জাহিদ এফ সরদার সাদীঃ ওয়াশিংটন বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপ জানতে চাইবে, নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে আলোচনার জন্য মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল তিন দিনের সফরে আগামীকাল ঢাকা আসছেন।
এ সফরে সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রপন্থী দমনে ঢাকা-ওয়াশিংটনের মধ্যে সহযোগিতা বিষয়ে আলোচনা গুরুত্ব পাবে। নিরাপত্তা ইস্যুর বাইরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, মুক্তমতের চর্চায় বাধা, মার্কিন দূতাবাস কর্মকর্তা, শিক্ষক ও ব্লগার খুনসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করবেন নিশা দেশাই।
নিশা বিসওয়াল আগামীকাল বুধবার ঢাকায় এলেও সরকারের সঙ্গে তার আলোচনা হবে বৃহস্পতিবার।
সরকারের বাইরে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকের কথা রয়েছে। এছাড়াও, নিশা বিসওয়াল বাংলাদেশে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন।
এসব আলোচনার বেশিরভাগ অংশজুড়েই নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক ইস্যু প্রাধান্য পাবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। নিশা দেশাই বিসওয়ালের আসন্ন বাংলাদেশ সফরকে নানা কারণে সবাই খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে করছেন। যুক্তরাষ্ট্র সরকার জুলহাজসহ সাম্প্রতিক গুপ্তহত্যার ঘটনা তদন্তে সহায়তা দেয়ার ব্যাপারে আগ্রহ ব্যক্ত করেছে। এবার সেই আগ্রহের কথা সরকারকে সরাসরি জানানো হতে পারে বলে তারা ধারণা করছেন।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি, এখান থেকে উত্তরণের পথ কী হতে পারে সে বিষয়ে আলোচনা করতে পারেন। বিশেষ করে বাংলাদেশ সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছে সে সম্পর্কে জানাও এই সফরের অন্যতম লক্ষ্য বলে মনে করা হচ্ছে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, নিশা দেশাই ঢাকায় আসার আগে বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। সেখানে কাউন্টার টেররিজম বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদারের বিষয়ে আলোচনার জন্য নিশা দেশাইকে ঢাকায় পাঠানোর প্রস্তাব দেন তিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিশা দেশাইর ঢাকা সফরসূচি হিসেবে দুটি তারিখ প্রস্তাব করা হয়েছিল।
একটি ২ মে এবং অপরটি ৪ মে। শেষে দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আলোচনার ভিত্তিতে ৪ মে অর্থাৎ বুধবার তার ঢাকা সফরের দিন নির্ধারণ করে।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার মার্কিন কংগ্রেসের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির এক গুরুত্বপূর্ন শুনানীতে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরে ২য় সর্বোচ্চ ব্যক্তি, ডেপুটি সেক্রেটারী অব স্টেট এন্টনী ব্লিনকেন বলেন, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক হত্যাকান্ডের জন্য বাংলাদেশ সরকার বিরোধী দলকে দায়ী করলেও, এসব ঘটনার জন্য বিরোধী দল নয়, আল কায়দা কিংবা ডাস সংশ্লিস্ট জঙ্গীগোষ্ঠী গুলোই দায়ী,”।
জানা গেছে, নিশা দেশাইর ঢাকা সফর নিয়ে এরই মধ্যে সরকার ও বিরোধীপক্ষের ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। একের পর এক হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ব্যাখ্যা করবে বিরোধীপক্ষ । বিএনপি এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য সরকারের ব্যর্থতাকে দায়ী করে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরার উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন নিরাপত্তার পাশাপাশি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাই তার আলোচনায় প্রাধান্য পাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আবার অনেকেই মনে করছেন, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান রোধে মার্কিন সরকার ঢাকার সঙ্গে একাধিক প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। তারপরও একের পর এক হত্যার ঘটনা ঘটছে। এ অবস্থায় নিরাপত্তা ইস্যুতে সরকারকে চাপে রাখতেই নিশা দেশাই ঢাকা আসছেন। যদিও এই সফরকে দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কের অংশ হিসেবে মনে করেন শাসকদল আওয়ামী লীগ।
