ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ মারাত্বক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হাওরাঞ্চলকে অবিলম্বে দুর্গত অঞ্চল ঘোষণা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
রাতে এক বিবৃতিতে তিনি এ আহ্বান জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বের হাওর অঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতিতে আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। প্রতিবেশী দেশ থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে সৃষ্ট আগাম বন্যায় ব্যাপক শস্যহানিসহ গবাদি পশু, মাছ, জলজ প্রাণী এবং অন্যান্য সম্পদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতিতে সহায়-সম্বল হারিয়ে সেখানে এক অকল্পনীয় মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। রোগে-শোকে, খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে মানুষ এক অবর্ণনীয় দুর্দশায় জীবন কাটাচ্ছে। তাদের কষ্ট বর্ণনার অতীত।
তিনি বলেন,বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা বিএনপির মহাসচিবের নেতৃত্বে সেখানে এক প্রতিনিধিদল পাঠাই। তাঁরা সেখানে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সাহস যুগিয়েছেন। ক্ষয়ক্ষতির অবস্থা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ এবং ত্রাণতৎপরতা চালিয়েছেন। বিএনপি প্রতিনিধিদল হাওর অঞ্চলে বিপর্যয় ও ক্ষয়ক্ষতির যে ভয়াবহ চিত্র দেখেছেন তার আলোকেই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাকে ‘দুর্গত অঞ্চল’ ঘোষণার আহবান জানাই।
কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, মানবিক বিবেচনা থেকেই এ আহবান জানানো হয়েছিল। পরে অন্যান্য রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন এবং স্থানীয় জনগণের পক্ষ থেকেও একই দাবি উত্থাপন করা হয়।
খালেদা জিয়া বলেন,অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় ক্ষমতাসীনেরা এ দাবি বার বার প্রত্যাখান করেছেন। দু:খের বিষয় হচ্ছে, তাদেরকে তুষ্ট করার জন্য একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করে বলেন, কোনো এলাকার অন্ততপক্ষে অর্ধেক সংখ্যক লোকের দুর্যোগে মৃত্যু না হলে সে এলাকাকে ‘দুর্গত অঞ্চল’ ঘোষণার নিয়ম নেই।
তিনি বলেন, আমরা লক্ষ্য করছিÑ প্রতিবেশী দেশের সীমান্তবর্তী খনি থেকে ইউরেনিয়াম মিশ্রিত পানির দুষণে জলজ প্রাণীর মৃত্যুর ব্যাপারে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরকে অস্বিকার করাই একসময় ক্ষমতাসীনদের কাছে ত্রাণতৎপরতার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। মানুষের চরম দুর্যোগ ও দুর্ভোগের সময়ে এ নিয়ে তারা মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর হাসি-ঠাট্টায় মেতে ওঠেন। এমন সংবাদ প্রকাশিত হলে আমরা দেশবাসীর সঙ্গে সমভাবে ব্যথিত হয়েছি।
খালেদা জিয়া বলেন, এত কিছুর পর বিলম্বে হলেও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনের খবরে সকলে কিছুটা আশান্বিত হয়েছিলেন। যেভাবেই হয়ে থাকুন না কেন, তিনি এখন ক্ষমতার চেয়ারে আসীন। সেই হিসেবে দুর্যোগ মোকাবিলার প্রধান দায়িত্ব মূলতঃ তাঁরই। তাছাড়া একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে দেশের মানুষের চরম দুর্দশা তাঁর অন্তর স্পর্শ করবে। এই ধারণা থেকে আমাদেরও আশা ছিল, হাওর এলাকা পরিদর্শন শেষে তিনি হয়তো ঐ এলাকাকে ‘দুর্গত অঞ্চল’ ঘোষণা করবেন। দু:খের বিষয়, সে আশা পূরণ হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় তাঁর গতানুগতিক তৎপরতা দেখে ও বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে, তিনি পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করেননি বা স্বীকার করতে চাননি।
