ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ দুটি জিনিস বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গড়ে দেবে। প্রথমটি হলো, একদলীয় কর্তৃত্ববাদের দিকে দেশটির ঝুঁকে পড়া। দ্বিতীয়টি হলো, চরমপন্থি হামলার দরুন সৃষ্টি হওয়া ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতা।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শীর্ষ বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থা স্ট্র্যাটফোরের একটি বিশ্লেষণীতে এসব বলা হয়েছে।
৩১শে মে প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিশ্লেষণী নিবন্ধটির শিরোনাম ‘বাংলাদেশ’স ডিসেন্ট ইনটু অথরিটেরিয়ানিজম’।
কর্তৃত্ববাদের প্রসঙ্গে নিবন্ধটিতে বলা হয়েছে, মধ্য-বামপন্থি আওয়ামী লীগের প্রধান ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিক ও মধ্য-ডানপন্থি বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়াকে একঘরে করতে চারটি কৌশল অবলম্বন করেছেন।
প্রথমত, ২০১৩ সালে হাসিনা প্রশাসনের অধীনে সুপ্রিম কোর্ট দেশের বৃহত্তম ধর্মীয় দল ও বিএনপির অন্যতম মিত্রদল জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনে নিষিদ্ধ করে। এ নির্দেশের ভিত্তি ছিল যে দলটির চার্টার ছিল অবৈধ। নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে সংঘাত সৃষ্টি হয়, যাতে নিহত হয় ১৫০ জন মানুষ। যদিও জামায়াতে ইসলামী সংসদীয় কোনো বড় দল নয়, তবে তাদের তৃণমূলে সাংগঠনিক সক্ষমতার সাহায্যে বিএনপি তাদের ভোটার টানতে পেরেছে।
দ্বিতীয়ত, নির্বাচনী ইশতিহার অনুযায়ী একটি প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন করেছেন হাসিনা। তিনি আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের বিচার করার দায় পড়ে এ ট্রাইব্যুনালের ওপর। এ যুদ্ধে ৩ থেকে ৩০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
তখন জামায়াতে ইসলামী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের পৃথক হওয়ার বিরোধিতা করেছিল। দলটির তৎকালীন নেতা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে তিনি যুদ্ধের সময় আল বদর নামে জাতীয়তাবাদ-বিরোধী মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করেন। এ বাহিনী বহু মানুষ হত্যার জন্য দায়ী।
২০১৩ সাল থেকে, জামায়াতে ইসলামীর চার নেতাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে হাসিনা জামায়াতে ইসলামীকে দুর্বল করে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি এমন একটি ইস্যু ব্যবহার করেছেন যা বাংলাদেশি জাতীয় চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
পাশাপাশি, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনের একক মশালবাহক হিসেবে তার দলের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছেন হাসিনা। অবশ্য যুদ্ধাপরাধের ইস্যু মোকাবিলায় দেশে জনসমর্থন থাকলেও, বিচার প্রক্রিয়া পক্ষপাতদুষ্ট বলে সমালোচনাও হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সরকারপক্ষ যেখানে অসংখ্য সাক্ষী হাজির করতে পারে, সেখানে বিবাদী পক্ষ মাত্র ৪ জন সাক্ষী হাজির করতে পারে।
তৃতীয়ত, ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচন বিএনপির বয়কট করার সিদ্ধান্তের ফায়দা হাসিল করেছেন হাসিনা। তাতে আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত হয়, যদিও দেশের ইতিহাসে এ নির্বাচনের ভোটার অংশগ্রহণ ছিল সবচেয়ে কম। হাসিনার মহাজোট বর্তমানে ৩০০ আসন বিশিষ্ট সংসদের ২৮০টি দখল করে আছে। ফলে আইনসভার ওপর নিরঙ্কুশ আধিপত্য আছে তার।
এ ছাড়াও জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্বভিত্তিক আসন বিন্যাসের ফলে সংসদে ঢাকার প্রতিনিধিত্ব রয়েছে সবচেয়ে বেশি। ফলে ঢাকার শহুরে স্বার্থ গ্রামীণ স্বার্থকে ছাপিয়ে যায়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অসমতা বৃদ্ধি পায়। গ্রামগুলোতে সুশাসনহীনতা রয়েছে। এখানে আছে বেসরকারি সংস্থা, বেসরকারি খাত ও ধর্মীয় সংগঠনগুলো, যেগুলোর কিছু চরমপন্থি ভাবধারা লালন করে।
চতুর্থত, হাসিনার সরকার বিএনপির উচ্চপদস্থ সদস্য ও গণমাধ্যমে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছে। জানুয়ারিতে, বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছে, কারণ তিনি ১৯৭১ সালের যুদ্ধে নিহতদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।
এরপর ১১ই মে, খালেদা ও বিএনপির ২৭ সদস্যের বিরুদ্ধে গত বছর দুইটি বাসে অগ্নিসংযোগের অভিযোগ গঠন করা হয়। অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধেও বিচার চলছে। দেশের সবচেয়ে বড় ইংরেজি ভাষার পত্রিকা ডেইলি স্টারের সমপাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে ৭৯টি পৃথক মামলা করা হয়েছে।
এর মধ্যে ১৭টি রাষ্ট্রদ্রোহের, ৬৯টি মানহানির। প্রথম আলোর সমপাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে ফেব্রুয়ারিতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দানের অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়।
খালেদা জিয়াকে নিষ্ক্রিয় করার ফলে বিএনপির রক্ষণশীল আসনগুলোতে দলটির আর কোনো প্রতিনিধিত্ব রইলো না। হাসিনা এ আসনগুলো করায়ত্তে নিতে চান। এ কারণে তিনি কিছুটা রক্ষণশীল অবস্থান নেবেন, বিশেষ করে ধর্মীয় ইস্যুতে।
এ কারণেই বোঝা যায় তিনি কেন সম্প্রতি বলেছেন যে, মানুষের উচিত অন্যের ধর্মীয় বিশ্বাসকে সম্মান করা। এ কথাগুলো তিনি বলেছেন, ইসলামের সমালোচনাকারী ব্লগারদের প্রতিক্রিয়ায়। এ কারণেই বোঝা যায় সমপ্রতি সুপ্রিম কোর্ট ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মের স্থান থেকে সরানোর চেষ্টা নিলেও, হাসিনা কেন চুপ ছিলেন।
অবশ্য আদালত পরে এ অবস্থান থেকে সরে আসে এ যুক্তিতে যে, পিটিশনাররা প্রমাণ করতে পারেননি ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় তাদের কোনো ক্ষতি হয়েছে।
হাসিনা এ রাজনৈতিক হিসাব কষেছেন যে, যদি তিনি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ ধরে রেখে নতুন চাকরি সৃষ্টি, দারিদ্র্য দূরীকরণ, স্বাস্থ্যসেবা বৃদ্ধি করতে পারেন, তাহলে জনগণ একদলীয় শাসনের দিকে দৃষ্টিপাত করবে না এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করবে। জনরোষ সত্ত্বেও, এ জায়গায় তিনি সফল।