ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের জরিপকে বানোয়াট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও হাস্যকর আখ্যা দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি। দলটি বলেছে, বাস্তবের সঙ্গে এই জরিপের বিন্দুমাত্র মিল নেই। এটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ। গতকাল সকালে দলের নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ এ প্রতিক্রিয়া জানান
।
বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিবেশ, ধর্মান্ধতা ও উগ্রবাদ, মত প্রকাশের স্বাধীনতাও রাজনৈতিক দলগুলোর জনপ্রিয়তা নিয়ে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল সমপ্রতি একটি জরিপ চালিয়েছে, যা গতকাল প্রকাশ করেছে একটি জাতীয় দৈনিক।
‘জরিপে বলা হয়েছে- এখন নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ শতকরা ৩৮ ভাগ, বিএনপি শতকরা ৫ ভাগ ভোট পাবে।’ রিজভী আহমেদ বলেন, জরিপটি শুধু হাস্যকরই নয়; এটি সত্যের অপলাপ মাত্র। জরিপকারীরা কিভাবে তথ্য, উপাত্ত, নমুনা সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করেছেন, তা গভীর ষড়যন্ত্রেরই অংশ। বাস্তবের সঙ্গে এই জরিপের বিন্দুমাত্র মিল নেই। আমাদের মনে হয়- ভোটারবিহীন আওয়ামী লীগ সরকার লাশের পাহাড় ডিঙ্গিয়ে হত্যা আর রক্তরঞ্জিত নির্বাচনে দখল আর কেড়ে নেয়া ভোটকেন্দ্রগুলোর একতরফা সিল মারার তামাশা দেশবাসী দেখেছে।
সেই নির্বাচনের সরকারি পরিসংখ্যানটি মনে হয় ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল জরিপের তথ্যের প্রধান উৎস। রিজভী বলেন, দেশে মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি, দেশজুড়ে খুনের উৎসব চলছে। নারী-শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যা, বন্দুকযুদ্ধ-ক্রসফায়ার-বিচারবহির্ভূত হত্যা, একের পর এক গুমের হিড়িক, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, ঘাটে-মাঠে-নদী-নালায় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ক্ষতবিক্ষত লাশ পড়ে থাকাসহ অসংখ্য বীভৎস অমানবিক ঘটনা ঘটে চলছে।
বিরোধী দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রহসনের বিচার করা হচ্ছে এই বিনা ভোটের সরকারের আমলে। সুতরাং, অনাচারে লিপ্ত একটি সরকার জনসমর্থনে এগিয়ে থাকবে-সেটা শুধু গণতন্ত্রহারা বাংলাদেশি মানুষকে উপহাস করাই নয়, বরং এই জরিপটি যে, আন্তর্জাতিক মাস্টারপ্ল্যানের একটি অংশ তা সহজেই অনুমেয়।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বলেন, পৃথিবীতে কোনো অনির্বাচিত সরকারই জনপ্রিয় নয়। বিনা ভোটের সরকার ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য একমাত্র হত্যা ও রক্তপাতকে নিজেদের টিকে থাকার কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করে। বাংলাদেশের বর্তমান ‘ভোটারবিহীন’ সরকারও সেই কাজটি করছে। জাতিসংঘ বলেছে, চলতি বছরে দেশে দেশে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটবে।
বাংলাদেশে সেই ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটেছে বেশ আগেই, এ বছর তা আরো বেশি ভয়াবহ নির্দয় রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বলেন, বর্তমান ভোটারবিহীন সরকার যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই জানা-অজানা সন্ত্রাস সমাজদেহকে থেঁতলে দিয়েছে। অন্ধ ধর্মীয় জঙ্গিবাদের উত্থান এদের আমলেই। যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনা থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত জঙ্গি সংগঠনগুলোর সংঘটিত প্রাণবিনাশী ঘটনাগুলো প্রকৃত তদন্ত, আসল কালপ্রিটদেরকে চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার না করে কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে দায় চাপিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার।