খালেদা জিয়া বলেন, আমি ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের স্বার্থ ও কল্যাণে হাওর অঞ্চলকে আগামী ছয় মাসের জন্য ‘দুর্গত অঞ্চল’ ঘোষণা এবং সেই মোতাবেক আন্তরিকভাবে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহনের জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি।
দেশবাসীর সঙ্গে আমরাও বিশ্বাস করি, হাওর অঞ্চলে যে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে তার জন্য প্রাকৃতিক বিরূপতার পাশাপাশি ক্ষমতাসীনদের অপকর্ম, দুর্নীতি ও ব্যর্থতাও দায়ী। তিনি বলেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বর্তমান সরকারের সর্বোচ্চ সম্পর্ক স্থাপনের কথা প্রচার করা হয়। তা সত্ত্বেও পাহাড়ী ঢলের তথ্য যথাসময়ে কেন পাওয়া গেল না এবং সে অনুযায়ী হাওরবাসী ও সরকারী প্রশাসনকে কেন আগাম সতর্ক ও প্রস্তুত করা হলো না, সে প্রশ্ন আজ সংগতভাবেই উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা কেন একযোগে বিদেশ সফরে এবং এ ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা সরকারের কাছে দেশবাসী জানতে চায়। তিনি বলেন, হাওর অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণে ক্ষমতাসীনদের সীমাহীন দুর্নীতির খবর বিপর্যয়ের বেশ আগে থেকেই প্রকাশিত হচ্ছিল। সকলের আশা ছিল ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগেই তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তার বদলে শেখ হাসিনার বক্তৃতায় ‘প্রমান হলে ব্যবস্থা নেয়ার’ গতানুগতিক আশ্বাস মানুষকে হতাশ করেছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, এত বড় মহাদুর্যোগের পরেও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সরকারি উদ্যোগে দুর্গতের চিহ্নিতকরণ এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজে ব্যাপক দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থা ও সংকীর্ণ দলীয়করণের অভিযোগ উঠছে। আমরা অনতিবিলম্বে এসবের প্রতিকার দাবি করছি। মানুষের দুর্গতি নিয়ে কোনো রকম রাজনীতি না করার আহবান জানাচ্ছি। হাওর অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন ও দুর্যোগ মোকাবিলায় বিপুল ব্যয়সাপেক্ষ গালভরা নামের যে মহাপরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছিল তা কেন বাস্তবায়িত হয়নি তা দেশবাসীকে জানানো উচিৎ। সকল দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতা ও আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করে সেই পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহনের দাবি জানাচ্ছি।
খালেদা জিয়া বলেন, আমি দাবি করছি নতুন ফসল না আসা পর্যন্ত হাওরের ক্ষতিগ্রস্তদের খাদ্যসহায়তা দেয়া হোক। ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারি কৃষিঋণের সুদ সম্পূর্ণ মওকুফ এবং সরকারি-বেসরকারি সকল প্রকার ঋণের কিস্তি আদায় স্থগিত, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ ও বিনাসূদে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ দেয়া হোক। এক বছরের জন্য জলমহালের ইজারা বাতিল করে উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ ধরে জীবীকা নির্বাহের সুযোগ স্থানীয় দরিদ্রদের দেয়া হোক। ত্রাণ, পুনর্বাসন ও চিকিৎসার উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হোক। হাওরের শস্য, মৎস্যসম্পদ, গবাদিপশু ও অন্যান্য জলজপ্রাণীর যে বিপুল হানি ঘটেছে তা আমাদের জন্য এক জাতীয় বিপর্যয়ের শামিল। এই ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আমি জাতীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা গ্রহনের আহবান জানাই।
বিএনপি চেয়ারপারসন দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, পরিশেষে, দলমত নির্বিশেষে সকলের প্রতি আমার আন্তরিক আবেদন, যার যা সামর্থ্য তা নিয়ে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ান।