ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে চট্টগ্রামের সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা বাঁশখালী ও আনোয়ারা। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে অবস্থিত সন্দ্বীপও। জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে গ্রামের পর গ্রাম। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফসলি ক্ষেত।
উড়িয়ে নিয়ে গেছে মানুষের বাড়িঘর। বাঁশখালী ও আনোয়ারায় বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ২ লাখ মানুষ। পানিবন্দিদের জন্য কোথাও কোথাও সরকারি ত্রাণ পাঠানো সহায়তা শুরু হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল।
বাঁশখালী : জোয়ারে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে বাড়ি-ঘরের দেয়াল ধসে ও পানিতে ডুবে শুধু বাঁশখালীতেই নয়জন শিশু, নারী-পুরুষের মৃত্যু হয়েছে। বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় দেড় লাখ মানুষ।
রোববার দুপুর ১২ টা পর্যন্ত বাঁশখালীর বিভিন্ন ইউনিয়নে ৯ জন নারী, শিশু ও বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে খানখানাবাদে মারা গেছেন, আবু ছিদ্দিক (৫০), রুবি আক্তার (৫০), জালাল উদ্দিন (৩) জান্নাতুল মাওয়া (৪), শাহেদা আক্তার (৩)। গণ্ডামারা ইউনিয়নে চরের পানিতে মাছ ধরতে গিয়ে মারা গেছেন নুরুল কাদের (৫৫) ও আবুল হোসেন (৪০) নামে দুই ভাই। ছনুয়া ইউনিয়নে দেওয়াল চাপা পড়ে মারা গেছেন মো. হারুনের স্ত্রী তাহেরা বেগম (৩৫)।
এছাড়া দেড় মাস বয়সী এক অজ্ঞাত শিশুর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। বাঁশখালীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শামশুজ্জামান সংবাদ২৪.নেটকে বলেন, ‘বেড়িবাঁধ ভেঙে গ্রামে প্রবেশ করা জোয়ারের পানি এখনো নেমে যায়নি। এতে ২৫ গ্রামের প্রায় দেড় লাখ মানুষ এখনো পানিবন্দী অবস্থায় মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্রয় কেন্দ্রে আসা মানুষদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ৫ হাজার পরিবারকে চিড়া, গুঁড়, দেয়াশলাই ও মোমবাতি দেয়া হয়েছে।’
খানখানাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু সিদ্দিক বলেন, বাঁশখালীর ৪১ হাজার পরিবার এখন পানিবন্দী অবস্থায় আছে। এর মধ্যে ২০ হাজার মানুষে ঘড়বাড়ি আংশিক ও ১০ হাজার ঘড়বাড়ি একেবারে ধ্বংস হয়েগেছে। ১১৯টি আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে অন্তত ১০ হাজার মানুষ।৪০ হাজার মানুষ গতকাল থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। অধিকাংশ মানুষই ত্রাণ বঞ্চিত হচ্ছেন।’ গণ্ডামারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আরিফুল্লাহ সংবাদ২৪.নেটকে বলেন, ‘বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপকূল জুরে প্রায় ৩১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। কিন্তু এ বেড়িবাঁধ অনেকাংশে নামকা ওয়াস্তেই আছে।
গতকাল বেড়িবাঁধের প্রায় ১৫ কিলোমিটার অংশ জোয়ারে ভেঙ্গে গেছে। এতে জোয়ারের পানিতে পুরো বাঁশখালী ডুবে আছে। চিংড়ি, মৎস্য পুকুর, ফসল, লবণ মাঠ মিলিয়ে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ ২০ কোটি টাকার বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।’
আনোয়ারা : ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাতে জ্বলোচ্ছাসে আনোয়ারা উপজেলার উপকূলীয় ২ ইউনিয়ন পানিতে তলিয়ে গেছে। ২ হাজার ঘর বাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে প্রায় ৪০ হাজার লোক পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। জলোচ্ছ্বাসের পানি ভাটার টানে কমলেও এখনও ভাসছে রায়পুর, জুইদন্ডি, বারশতের বিস্তীর্ণ এলাকা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আনোয়ারায় ১৪ হাজার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে পানি প্রবেশ করায় অনেকে বাড়ি ঘড়ে ফিরে যেতে পারছেনা। আবার অনেকে নিজ নিজ বাড়ি ঘড়ে আটকা পড়েছে। গ্রামের পর গ্রামজুড়ে অন্তত ছোটবড় ১০ হাজার গাছ ভেঙে পড়েছে। অন্তত ৩ হাজার ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে। জ্বলোচ্ছ্বাস ও তীব্রগতির ঝড়ো হাওয়ায় গ্রামের পর লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘যারা আশ্রয় কেন্দ্রে এসেছেন তাদের খাবার দেয়া হচ্ছে। শুকনো খাওয়ার বিতরণ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আরো সাহায়্যের ব্যবস্থা করা হবে।’
জুইদন্ডি ইউনিযনের চেয়ারম্যান মোরশেদুল আলম চৌধুরী খোকা বলেন, ‘ঝড়ের ইউনিয়নে পাঁচ শতাধিক বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। বেড়িবাঁধের উপর দিয়ে সাগরের পানি ঢুকছে। শনিবার সকালে ১০ ফুট জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে অনেক বাড়িঘর। ভাটায় পানি কমলেও বেড়িবাঁধের ভাঙনের কারণে আতংক বিরাজ করছে।