এতেই প্রমাণ হয় দেশে খুন-জখমের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটাই হচ্ছে মুখ্য উদ্দেশ্য বর্তমান সরকারের। আওয়ামী শাসনামলগুলোতে অসংখ্য বোমা হামলার ঘটনায় দায় চাপানোর উদাহরণ ভূরিভূরি। যে বিষয়টি ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অগ্রাহ্য করেছেন। রিজভী আহমেদ বলেন, জঙ্গিবাদের পাশাপাশি সাবেক এমপি ইলিয়াস আলী, সাইফুল ইসলাম হিরু, হুমায়ুন কবির পারভেজ, ঢাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী আলম, ছাত্র নেতা সুমন, জাকির, আলামীন, মুন্না, মাজহারুলসহ ২০১২ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিরোধীদলীয় প্রায় ৫০০ নেতাকর্মী গুম হয়েছেন। তাদের পরিবারের কাছে আজ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখুন তারা কাদের হাতে গুম হয়েছেন।
গুম নিয়ে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল পরিহাস করে বলেছেন, গুম বলে কোনো শব্দ নেই। ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের জরিপও মনে হচ্ছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পরিহাসেরই প্রতিধ্বনি। তিনি বলেন, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার জরিপেও বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রভাবে সামাজিক সন্ত্রাসেও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান খুন, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন, তনু হত্যা, মিম-জিম-খাদিজার ওপর আক্রমণ, পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী মিতু হত্যা, ২০১৩ সালে দোয়েল চত্বরে ছুরিকাঘাতে নিহত সরকারের যুগ্ম সচিব নিকুঞ্জু বিহারীসহ অসংখ্য লোমহর্ষক ও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে বর্তমান স্বৈরাচারী দুঃশাসনের কারণেই। সবচাইতে ভয়াবহ ও পৈশাচিকভাবে বিশ্বজিৎকে প্রকাশ্য দিবালোকে যারা হত্যা করেছে তারা শাসক দলের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগের ক্যাডার। বিরোধী দলকে নির্মূল করতে ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য স্বৈরাচারী একনায়কের ক্ষিধে কখনো মেটে না। হিটলারের জাতিগত শুদ্ধতা (এ্যাথেনিক ক্লিনসিং)-এর মতো বাংলাদেশের একনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলমত তথা গণতন্ত্র ক্লিনসিংয়ের কাজ শুরু করেছে। সুতরাং এই রকম অবস্থায় একটি জুলুমবাজ সরকারের পক্ষে কতটুকু জনমত থাকবে সেটা উপলব্ধি করা খুব কঠিন নয়।
আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে আমরা ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত জরিপ প্রত্যাখ্যান করছি। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইউএসএইড ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইউকেএইডের সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল গত ২৩ থেকে ৩১শে অক্টোবর পর্যন্ত একটি জরিপ পরিচালনা করে শুক্রবার তা প্রকাশ করে। জরিপের একটি অংশে দেখা যায়, ৩৫ শতাংশ মানুষ ভোট দেয়ার জন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নাম বলতে চাননি। যেটি ২০১৪ সালের জরিপে ছিল ৫ শতাংশ। জরিপে বলা হয়, আজ যদি নির্বাচন হয় তাহলে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ পাবে ৩৮ শতাংশ ভোট। আর প্রধান বিরোধী দল বিএনপি পাবে ৫ শতাংশ ভোট।
এছাড়া জাতীয় পার্টি ১ শতাংশ ও জামায়াতে ইসলামী ২ শতাংশ ভোট পাবে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পরিচালিত ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের জরিপে আওয়ামী লীগ ৩৮ শতাংশ এবং বিএনপি ৩৫ শতাংশ ভোট পাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। এবার আওয়ামী লীগের ভোটের জরিপ চিত্র একই থাকলেও বিএনপির ভোট নেমে গেছে ৫ শতাংশে।