আবু রুশদঃ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর তিনটি ব্রিগেড ছিল। নিয়মিত বাহিনী বলতে এদেরকেই বোঝাত। এই তিনটি হচ্ছে ‘জেড ফোর্স’, ‘এস ফোর্স’ ও ‘কে ফোর্স’। এদের মধ্যে সর্বপ্রথম গঠিত হয় ‘জেড ফোর্স’। কেন ‘জেড’?
কারণ জিয়াউর রহমানের নামের প্রথম অক্ষর নিয়ে ওই নিয়মিত ব্রিগেডটি গঠন করা হয়েছিল। সফিউল্লাহর নাম নিয়ে গঠিত হয় ‘এস ফোর্স’, ‘কে ফোর্স’ গঠিত হয় খালেদ মোশাররফের নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে। যুদ্ধকালীন পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্নেল জিয়াউর রহমান, কর্নেল সফিউল্লাহ ও কর্নেল খালেদ মোশাররফ- এই তিনজনের মধ্যে আর্মি নম্বরে সিনিয়র ছিলেন জিয়া।
সফিউল্লাহ পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে তার কোর্সমেট হলেও যোগ্যতানুযায়ী (বা সার্বিক রেজাল্ট হিসেবে) জিয়ার অবস্থান নির্ধারিত হয়েছিল সামনের কাতারে। তিনি ছিলেন শফিউল্লাহর চেয়ে আর্মি নম্বরে সিনিয়র। খালেদ মোশাররফ ছিলেন ওই দু’জনের চেয়ে জুনিয়র কোর্সের অফিসার। তাই মুক্তিযুদ্ধ যখন মোটামুটি একটি সাংগঠনিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে যায় তখন নিয়মিত ব্রিগেড গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। আর সিনিয়রিটি বিবেচনায় কর্নেল জিয়াউর রহমানের নামেই গঠিত হয় প্রথম ফোর্স ‘জেড ফোর্স’।
এখন জিয়াকে অস্বীকার করা মানে জেড ফোর্সকে অস্বীকার করা, আর জেড ফোর্সের নাম মুছে দেয়ার অর্থ পুরো মুক্তিযুদ্ধকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেয়া।
ইতিহাসের দায় হোক আর নিছক নিয়তি হোক, জিয়াউর রহমানকে রাজনীতিতে যুক্ত হতে হয়েছিল। সফিউল্লাহ্ কি বাদ গিয়েছেন? না। তিনি এখনো যুক্ত আছেন রাজনীতিতে। খালেদ মোশাররফও জড়িয়ে গিয়েছিলেন ঘটনাক্রমে, কিন্তু ভাগ্য তার সুপ্রসন্ন ছিল না। রাজনীতিতে জড়ালে সমালোচনা হবেই, হয়তো হতে হবে বিতর্কিত। জিয়াও তার ব্যতিক্রম নন। তার হাতে তৈরি রাজনৈতিক দর্শন ও দলকে নিয়ে সমালোচনা তাই অস্বাভাবিক কিছু নয়, বরং তাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে তখনই যখন জাতীয় সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে কারো স্বীকৃত ভূমিকাকে নিয়ে অশালীন ভাষায় আক্রমণ করা হয়।
আজ তো জিয়াকে একটি রাজনৈতিক পক্ষ পারলে রীতিমতো ‘রাজাকার’, এমনকি ‘পাকিস্তানি গুপ্তচর’ বানিয়ে ছাড়ছে!
বাংলাদেশ সৃষ্টির রাজনৈতিক সংগ্রাম ও তার শেষ ধাপ- সশস্ত্রযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী, জেনারেল ওসমানী, জেনারেল জিয়াউর রহমানের ভূমিকা কেউ কি অস্বীকার করতে পারবে? যদি তাই করা হয় তাহলে তো পুরো মুক্তিযুদ্ধকেই বিতর্কিত ও অস্বীকার করা হবে!
