ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ভারত থেকে এবার হিমায়িত গরুর মাংস আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে আনতে প্রতি কেজি মাংসের খরচ পড়বে ২৫০ টাকার মতো। অন্যান্য খরচ যোগ করার পর খুচরা পর্যায়ে ৩০০ টাকা কেজি বিক্রি করা গেলেও ভালো মুনাফা পাবেন ব্যবসায়ীরা। ভারতের গো-মাংস রফতানির সঙ্গে যুক্ত এ রকম কয়েকজন ব্যবসায়ী এখন বাংলাদেশ সফর করছেন। দেশে এখন প্রতি কেজি গরুর মাংস ৫০০ থেকে ৫২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। উচ্চমূল্যের এই বাজারে ভারতের হিমায়িত গরুর মাংস সহজে বাজার ধরতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভারতের মাংস রফতানি কারকদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (আইবিসিসিআই)। মাংসের পাশাপাশি অন্যান্য কৃষিজাতপণ্য বিশেষ করে চাল, পেঁয়াজ, মসলা এবং বিভিন্ন ধরনের ফলমূল ভারত থেকে আমদানি করা হবে। ভারত থেকে এসব পণ্যের আমদানি বৃদ্ধি, অপরদিকে পাটপণ্য, বীজ, কৃষি প্রক্রিয়াজাতপণ্য এবং শুঁটকি মাছ রফতানি বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
শনিবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলের বলরুমে এফবিসিসিআই, আইবিসিসিআই এবং ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের (আইসিসি) যৌথ উদ্যোগে কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্য শিল্পের ওপর দুই দিনব্যাপী ব্যবসায়িক সম্মেলন শুরু হয়েছে। এই সম্মেলনে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের ৬০ ব্যবসায়ী তাদের উৎপাদিত বিভিন্ন কৃষি প্রক্রিয়াজাতপণ্য এবং ওইসব পণ্যের ক্যাটালগ প্রদর্শন করছেন।
বাংলাদেশের যেসব ব্যবসায়ী ভারত থেকে পণ্য আমদানি করে থাকেন তারা এসব পণ্যের বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। শীঘ্রই দু’দেশের এই ব্যবসায়িক কার্যক্রম এগিয়ে নিতে আইবিসিসিআই এবং আইসিসি’র মধ্যে যৌথ এগ্রিমেন্ট বা চুক্তি করা হবে। এরপরই ভারত থেকে হিমায়িত বা হিমায়িত গরু ও মহিষের মাংস এনে এদেশে বাজারজাতকরণ করা হবে।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে আইসিসি’র পরিচালক ও কৃষি ও খাদ্যপণ্য বিভাগের প্রধান মধুপর্ণা ভৌমিক বলেন, দু’দেশের বাণিজ্য আলোচনায় এবার রফতানি ও আমদানির বিষয়টিতে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছে। এদেশে ভোগ্যপণ্যের বড় অংশ আমদানি হয় ভারত থেকে। চাহিদা মেটাতে সেই আমদানি যাতে আরও বাড়ে এবং ভোক্তা পর্যায়ে ভোগ্যপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হয় সে বিষয়ের প্রতি নজর রাখছেন দু’দেশের ব্যবসায়ীরা।
তিনি বলেন, কিছু বিধিবিধানের কারণে সরাসরি গরু আসতে পারছে না বাংলাদেশে। অথচ হিমায়িত গরুর মাংস আনতে কোন সমস্যা নেই। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ভারত বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের গো ও মহিষের মাংস রফতানি করছে। বাংলাদেশেও এই রফতানি সম্ভব।
তিনি বলেন, গরুর মাংসের বড় বাজার হতে পারে বাংলাদেশ। এবারের সফরে বেশ কয়েকজন মাংস রফতানিকারক এসেছেন। তারা বাংলাদেশকে গো মাংসের বড় সম্ভাবনার বাজার হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছেন। এক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশে ভারত যেভাবে মাংস রফতানি করছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে।
আইবিসিসিআইয়ের প্রথম সহ-সভাপতি দেওয়ান সুলতান আহমেদ বলেন, ১৭ কোটির মধ্যে দেশের ১৬ কোটি মানুষই গরুর মাংস খায়। তাই মাংসের চাহিদা পূরণে ভারত থেকে হিমায়িত গরুর মাংস আমদানি করা হবে।
জানা গেছে, ভারতের মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, পশ্চিম বাংলা, আহমেদাবাদ, রাজস্থানসহ বিভিন্ন প্রদেশের ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। সোনারগাঁও হোটেলের বলরুমে চিড়া-মুড়ি থেকে শুরু করে আঙ্গুর ফল, বেদানার প্রক্রিয়াজাত খাবার প্রদর্শন করা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনস্থ পশ্চিমবঙ্গ প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন নিগম লিমিটেডের কর্মকর্তারা হিমায়িত প্রক্রিয়াজাত মাংসের গুণাবলী সম্পর্কে আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
