাব প্রকাশ করেছে তা বিভ্রান্তিকর।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে এবারই দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি ৭ শতাংশের ঘরে যাবে। এ দাবি সঠিক নয়। সরকার পরিসংখ্যান ব্যুরোকে চাপ দিয়ে এ পরিসংখ্যান প্রস্তুত করেছে।
সরকারের এ দাবির সঙ্গে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ সকলেই দ্বিমত পোষণ করছে এবং সেটাই স্বাভাবিক। তিনি প্রসঙ্গত বিনিয়োগসহ অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের চিত্রও তুলে ধরেন এবং তুলনা করে দেখান সরকারের দাবি অবাস্তব।
কিন্তু পরিসংখ্যান নিয়ে এই ধরণের বিভ্রান্তি সৃষ্টি যেমন কারো কাম্য হতে পারে না, তেমনি রাজনৈতিক হীনস্বার্থে এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি সুস্থ মানসিকতারও পরিচয় নয়।