জিয়াউর রহমান যদি মুক্তিযোদ্ধা নাই হন বা পাকিস্তানি চর হন তাহলে কি কয়েকটি প্রশ্ন করা অস্বাভাবিক হবে :
১। মুক্তিযুদ্ধে কেন স্বাধীন বাংলা সরকার প্রথম ব্রিগেড গঠন করেছিলেন জিয়াউর রহমানের নামে?
২। যুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদান রাখার জন্য জীবিতদের মধ্যে সর্বোচ্চ পদক বীর উত্তম (বীরশ্রেষ্ঠ দেয়া হয়েছে যারা শহীদ হয়েছেন কেবল তাদেরকে) কেন তাকে দেয়া হয়েছিল?
৩। বঙ্গবন্ধু যতদিন দেশ পরিচালনা করেছিলেন, ততদিন কি জিয়াকে কেউ অমুক্তিযোদ্ধা বলেছেন? নাকি তাকে তদানীন্তন সরকার সম্মানিত করেছেন? যদি তার সেই সম্মান কেড়ে নেয়া হয় তাহলে কি বঙ্গবন্ধুর জাজমেন্ট বা বিচার বিবেচনাকেই অপমানিত করা হয় না? মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল ওসমানীসহ বাকি নেতৃবৃন্দকেও কি কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় না? জিয়ার বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ থাকত তবে তো বঙ্গবন্ধুর শাসনামলেই তার বিচার করা হতো। কেন তখন তা করা হয়নি?
৪। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করেন মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকে। বিএ অর্থাৎ বাংলাদেশ আর্মি নম্বরে মেজর জেনারেল জিয়ার নাম আগে থাকলেও সরকার তাকে নিযুক্ত করেন ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ হিসেবে। যা হোক, জিয়াকে তো তদানীন্তন আওয়ামী লীগ সরকারই নিযুক্ত করেছিলেন, তাই না?
তাহলে তারা কি একজন অমুক্তিযোদ্ধাকে ওই পদে বসিয়েছিলেন জেনেশুনে?
বরং জিয়া সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ছিল উচ্চ ধারণা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক পূর্ণিমাতে একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন ১৯৯৩ সালে। ওই বছর ২৪ নভেম্বর প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে তিনি জিয়া সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমানের অনুভূতি নিয়ে বলেন, ‘জিয়া সম্পর্কে উচ্চ ধারণা ছিল বঙ্গবন্ধুর।…
’৭১- এর মার্চ মাসে যখন আন্দোলন তুঙ্গে এবং স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত, বঙ্গবন্ধু প্রায়ই অস্থির চিত্তে বলতেন, আমার সৈনিকদের মধ্যে এমন একটি রেজিমেন্টও কি নেই যেখানে গিয়ে আমি নিশ্চিন্তে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারি? এমন কেউ নেই যারা এ মুহূর্তে আমাকে নিয়ে যেতে পারে?’ ড. ওয়াজেদ মিয়া আরো বলেন, ‘কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমান নিজের নাম উচ্চারণ করে ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। কঠিন বিপদ নেমে আসতে পারত তার পরিবারের ওপর। সন্তান কোলে খালেদার সম্ভাব্য করুণ পরিণতির কথা বিন্দুমাত্র ভাবেননি জিয়া।
জিয়ার এই সাহসী ভূমিকাকে অত্যন্ত সম্মান করতেন বঙ্গবন্ধু এবং বলতেন, সৈনিকদের মধ্যে জিয়া সত্যিই এক যোগ্য সন্তান।’ [লেখকের কাছে সাপ্তাহিক পূর্ণিমার ওই সংখ্যাটি সংরক্ষিত আছে]। যেখানে বঙ্গবন্ধুই জিয়ার ভূমিকাকে সম্মান করতেন, সেখানে জিয়াকে অমুক্তিযোদ্ধা যারা বলছেন তারা কি বঙ্গবন্ধুকেই অপমান করছেন না?
লেখকঃসাবেক সেনা কর্মকর্তা,নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাংবাদিক।