নিজস্ব সংবাদদাতা: সম্প্রতি কানাডার কোন এক আদালতের একজন বিচারক বাংলাদেশের বৃহত্তম ও সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করে বিতর্কিত একটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। এনিয়ে সর্বত্র চলছে ব্যাপক তোলপাড়। মোহাম্মদ জুয়েল হোসেন গাজী নামের বাংলাদেশী এক শরনার্থীর রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন বিবেচনা করতে গিয়ে বিচারক তার এমন অভিনব দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটান।
তবে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়া অসত্য পর্যবেক্ষণটি কেন প্রদান করা হলো এনিয়ে এ প্রতিবেদকের নিবিড় অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। দৃশ্যত আদালতের পর্যবেক্ষণ মনে হলেও এর পেছনে কাজ করেছে গভীর চক্রান্ত যার সাথে সম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের কয়েকজন হোমচোমড়া নেতা। উঠে এসেছে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা মাহবুবুল আলম হানিফ এবং আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবী শাহরিয়ার কবিরের নাম।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যে ব্যক্তির আপিল আবেদনের ওপর সিদ্ধান্ত দিতে গিয়ে কানাডার আদালত অস্বাভাবিক মন্তব্যটি করে বসেন সেই জুয়েল গাজী, যে কখনো বিএনপির রাজনীতির সাথেই যুক্ত ছিল না। মিথ্যা, বানোয়াট ও স্ববিরোধী তথ্য উপস্থাপন করে আদালতের রায়কে ভিন্ন গন্তব্যে ঠেলে দেওয়াই ছিল দীর্ঘদিন ধরে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত একটি মহলের আসল উদ্দেশ্য। তাতে ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহার করা হয় মূলত মিরপুর থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক জুয়েল গাজীকে। খরচ করা হয় মোটা অংকের অর্থ ও সুযোগ-সুবিধা। জুয়েলকে দেওয়া হয় নিরাপদ ও অপার সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের প্রলোভন।
মজার বিষয় হচ্ছে, জুয়েল গাজী তার রিফিউজি আবেদনে নিজেকে মিরপুর থানা জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের একজন কর্মী হিসেবে দাবী করলেও মিরপুর থানা কিংবা অন্য কোন ইউনিটের বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদল কোন কমিটির তালিকাতেই তার নাম পাওয়া যায়নি। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সক্রিয় নেতাকর্মীরা তাকে চেনাতো দূরের কথা তার জুয়েল গাজীর নামও কখনো শোনেনি।
খোঁজ নিয়ে আরো যায়, স্বেচ্ছাসেবক লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে ২০০১-২০০৪ সালের দিকে ঢাকায় কয়েকটি মারামারি ও খুনের ঘটনা ঘটলে অন্যদের সাথে জুয়েল গাজীকেও আসামী করে তার দলীয় প্রতিপক্ষরা কয়েকটি মামলা দায়ের করে, যার মধ্যে একটি হত্যা মামলাও ছিল। জেল ও বিচার এড়াতে সে তখন দেশ ত্যাগ করে দক্ষিণ কোরিয়ায় চলে যায়, সেখান থেকে পাড়ি জমায় জাপানে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জুয়েল গাজী ২০০৮ সালের শেষভাগে দেশে ফিরে আসে ও কুখ্যাত ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দীন সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে ২০০৯ সালের গোড়ার দিকে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে জুয়েল আবার মীরপুরের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। জড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষ, চাঁদাবাজি ও বহুবিধ অনৈতিক কর্মকান্ডে। মিরপুর থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের অভ্যন্তরীণ গ্রুপিংয়ে জুয়েল পক্ষ নেয় সভাপতি অংশের। এভাবে এক সময় সে চলে আসে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মাহবুবুল আলম হানিফের সংস্পর্শে।
স্বেচ্ছাসেবক লীগের মিরপুর থানার বর্তমান কমিটির একজন প্রভাবশালী যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, "হানিফ একজন মদ্যপ ও নারীলোভী মানুষ। প্রায় রাতেই সে মিরপুরে জুয়েলের আস্তানায় আসতো তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শাহরিয়ার কবিরকে নিয়ে। আওয়ামী লীগের আরো কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাও মাঝে মাঝে তাদের সাথে আসরে রাত কাটাতেন, তবে নিয়মিত থাকতেন কেবল ইসলামবিদ্বেষী বিখ্যাত ছড়াকার শাহরিয়ার কবির।"