সূত্র জানায়, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ঘাটতি, মুক্তমতের চর্চায় বাধাসহ ঢাকার সঙ্গে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করবেন নিশা দেশাই। মুক্তমতের চর্চাকারীদের একের পর এক জঘন্যভাবে হত্যার বিষয়টি বৈঠকে বিশেষ গুরুত্ব পাবে। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে সরকারকে একাধিকবার বলেছে বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব আছে।
কিন্তু ঢাকা বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রের এই দাবি অস্বীকার করেছে। প্রথম থেকে জোরের সঙ্গে বলে আসছে যে বাংলাদেশে আইএসের কোনো অস্তিত্ব নেই। বাংলাদেশে উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদীদের হাতে একের পর এক ভিন্ন মতাবলম্বী হত্যার ঘটনায় তোলপাড় চলছে আন্তর্জাতিক মহলে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোও এসব হত্যাকাণ্ডের খবর ব্যাপক গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করছে। বাংলাদেশে এর আগে ঘটে যাওয়া এ ধরনের হত্যাকাণ্ড নিয়ে এত বেশি প্রতিক্রিয়া জানায়নি আন্তর্জাতিক মহল। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ উগ্রবাদীদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক উগ্রবাদী কোনো সংগঠনের যোগাযোগ আছে কিনা এ নিয়ে যখন পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সরকারের বাদানুবাদ চলছে, তখন ফের একই ধরনের ঘটনা সরকারকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
এ অবস্থায় বিসওয়ালের ঢাকা সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির এক শীর্ষ কূটনৈতিক বিএনপি চেয়ারপার্সনের সাবেক বৈদেশিক উপদেষ্টা ও বিএনপির বিশেষ দূত জাহিদ এফ সরদার সাদী বলেন, ‘নিশা দেশাইর এই সফর রুটিন ওয়ার্কের অংশ হলেও এবারকার সফর তাৎপর্যপূর্ণ। একের পর এক হত্যাকাণ্ডসহ নানা ঘটনায় মর্কিন সরকার উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে দেশে যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি শুরু হয়েছে তা নিয়ে তারা অনেক বেশি সোচ্চার। এসব কারণে এই সফর খুবই গুরুত্ব বহন করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কেউ ধাক্কা না দিলে আমরা সোজা হয়ে হাঁটতে পারি না। নিশা দেশাই সেই ধাক্কা দিতে আসছেন কি না তা সময়ই বলবে।’ সূত্র জানায়, এ অবস্থায় আগের হত্যাকাণ্ডগুলোর সুষ্ঠু বিচার না হওয়ায় পশ্চিমা দেশগুলোও এবার কঠোর অবস্থান নেয়ার কথা ভাবছে। বিশেষ করে ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, শিক্ষক, হিজড়া, সমকামী ও বিদেশী নাগরিকদের ওপর ধারাবাহিক আক্রমণের সঙ্গে জঙ্গিদের যোগসূত্র থাকার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চায় পশ্চিমা দেশগুলো।
বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে দেখা করে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট জুলহাজ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আইএসের অস্তিত্ব নিয়ে জোরালো অভিযোগ আনেন। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাষ্ট্রদূতের এই অভিযোগের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশে আইএসের কোনো অস্তিত্ব নেই। এর আগে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে আসেন মার্কিন এই সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিন দিনের ওই সফরে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াসহ বিভিন্ন পেশার নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সবার কাছ থেকে তখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চান। সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচনের তাগিদ দেন। কিন্তু তার উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়নি।
তবে ওই সফরকে ঘিরে তখন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। এরপর তিনি ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে আরও দু’দফায় ঢাকায় আসেন।
লেখকঃ বিএনপি চেয়ারপারসনের বৈদেশিক উপদেষ্টা এবং বিএনপির বিশেষ দূত।