ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক জোট সার্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠেছে, তখন আরেকটি আঞ্চলিক জোট ‘বিমস্টেক’ কি তার জায়গা নিতে চাইছে? এ প্রশ্ন উঠেছে ‘বিমস্টেক’ আঞ্চলিক জোটকে চাঙ্গা করার এক নতুন উদ্যোগকে ঘিরে।শনিবার থেকে ভারতের গোয়ায় শুরু হতে যাচ্ছে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন তথা বিমস্টেক আউটরিচ।
ব্রাজিল-রাশিয়া-ভারত-চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার ব্রিকস জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গেই সম্মেলনের আয়োজক দেশ ভারত এবার সেখানে আমন্ত্রণ জানিয়েছে বিমস্টেক দেশগুলোকেও – যাতে যোগ দিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও গোয়াতে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি ইসলামাবাদে সার্ক সম্মেলন বয়কটের মধ্যে দিয়ে ওই জোটের ভবিষ্যৎ যখন প্রশ্নবিদ্ধ, তখন দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম বিমস্টেককে ঘিরে কিন্তু সদস্য দেশগুলোর মধ্যে নতুন উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে। তাহলে বিমস্টেকই কি হতে চলেছে পাকিস্তানকে বাইরে রেখে এক নতুন সার্ক?
বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে থাকা বা বাণিজ্যের জন্য তার ওপর নির্ভরশীল, এমন সাতটি দেশ বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা আর নেপাল-ভুটান বিমস্টেকের সদস্য – আর এই সব দেশের প্রধান নেতারা সবাই আসছেন গোয়ার সমুদ্রতটে।
নেপাল-ভুটান ছাড়া বাকি পাঁচটি দেশ মিলে উনিশ বছর আগে যখন বিমস্টেকের সূচনা করেছিলেন, তার পর থেকে এই জোট এতটা গুরুত্ব আগে কখনও পায়নি। তা ছাড়া সার্ককে ঘিরে সাম্প্রতিক অনিশ্চয়তাও আঞ্চলিক কূটনীতির সমীকরণগুলো অনেক বদলে দিয়েছে, যার ফলে লাভবান হচ্ছে বিমস্টেক।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি (ইস্ট) প্রীতি শরণের কথায়, ভারত বিমস্টেককে তাদের অ্যাক্ট ইস্ট নীতি রূপায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে দেখে। আগাম বছর কুড়ি বছর পূর্ণ করবে এই জোট, সেখানে নতুন প্রাণ সঞ্চার করার এটাই তো সময়। সবচেয়ে বড় কথা, এই জোটের সদস্যদের মধ্যে কোনও বড় ইস্যু নেই, তাদের সবার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক দারুণ – সেটা একটা অত্যন্ত ইতিবাচক ব্যাপার।
বিমস্টেকের সূচনা যে চার রাষ্ট্রপ্রধানের হাত ধরে, তাদের মধ্যে একমাত্র শেখ হাসিনাই এখনও সক্রিয় রাজনীতিতে আছেন।তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশও কি তাহলে এখন সার্কেকে পেছনে ফেলে বিমস্টেকে বেশি গুরুত্ব আরোপ করতে চলেছে?
দিল্লিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সৈযদ মোয়াজ্জেম আলি বিবিসিকে এ প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘না, দেখুন, বিমস্টেক আর সার্কের লক্ষ্য ভিন্ন। সার্কের উদ্যোক্তা হিসেবে আমাদের লক্ষ্য ছিল, যদি আমরা অর্থনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে অগ্রগতি করতে পারি, সেটা আমাদের মধ্যকার রাজনৈতিক মতপার্থক্য কমিয়ে আনার একটা উপযোগী পরিবেশ তৈরি করবে।”
কিন্তু সার্ক যে ভারত-পাকিস্তানের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ছায়া থেকে বেরোতে পারেনি সেটা সবারই জানা। ফলে ভারত নিজেও এখন তার পশ্চিম সীমান্ত থেকে চোখ সরাতে চায় পূর্বে বিমস্টেকের দিকে, যেখানে প্রবৃদ্ধি ও অগ্রগতির হাতছানি অনেক বেশি!
শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় কূটনীতিক প্রীতি শরণের কথায়, যৌথভাবে এই অঞ্চলটি প্রতি বছর সাড়ে ছয় শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি করছে, দেড়শো কোটিরও বেশি মানুষ বা সারা পৃথিবীর জনসংখ্যার ২২ শতাংশ এখানে থাকেন, এই অঞ্চলের মোট জিডিপি ২.৭ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি। ফলে এই জোটকে সফল করার জন্য সদস্য দেশগুলোর আগ্রহ কেন, তা বোঝা কঠিন নয়। আর পাশাপাশি সার্কে অগ্রগতি কেন হয়নি, সেটা তো আমরা সবাই জানি। বিমস্টেককে নিয়ে নতুন উদ্দীপনার শরিক হলেও সার্ক ভাবনার জন্মদাতা যে বাংলাদেশ, তারা কিন্তু এখনই সার্কের মৃত্যু ঘোষণা করতে রাজি নয়।
হাইকমিশনার সৈযদ মোয়াজ্জেম আলি বললেন, ” সার্কের গুরুত্ব মোটেই কমেনি। আমরা আমাদের বিবৃতিতে তখন জানিয়েছিলাম, পাকিস্তান আমাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছেন। আর ভারত যেখানে অলরেডি জানিয়েছে যে তারা যাচ্ছে না, সেখানে এই পরিস্থিতিতে সার্ক সম্মেলনে পেছানো প্রয়োজন। ভবিষ্যতে যখন সব ঠিক হয়ে যাবে তখন আবার আমরা সার্ক সম্মেলন করবো। এর আগেও সার্ক সম্মেলন দশবার স্থগিত হয়েছে। এবারই প্রথম নয়। কাজেই আমরা আশাবাদী।”
সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অচিরেই আবার হোক বা না-হোক – গোয়াতে আরব সাগরের তীরে এসে বঙ্গোপসাগর-কেন্দ্রিক সাতটি দেশের নেতারা বিমস্টেকে যে নতুন গতির সঞ্চার করতে চলেছেন তা এই জোটের ইতিহাসে নজিরবিহীন। কিন্তু তাতে বিমস্টেক সার্কের অনেক শক্তিশালী বিকল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে কি না, সেটা জানার জন্য আরও কিছুটা অপেক্ষা করতেই হবে।