সেচ্ছাসেবক লীগের এ নেতা জানান বিস্ময়কর আরো কিছু তথ্য। নারীঘটিত একটি কেলেংকারি ধামাচাপা দিতে ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে মাহবুবুল হক হানিফের নির্দেশে জুয়েল গাজীকে গ্রেফতার করে মিরপুর থানা পুলিশ। তাকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলেও মূল ঘটনা জানাজানি হওয়ার আশংকায় শাহরিয়ার কবিরের মধ্যস্থতায় ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে জুয়েলকে কানাডা পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাকে শর্ত দেওয়া হয়, দু'তিন বছর কানাডায় থাকতে হবে তাকে এবং এসময় বিএনপি পরিচয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে বিএনপিরই বিরুদ্ধে ভয়ংকর সব তথ্য জমা দিতে হবে আদালতে।
চুক্তি হয়, মিশনের সমস্ত খরচ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বহন করা হবে। পরবর্তীতে দেশে ফিরে এলে তাকে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা বানানো হবে।
জুয়েল গাজীর কানাডা অবস্থানকালে তার চলাফেরা এবং রাজকীয় জীবনযাপন দেখে সবার মনেই সন্দেহের উদ্রেক হবে। কোন কাজকর্ম না করেও কীভাবে সে এতো বিলাসিতায় থাকছে কানাডায় ? আসলে তাকে নিয়মিত অর্থ সরবরাহ করা হয়েছে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে। হুন্ডির মাধ্যমে কানাডা আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা দেশ থেকে নিয়মিত অর্থ এনে জুয়েলের হাতে তুলে দিচ্ছেন। এ প্রতিবেদকের হাতে ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ এসে পৌঁছেছে।
দেখা যাচ্ছে, সম্পূর্ণ হীন উদ্দেশ্যে জুয়েলের মামলাটির মূল গতিপথ পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। একটি রিফিউজি মামলার শুনানী চলাকালে ইচ্ছাকৃতভাবে জুয়েলের বিভিন্ন মনগড়া, স্ববিরোধী ও আত্মঘাতী তথ্য প্রদান এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনায় বিএনপি নেতাদের কাল্পনিক নির্দেশের কথা বলা থেকেই বোঝা যায় এটি একটি সাজানো মামলা। অবৈধ ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে পূর্বপরিকল্পিত উপায়ে বিএনপিকে একটি সুস্থ ধারার রাজনৈতিক দল থেকে জঙ্গী ভাবধারার সন্ত্রাসী দল হিসেবে চিত্রিত করাই ছিলো আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, আগাগোড়া সবকিছুই ঘটেছে শেখ হাসিনার সম্মতিতে।
কিন্তু প্রাথমিকভাবে জুয়েল এবং তার গুরুদের লক্ষ্য সফল হলেও কানাডার আদালত কর্তৃক বিএনপিকে সস্ত্রাসী দল ঘোষণার খবর প্রকাশই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে ঠগবাজদের জন্য। আদালতের মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে মূলধারার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। এ নিয়ে সর্বত্র বয়ে যাচ্ছে সমালোচনার ঝড়।
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলোও আদালতের পর্যবেক্ষণে ক্ষোভ প্রকাশ করে এর বিরুদ্ধে আইনি লড়াই শুরুর ঘোষণা দিয়েছে। কেঁচো খুড়তে বেরিয়ে আসছে সাপ। আওয়ামী লীগের চক্রান্ত ফাঁসে বিস্মিত ও বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
কানাডার সুপ্রাচীন এবং স্বনামধন্য বিচার ব্যবস্থাকে বোকা বানিয়ে এধরণের একটি সর্বৈব মিথ্যা পর্যবেক্ষণ আদায় করে নেয়া কানাডার জন্যও সমান লজ্জার এবং অনভিপ্রেত বটে।
বিএনপির পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই এ ঘটনার কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানের উপদেষ্টা ব্যারিষ্টার আবু সালেহ মো. সায়েম বলেন, "আমরা সবকিছুর আইনগত দিক ক্ষতিয়ে দেখছি। অচিরেই আসল তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে এবং চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে প্রাথমিক সাক্ষ্য-প্রমানাদি কানাডিয়ান কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ নাটকের যবনিকাপাত ঘটাতে আমরা বদ্ধপরিকর।"