ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ আওয়ামী লীগ সরকার নিজেদের সাফল্য দেখাতে পাসের হার বাড়িয়ে দেয়ায় শিক্ষার মানের ক্রমাবনতি ঘটেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
তিনি বলেছেন, আত্মতুষ্টির কারণে পাসের হার বাড়িয়ে আমাদের শিক্ষার মানের ক্রমাবনতি ঘটেছে। এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে না পারলে আগামী দিনে আমাদের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে। আমরা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ব।
রাজধানীর লেডিস ক্লাবে বিএনপি আয়োজিত ‘বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা ও আমাদেশ ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনারের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
খালেদা জিয়া বলেন, আমি নিজে শিক্ষাবিদ নই, কিন্তু বিভিন্ন মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে দেখেছি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন। এমন পরিবর্তন প্রয়োজন যা দেশের মানুষের আশা-আকাংখাকে প্রতিফলিত করবে। শিক্ষার সুফল সকল মানুষের জীবনে পৌছাবে। শিক্ষা হবে আন্তর্জাতিক পরিম-লে উন্নত জাতি হিসেবে আমাদের পরিচিতি ও মাধ্যম।
তিনি বলেন, শিক্ষা মানুষকে গণতন্ত্রের প্রতি, ভিন্নমতের প্রতি, ভিন্নমত প্রকাশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শিক্ষা দেয়। দুঃখজনক হলেও, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার শিক্ষার এই মৌলিক লক্ষ্যকে পদদলিত করছে। তারা শিক্ষাক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার দাবী করলেও দেশে গণতন্ত্রকে ধ্বংস ও ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করেছে। শিক্ষার সকল উদ্দেশ্য আজ ভুলুন্ঠিত। সুশাসন, আইনের শাসন আজ নেই বললেই চলে। প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে সরকার সকল বিরোধী মতকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। এই অবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে। জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমেই আমরা দেশে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনব, প্রতিষ্ঠা করব মানুষের অধিকার। জানি এ লড়াই কঠিন লড়াই। কিন্তু যে জাতি লড়াই করে স্বাধীন হয়েছে তাদের কাছে এ লড়াই কোন কঠিন লড়াই নয়।
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, একজন মানুষের পরিপূর্ণ জীবন লাভের পূর্বশর্ত হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষা থাকলেই মানুষ সকল দুর্যোগ, দুর্ভোগের মোকাবেলা করতে পারে। আপনারা একটু চিন্তা করলেই দেখবেন, দেশে দুর্ভিক্ষ, মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসব ক্ষেত্রে লেখাপড়া জানা মানুষের চেয়ে লেখাপড়া না জানা ক্ষতিগ্রস্ত ও নিহত মানুষের সংখ্যা বেশি। মনে রাখা প্রয়োজন, শিক্ষা মানুষকে শুধু হাতেকলমে পড়তে, লিখতে ও অংক করতেই শিখায় না। শিক্ষা মানুষের জীবনকে আলোকিত করে, মানুষকে মর্যাদা দেয়। এই মর্যাদার জন্যই মানুষ জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের সংগ্রামে লিপ্ত হয়। মর্যাদাবিহীন মানুষ সবসময় সমাজে উপেক্ষিত থাকে। আমাদের সমাজে এই উপেক্ষার হার অনেক বেশি। একারণেই সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি জীবনভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োজন। যা বাংলাদেশের মানুষকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সক্ষম করে তুলবে।
খালেদা জিয়া বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ একাধিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। প্রত্যেকটি ব্যবস্থার লক্ষ্য ভিন্ন ভিন্ন। এই ভিন্নতার সঙ্গে সমাজে বিরাজমান যে শ্রেণী ও অর্থনৈতিক বৈষম্য আছে তা স¤পর্কিত। সমাজ যেখানে মাদরাসা শিক্ষার জন্য নিজেই অর্থের সংস্থান করে, সমাজের সুবিধাভোগীরা সেখানে ভিন্ন ধরনের শিক্ষার জন্য অর্থ ব্যয় করে। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে প্রচলিত সবধরনের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে যোগসূত্র তৈরী করতে হবে।
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে শিক্ষা ব্যবস্থা স¤পর্কে বিএনপির নিজস্ব চিন্তা ভাবনা আছে। যেভাবে দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে তার সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে ভবিষ্যতে আমাদের চরম প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হবে।
এ সময় তিনি বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ১৯-দফা কর্মসূচির মধ্যে শিক্ষার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে বলেন, প্রেসিডেন্ট জিয়ার চিন্তাকে মাথায় রেখে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে চেয়েছিলেন। আমরা শিক্ষাকমিশনও গঠন করেছিলাম। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে অনেক কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। জনইচ্ছার প্রতিফলনে আগামী দিনে ক্ষমতায় গেলে বিএনপি শিক্ষাব্যবস্থাকে কেমন করে জনকল্যাণমুখী করবে। শিক্ষাখাতে জিডিপি’র শতকরা পাঁচভাগ ব্যয় করে দেশকে নিরক্ষরতার অভিশাপ ও অন্যান্য শিক্ষা সমস্যা থেকে মুক্তি দেওয়া হবে। আমরা এমন ব্যবস্থা গড়ে তুলব যাতে শিক্ষা শুধু ডিগ্রী অর্জনের হাতিয়ার হবে না, হবে জীবনে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার হাতিয়ার।
সর্বপর্যায়ে শিক্ষা অর্জনের সুযোগ লাভের ক্ষেত্রে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, জেন্ডার ও অর্থনৈতিক বাধাসমূহ দূর করা হবে। আমাদের মানবস¤পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে জনগোষ্ঠীর চিন্তার জগতে পরিবর্তন আনতে হবে। শুধুমাত্র ডিগ্রী প্রাপ্তির মোহ থেকে দেশের তরুণদেরকে মুক্ত করতে হবে। সামর্থ্য, মেধা ও কর্মসংস্থানের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা ও শিক্ষকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। পেশাগত ও কারিগরি শিক্ষা, প্রকৌশল বিদ্যা, চিকিৎসা বিদ্যা, বিজ্ঞান শিক্ষা ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণা, শত শত ধরনের ট্রেড ও পেশার জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচী মানবসম্পদকে বিকশিত করতে পারে। বিভিন্ন ধরনের ট্রেড ও পেশার চাহিদা পূরণের জন্য গুণগতভাবে উন্নত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার প্রয়োজন হবে। একই সঙ্গে সকল পর্যায়ে শিক্ষকতার মানও উন্নত করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশী বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ ও অধ্যাপকদের সহযোগিতাও গ্রহণ করতে হবে।
তিনি বলেন, মানবসম্পদ উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারী খাতকে দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগাতে হবে। প্রযুক্তি ও কারিগরি ইন্সটিটিউটগুলোর ইন্সট্রাক্টর ও ট্রেইনারদের বিশেষ আর্থিক সুবিধা ও অন্যবিধ সুযোগ সুবিধা প্রদান করে এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের সামাজিক দায়িত্ববোধ কর্মসূচীর সিংহভাগ মানবসম্পদ উন্নয়নে ব্যয় করতে উৎসাহিত করতে হবে। শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের নিশ্চিত ব্যবস্থা আমরা করতে চাই।