কারণ জোয়ার ও পূর্ণিমার জোর কারণে মধ্যরাতের জোয়ারে আবারও বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়ার আশংকা করা হচ্ছে। এই মুহূর্তে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোর জন্য শুকনো খাবার খুব বেশি প্রয়োজন।’ সন্দ্বীপ : সন্দ্বীপে প্রায় ১২ কিলোমিটার বেড়িবাধ ভেঙ্গেঁ জোয়ারের পানি ঢুকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
পানিবন্দী অবস্থায় আছেন অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ। জোয়ারের পনি ঢুকে প্রায় ১২শ মাছের প্রজেক্ট ভেসে গেছে। প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়ায় দ্বীপের প্রায় ১০ হাজার ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। রাস্তা-ঘাট, শত শত মৎস্য খামার, ফসলী জমিসহ ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ঘূর্ণিঝড়ের আতংক কেটে গেলেও উঁচু জোয়ারের আশঙ্কায় এখনও বিভিন্ন শেল্টারে প্রায় ১৮ হাজার মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে আছেন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উড়িরচর, দীর্ঘাপাড়ের অধিকাংশ স্থান ৫-৬ ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এছাড়া পৌরসভা, মগধরা, আমানউল্যা,কালাপানিয়া, রহমতপুর, সারিকাইত, হরিশপুরের নিম্নাঞ্চলসমূহ প্লাবিত হয়েছে। গাছুয়া, সন্তোষপুর, মাইটভাঙা, বাউরিয়া, হারামিয়া,মুছাপুরের সাগর তীরবর্তী এলাকাও প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। প্রবল জোয়ারের স্রোতে বেড়িবাঁধগুলো ছিঁড়ে বিভিন্ন বসত বাড়ি ও মৎস্য খামার ভেসে গেছে।
উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মাঈন উদ্দিন মিশন জানান, ঘূর্ণিঝড়ে কাছিয়াপাড় গ্রামে বেড়িবাঁধে অবস্থিত প্রায় শতাধিক বাড়ির ক্ষতি হয়েছে। রহমতপুর স্টীমার ঘাট এলাকায় বেড়িবাঁধ ছিঁড়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। মগধরা ষোলশহর এলাকার পূর্ব পাশে প্রায় আধা কিমি. বেড়িবাঁধ ছিঁড়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। এছাড়া তিনি বেড়িবাঁধের ৮-১০টি পয়েন্ট প্রায় ১০ কি.মি বেড়ীবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
চাহিদার তুলনায় সরকারি ত্রাণসামগ্রীর পরিমাণ নগণ্য হওয়ায় বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে।’ এদিকে উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, দ্বীপের প্রায় ৩৫০টি মৎস্য খামারের আনুমানিক ১২ কোটি টাকার মাছ জোয়ারের পানিতে মিশে গেছে। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, সৃষ্ট জোয়ারে ৩২৭০ হেক্টর জমির প্রায় ২ কোটি ৮৬ লক্ষ টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
স্বাভাবিক হচ্ছে বন্দরনগরী: ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাব কাটিয়ে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে বন্দরনগরীর জীবনযাত্রা। শুরু হয়েছে শাহ আমানত বিমানবন্দর ও চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম। ভোরে চট্টগ্রাম বন্দরে প্রবেশ করে ৪টি কনটেইনারবাহী জাহাজ।
বন্দর নগরীর অধিকাংশ এলাকায় ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগ পুনঃস্থাপন করা হয়েছে। রোববার সকালে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকায় ভেঙে পড়া ৬'শ দোকান সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা।
দোকান মালিক সমিতির দাবি, এতে ১০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে তাদের। এ অবস্থায় সরকারি সহায়তার দাবি ব্যবসায়ীদের। ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রাম নগরীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পতেঙ্গা এলাকায়। তাতে বড় ক্ষতিটি হয়েছে, শাহ আমানত বিমানবন্দরের রক্ষাকবচ হিসেবে নির্মিত, নেভাল বিচ সড়কে।
ঢেউয়ের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, পুরো সড়ক। যা আতংকিত কোরে তুলেছে স্থানীয়দের।
কেননা, আবারও এমন দুর্যোগ এলে, জলোচ্ছ্বাসের পানি ঢুকে পড়তে পারে লোকালয়ে। প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি একদিকে দুর্যোগ থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দরের রক্ষাকবচ। আরেকদিকে নগরীর অন্যতম বিনোদন স্পট। যেখানে প্রতিদিন বেড়াতে যায় হাজার হাজার মানুষ।
তাছাড়া প্রস্তাবিত দেশের একমাত্র টানেলের সংযোগস্থলও এটি। ফলে সড়কটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আতংকে স্থানীয়রা। বেড়িবাঁধ হিসেবে ব্যবহার ছাড়াও পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে যাতায়তের জন্য কর্ণফুলি নদীর তীরে দেড় দশক আগে নির্মাণ করা হয় এই সড়কটি।