ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ হাঙ্গেরী গামী শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানের ইঞ্জিনে অয়েল (লুব্রিকেন্ট) সিস্টেমের একটি নাট-বোল্ট অর্ধেক খোলা ছিল। ওই ঢিলা অংশ দিয়ে ইঞ্জিন থেকে লুব্রিকেন্ট বেরিয়ে যায়। এতে ওই ইঞ্জিনে জিরো হয়ে যায় অয়েল। যার কারণে বাধ্য হয়ে ফ্লাইটটির গতিপথ পরিবর্তন করে তুর্কমেনিস্তানের আসগাবাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করতে হয়। বিমানের ওই ফ্লাইটের (বিজি-১০১১) মেনটেনেন্স লগ বই থেকে এই তথ্য জানা গেছে।
নিয়ম অনুযায়ী কোনো এয়ারক্রাফটে যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়লে তা মেনটেনেন্স লগ বইতে এন্ট্রি করতে হয়। লগ বইতে আরও বলা হয়েছে, নাট-বোল্টটি টাইট দেয়ার পর লুব্রিকেন্ট পড়া বন্ধ হয়ে যায়। এরপর নতুন করে লুব্রিকেন্ট ভরে এয়ারক্রাফটটি সচল করা হয়। এ ঘটনায় সোমবার বিমান, সিভিল এভিয়েশন ও মন্ত্রণালয় থেকে পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
বিমানের চিফ অব টেকনিক্যাল ক্যাপ্টেন ফজল মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ৪ সদস্যের কমিটির অপর সদস্যরা হলেন- চিফ অব ফ্লাইট সেফটি ক্যাপ্টেন সোয়েব চৌধুরী, ডেপুটি চিফ অব ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হানিফ ও ম্যানেজার (কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স) নিরঞ্জন রায়।
অপরদিকে সিভিল এভিয়েশনের ফ্লাইট অপারেশন ইন্সপেক্টর (এফওআই) ক্যাপ্টেন ফরিদুজ্জামানকে প্রধান করে ৩ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- সাইফুল হক শাহ ও আনন্দ মণ্ডল। এছাড়া বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও পর্যটন) স্বপন কুমার সরকারকে প্রধান করে ৩ সদস্যবিশিষ্ট অপর একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ ঘটনায় মন্ত্রণালয় থেকে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে বিমানের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান পরিচালক (প্রকৌশল) উইং কমান্ডার (অব.) আসাদুজ্জামানকে সাময়িক বহিষ্কারের নির্দেশ দিলেও বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক আহম্মেদ বলেছেন, এখনও কাউকে বহিষ্কার করা হয়নি। তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমানের একটি ইঞ্জিনে ‘জ্বালানির চাপ কমে যাওয়ায়’ ফ্লাইটটিকে জরুরি অবতরণ করাতে হয়েছিল। ওই ঘটনার জন্য কারও অবহেলা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি সাংবাদিকদের সামনেই বিমানের এক কর্মকর্তাকে ফোন করে ভিভিআইপি ফ্লাইট পরিচালনায় বিমানের ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার পরিচালককে সাময়িক বরখাস্তের নির্দেশ দেন। বিমান বহরে ‘রাঙা প্রভাত’ নাম পাওয়া বোয়িং উড়োজাহাজটিতে প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীসহ ৯৯ জন যাত্রী এবং ২৯ জন ক্রু ছিলেন।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বিমানমন্ত্রী মেনন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরের জন্য পৃথক বিমান ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে বলে জানান।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিমানের বাঁ দিকের ইঞ্জিনের ‘ইঞ্জিন অয়েল’ কমে যাওয়ায় ওই ঘটনা ঘটে। পাইলটরা বেশ কিছুক্ষণ আগে বিষয়টি ধরতে পারেন। ককপিটের মনিটরে তা ইনডিকেট করছিল। তখনই তারা বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের জানান। ওই সময় বিমান ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩০ হাজার ফুট ওপরে ছিল। ওই সময় বাম ইঞ্জিনের ক্ষমতা কমতে শুরু করে। তুর্কমেনিস্তানে অবতরণের ১২ থেকে ১৫ মিনিট আগে সেটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
ওই কর্মকর্তা বলেন, তিনি শুনেছেন কেবল কয়েকটা নাট-বোল্ট টাইট দেয়াতেই সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। এরপর প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে উড়োজাহাজটি পুনরায় ফ্লাই করার আগে দুবার ইঞ্জিনের ট্রায়াল দেয়া হয়।
এদিকে বিমানের পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ফিরতি ফ্লাইটের প্রধান পাইলট নিয়েও তোপের মুখে পড়েছে বিমান প্রশাসন। অভিযোগ আছে এই দুই পাইলটই বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর এয়ারক্রাফটের (যে বিমানে প্রধানমন্ত্রী গেছেন) ট্রেনিংয়ে ফেল করেছিলেন। দ্বিতীয় দফায় বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা ও শর্ত শিথিল করে তাদের পাস করানো হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক এভিয়েশন আইন অনুযায়ী এ ধরনের ফেল করা পাইলটরা যে কোনো ভিভিআইপি ফ্লাইট পরিচালনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। অভিযোগ আছে, বিমানের যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে সে তদন্ত কমিটির প্রধান ক্যাপ্টেন ফজল মাহমুদ চৌধুরীও এই এয়ারক্রাফটের ট্রেনিংয়ে ফেল করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আনার জন্য বিমান কর্তৃপক্ষ ফিরতি ফ্লাইটে প্রধান পাইলট হিসেবে নির্বাচন করেছেন বিমানের চিফ অব টেকনিক্যাল ক্যাপ্টেন খাজাকে। এই খাজার বিরুদ্ধেও এই এয়ারক্রাফটের ট্রেনিংয়ে প্রথম দফায় ফেল করার অভিযোগ আছে।
বিমান সূত্রে জানা গেছে, ওই সময় ক্যাপ্টেন খাজাকে বিমানের পরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তা করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু বি-৭৭৭-এ ফেল করার কারণে তাকে ওই দফায় ওই পদে দেয়া হয়নি। কিন্তু বিমানের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এনামুল বারী দায়িত্ব নেয়ার পর খাজাকে প্রথমত আইন ভঙ্গ করে চিফ অব টেকনিক্যাল করা হয়।
পরবর্তীকালে তাকে বোয়িং-৭৭৭ এয়ারক্রাফটের ট্রেনিং পাইলটও (ইন্সট্রাক্টর) বানানো হয়। এখন তাকে হাঙ্গেরি থেকে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী ফিরতি ফ্লাইট আনার জন্য প্রধান পাইলট হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। এ ঘটনায় বিমানজুড়ে তোলপাড় হলেও সোমবার রাত পর্যন্ত তাকে সিডিউল থেকে বাদ দেয়া হয়নি।
বিমানের অপর একটি সূত্র জানায়, হাঙ্গেরি যাওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী এয়ারক্রাফট ‘রাঙা প্রভাতের’ ককপিট ক্রুদের মধ্যে এমন একজন পাইলটও ছিলেন যাকে সম্প্রতি একাধিক সিনিয়র পাইলটকে ডিঙিয়ে ইন্সট্রাক্টর বানানো হয়েছে। তিনি বাপার (বাংলাদেশ পাইলট অ্যাসোসিয়েশন) সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্টও ছিলেন।