ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ দুঃখ জনক হলেও সত্য যে চুরি ঠেকাতে, মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বিদেশী বন্ধুদের দেওয়া 'বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা' ক্রেস্ট তৈরিতে স্বর্ণের পরিবর্তে এখন থেকে রুপা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাসিনা সরকার।
২০১৪ সালে বিদেশি বন্ধুদের দেওয়া ক্রেস্ট তৈরিতে স্বর্ণের ব্যবহার নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আগে স্বর্ণ ও রুপার সমন্বয়ে ক্রেস্ট তৈরি করা হতো, যার মূল উপাদান থাকত স্বর্ণ। তবে এখন থেকে মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা দেওয়া ক্রেস্টের মূল উপাদান থাকবে রুপা। একই সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে এসব ক্রেস্ট তৈরি করা হবে।
পরমাণু শক্তি কমিশনে একাধিক পরীক্ষার মাধ্যমে ক্রেস্টের উপাদান ও মান নিশ্চিত করা হবে। এ ছাড়া ক্রেস্টগুলো পরীক্ষার প্রক্রিয়া তদারকির দায়িত্বে থাকবেন মুখ্য সচিবসহ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, 'আগে ক্রেস্ট তৈরিতে কী হয়েছে, সে আলোচনায় যেতে চাই না। আমরা সামনে এগোতে চাই।
তাছাড়া বিষয়টি আদালতেও বিচারাধীন। তবে অনিয়ম হয়েছে, এটা সত্য। এ কারণেই ক্রেস্ট তৈরির পুরো বিষয়টি ঢেলে সাজানো হয়েছে। আমরা এবার চিত্রশিল্পী হাশেম খানের নেতৃত্বে ক্রেস্টের নতুন নকশা তৈরি করেছি। এই ক্রেস্ট এখন থেকে রুপা দিয়েই তৈরি হবে।'
মন্ত্রী আরও বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এ সরকারই ২০১১ সালে প্রথম বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা দেওয়া শুরু করেছে।
ইতিমধ্যে তিনশ'র বেশি বন্ধুকে এই সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। আবারও এই প্রক্রিয়া শুরু হবে। তবে এবার থেকে যাতে আর কোনো রকম অনিয়ম না হয়, সে জন্য ক্রেস্ট তৈরির প্রক্রিয়ায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সংশ্লিষ্টরা তদারকির দায়িত্বে থাকবেন।'
মন্ত্রী জানান, ক্রেস্টের পাশাপাশি সম্মানিত ব্যক্তিকে অর্থাৎ বিদেশি ওই বন্ধুকে তিন ভাষায় লেখা সনদ প্রদান করা হবে। যার একটি হবে বাংলা, ইংরেজি ও তার নিজ ভাষায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার ৪০ বছর পর সর্বপ্রথম বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা জানানোর প্রথম পর্যায়ে ২০১১ সালের ২৫ জুলাই ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সর্বোচ্চ সম্মাননা 'স্বাধীনতা সম্মাননা' দেওয়া হয়।
ইন্দিরার হয়ে তার পুত্রবধূ কংগ্রেস সভাপতি সোনিয়া গান্ধী সম্মাননা স্মারক গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় পর্বে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা ৮৩ জন বিদেশিকে ২০১২ সালের মার্চে 'মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা' ও 'মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা' এবং একই বছরের অক্টোবরে ৬১ জনকে 'মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা' দেওয়া হয়েছিল। এসব সম্মাননা ক্রেস্টে ৩০ ভরি জার্মান সিলভারের (রুপা) তৈরি জাতীয় স্মৃতিসৌধের নকশার ওপর ২২ ক্যারেটের ১৪ গ্রাম সোনার কোট এবং লোগো, লক ও কবজায় ৮ দশমিক ৫ গ্রাম সোনার কোটসহ ২২ দশমিক ৫ গ্রাম সোনা ব্যবহার করা হয়।
তবে ২০১৪ সালে গণমাধ্যমে সম্মাননা ক্রেস্টে স্বর্ণ ও রূপা কম দেওয়ার অভিযোগ ওঠার পর থেকে 'বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা' প্রদান স্থগিত করে সরকার। অবশ্য এর মধ্যে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি ও কানাডার প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডোকে পৃথক সম্মাননা ক্রেস্ট দেওয়া হয়েছে। ওই ক্রেস্টে ১৯৪ দশমিক ৭৬ গ্রাম ওজনের ২১ ক্যারেট মানের সোনা ব্যবহার করা হয়।
এ পর্যন্ত সাত পর্বে বাংলাদেশের অকৃত্রিম ৩৪০ মুক্তিযুদ্ধ বন্ধুকে (ব্যক্তিত্ব ও সংগঠন) এই সম্মাননা দিয়েছে সরকার। বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা ও মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা- এই তিন ধরনের সম্মাননা ক্রেস্ট বিদেশি বন্ধুদের দেওয়া হয়েছে।
নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতিটি ক্রেস্টে সর্বনিম্ন এক ভরি (১৬ আনা) স্বর্ণ ও ৩ ভরি রুপা থাকার কথা। একাধিক পরীক্ষায় দেখা গেছে, কোনো কোনো ক্রেস্টে স্বর্ণ বা রূপার অস্তিত্বই ছিল না।
বরং সেখানে পিতল, তামা ও দস্তা ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্রেস্ট রাখার বক্স তৈরির জন্য ওক গাছের কাঠ ব্যবহারের কথা বলা হলেও তা হয়নি। বিএসটিআইর পরীক্ষায়ও এ জালিয়াতি ধরা পড়েছে।
এ ঘটনায় ২০১৪ সালের ১০ জুন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকেও একটি মামলা করা হয়েছে। বর্তমানে ঢাকার একটি আদালতে মামলাটি বিচারাধীন।