কলকাতার হরিণঘাটা মিট কর্মকর্তারা তাদের উৎপাদিত পণ্য প্রদর্শন করেছেন। প্রতিষ্ঠানটি মুরগি থেকে শুরু করে গরু, মহিষ এবং খাসির মাংস রফতানি করে। আহমেদাবাদের ইনোভেটিভ ফুড প্রোডাক্টসের ম্যানেজিং পার্টনার জায়েশ পাটেল জনকণ্ঠকে বলেন, কৃষি প্রক্রিয়াজাতপণ্য বা ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বিশ্বের সবদেশে রয়েছে। বাংলাদেশে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু সেই তুলনায় কৃষিজাতপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ করতে পারছে না। তিনি বলেন, ভারতে বেসরকারী খাত এখন কৃষিজাতপণ্য উৎপাদন ও রফতানির দিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বড় বাজার হতে পারে। তিনি বলেন, কৃষিজাতপণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের উন্নয়নে যৌথ বিনিয়োগ হতে পারে কি না সে বিষয়েও নজর রাখছেন উদ্যোক্তারা।
এদিকে সকালে বাংলাদেশ-ভারতের দুই দিনের ক্রেতা-বিক্রেতা মিলনমেলার উদ্বোধন করেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। ওই সময় শিল্পমন্ত্রী দু’দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে বলেন, এক্ষেত্রে শুল্ক-অশুল্কজনিত যেসব বাধা রয়েছে তা দূর করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে শিল্পায়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য ১০০টি ইকোনমিক জোন গড়ে তোলা হচ্ছে। ভারতের উদ্যোক্তারা চাইলে তাদের জন্যও বিশেষায়িত শিল্পাঞ্চল বরাদ্দ দেয়া হবে।
শিল্পমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে বিরাজমান স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারতীয় শিল্প উদ্যোক্তারা নিশ্চিন্তে বিনিয়োগ করতে পারেন। ফলে বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ বাড়বে। পাশাপাশি বাংলাদেশে বিনিয়োগকৃত শিল্প কারখানায় উৎপাদিত পণ্য ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পুনঃরফতানির সুযোগ তৈরি হবে। এতে দুই দেশের উদ্যোক্তা ও জনগণ লাভবান হবেন। এটি আমাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ঘাটতি কমাতেও ইতিবাচক অবদান রাখবে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রীংলা বলেন, কৃষি, হর্টিকালচার ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যশিল্প খাতের ওপর এই ব্যবসায়িক সম্মেলনের আয়োজন করেছে ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্স। তিনি বলেন, সাধারণত আন্তর্জাতিক কোন প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি না থাকলে খাদ্যপণ্য আমদানি করে না ভারত। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সুসস্পর্ক থাকায় সরাসরি ভারতে ২১টি খাদ্যপণ্য রফতানির সুযোগ দেয়া হচ্ছে।
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, প্রক্রিতাজাত খাদ্যপণ্যের উন্নয়নে আমরা নজর দিয়েছে। ভারতীয় বিনিয়োগকারীরা চাইলে এই খাতে বিনিয়োগ করতে পারেন।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে দুই দেশের ব্যবসায়ীরা প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য ও বিভিন্ন প্রযুক্তির বিষয়ে জানতে পারছেন। ভারত কীভাবে তাদের পণ্য সংরক্ষণ ও বাজারজাত করছেÑ তা আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা জানতে পারছেন। মূলত তাদের সক্ষমতা জানার জন্যই দাওয়াত দেয়া হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে সম্পর্ক রাখতেই তাদের সঙ্গে বসছি। দুইটি দেশ কিভাবে যৌথ উদ্যোগে শিল্পকারখানা স্থাপন করা যায়-তা নিয়েও আলোচনা হবে।
তিনি বলেন, পেঁয়াজ, মরিচ, চাল ও মসলাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কম দামে ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেয়াই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। দুই দেশের ব্যবসায়ীদের এই অনুষ্ঠান সেই কাজকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে পেঁয়াজ সংরক্ষণের অভাবে পঁচে যায়। অন্যদিকে ভারতে পেঁয়াজের কোল্ড স্টরেজ আছে। আমরা পেঁয়াজ সংরক্ষণের প্রযুক্তির সন্ধান করছি। আর এই মেলায় সে প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে ভারতের ব্যবসায়ীরা। প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশে পেঁয়াজ কোল্ড স্টরেজ করা সম্ভব। এতে ভোক্তাদের কাছে সারাবছর ন্যায্য মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি সম্ভব।