ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে দলের ৩৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি, গ্রীস শাখা। এ উপলক্ষে আলোচনা সভা, কর্মশালা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
গত ১০ সেপ্টেম্বর রবিবার গ্রীসের রাজধানী অ্যাথেন্সে পালিত হয় মর্যাদাপূর্ণ এ দিবসটি। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপি সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা ব্যরিস্টার আবু সালেহ মো. সায়েম।
গ্রীস বিএনপির সভাপতি জিএম মোখলেছুর রহমানের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক আশরাফ উদ্দিন ঠাকুরের পরিচালনায় রবিবার সন্ধ্যায় জাঁকজমকপূর্ণ কর্মসূচিসমূহের সূচনা হয় পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াতের মাধ্যমে। এরপর জনপ্রিয় শিশুশিল্পী মুরসালিনের নেতৃত্বে জাতীয় ও দলীয় সংগীত পরিবেশন করেন উপস্থিত নেতাকর্মীরা।
এসময় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদ ও বিভিন্ন শাসনামলে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে প্রাণহারানো দলীয় নেতাকর্মীদের সম্মানে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
আলোচনা সভার শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন জিএম মোখলেছুর রহমান। তিনি গ্রীস বিএনপির এযাবতকালের সাফল্যের বর্ণনা দিয়ে ভবিষ্যতেও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা অব্যাহত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ব্যারিস্টার আবু সালেহ মো. সায়েম বলেন, "পশ্চিমা সভ্যতা ও গণতন্ত্রের জন্মভূমি গ্রীসে গণতন্ত্রচর্চার অভূতপূর্ব উদাহরন সৃষ্টি করেছে গ্রীস বিএনপি।"
তিনি সেজন্য দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানের পক্ষ থেকে গ্রীস বিএনপির নেতাকর্মীদের অভিনন্দন জানান। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, "গ্রীসের পথ ধরে বাংলাদেশের মানুষও অচিরেই ফিরে পাবে তাদের হারানো গণতন্ত্র।"
মূল আলোচনায় ব্যারিস্টার সায়েম বলেন, "বিএনপির জন্মকে সাদা চোখে অন্যসব দলের জন্মের মতো মামূলী ঘটনা হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এ দলের প্রতিষ্ঠার সাথে মিশে আছে আমাদের আত্মপরিচয়, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, অর্থনৈতিক মুক্তি, জাতীয় ঐক্য ও বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার প্রতিশ্রুতি।"
জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রপিতা হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, "শহীদ জিয়া ছিলেন ক্ষণজন্মা পুরুষ। তিনি তাঁর দূরদর্শিতা দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, আমাদের অস্তিত্বের সংকট তৈরি হবে যদি আমরা সত্যিকারের পরিচয়ে এগিয়ে যেতে না পারি। রাষ্ট্রপিতার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ তাই আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার দর্শন এবং ১৯ দফা আমাদের মুক্তির সনদ।"
জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করে দলের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন ব্যারিস্টার সায়েম।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ২৬শে মার্চ থেকে মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত তিনি ছাড়া অন্য কেউ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন এমন দাবি আজ পর্যন্ত কেউ করেনি।"
অন্যদিকে যারা জিয়াকে স্বাধীনতা ঘোষণার পাঠক বলে ছোট করতে চান তাদের সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন তারেক রহমানের গুরুত্বপূর্ণ এ উপদেষ্টা। তিনি সহজ উদাহরণ টেনে বলেন, "কোন পাঠক কখনো বলে না 'আমি স্বাধীনতা ঘোষণা করছি', বরং বলে 'অমুক স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন'। কিছু ব্যক্তি তথ্যপ্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এ বিষয়টি নিয়ে কুবিতর্ক করে। এদের কেউ কেউ আবার দাবি করে, তারাও নাকি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলো। এভাবে খুঁজতে গেলে পথেঘাটে স্বাধীনতার বহু ঘোষকই পাওয়া যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ যুদ্ধ করেছিলো কেবল একজন মানুষের ডাকেই, তিনি মেজর জিয়াউর রহমান।”
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের সাথে বাঙ্গালিত্বের কোন বিরোধ নেই দাবি করে ব্যারিস্টার সায়েম বলেন, “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বাংলার আবহমান ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও স্বাতন্ত্র্যকে সমানভাবে ধারণ করে। বৃহত্তর আঙ্গিকে আমরা বাঙ্গালি হলেও বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ মানে পরাধীনতার শৃঙ্খল। কেবল বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদেই আমরা বেঁচে থাকতে পারি আত্মমর্যাদা নিয়ে।”
ব্যারিস্টার সায়েম দেশের জন্য বিএনপির অবদানের কথাও তুলে ধরেন তাঁর বক্তব্যে। তিনি বলেন, “বিএনপি জাতিকে রাহুগ্রাস থেকে মুক্তির স্বাদ দিয়েছে। বহুদলীয় গণতন্ত্র, সুদৃঢ় অর্থনীতি, নারীর ক্ষমতায়ন, নকলমুক্ত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক বাজারে কর্মসংস্থান, শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতিসহ গৌরবজনক সবকিছুই জাতিকে উপহার দিয়েছে বিএনপি।”
তিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আত্মত্যাগের কথাও গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেন। তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন, “আওয়ামী লীগের অনেক অর্বাচীন বলে, বিএনপি নাকি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আসলে তাদের সংগঠনই বিলুপ্ত হয়েছিলো দু’দুবার। প্রতিষ্ঠার চার বছরের মাথায় ১৯৫৩ সালে তারা আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে পরিণত হয় আওয়ামী লীগে আর সে ঘটনার বাইশ বছর পর ১৯৭৫ সালে গোটা সংগঠনেরই মৃত্যু ঘটে।” অচিরেই তাদের আবার একই পরিণতি ঘটবে বলে হুঁশিয়ারি করেন ব্যারিস্টার সায়েম।
তিনি বলেন, “গত ৩৯ বছর ধরে বিএনপি এক নামে এক দল হয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে আছে, শত শত বছর ধরে এমনিভাবেই রাজনীতি করে যাবো আমরা। বিলুপ্ত হওয়ার জন্য জন্ম হয়নি বিএনপির।”
শেখ হাসিনা সরকারের কঠোর সমালোচনা করে বিএনপি সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের এই উপদেষ্টা বলেন, “অবৈধ এই সরকার সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। তারা দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত রেকর্ড সৃষ্টি করেছে বলেই রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর নির্যাতনের ন্যূনতম প্রতিবাদ করতে পারছে না। আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আজ বিপন্ন। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী একজন বিজিবি সদস্যকে মেরে ফেললো, তাদের হেলিকপ্টার নিয়মিত আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার টু শব্দটিও করতে পারছে না।”
আলোচনা সভা শেষে রাজনৈতিক শিষ্টাচার এবং সংবিধানের সংশোধনীসমূহের ওপর একটি সংক্ষিপ্ত কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান আলোচক ছিলেন ব্যারিস্টার আবু সালেহ মো. সায়েম।
এসময় তিনি নেতাকর্মীদের জানান, “বিএনপি শাসনামলে দেশের মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে সংবিধানে কোন সংশোধনী আনা হয়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগ অন্তত চারবার সংবিধান সংশোধন করেছে যেগুলো ছিল জনগণের ইচ্ছের ওপর সরাসরি আঘাত।”
আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন গ্রীস বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ইন্জিনিয়ার চন্দন উদ্দিন চৌধুরি, সাবেক সভাপতি জাকির হোসেন, সিনিয়র সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক রাসেল তালুকদার, সাবেক সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক সূফি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শফিক আহমেদ, ভারপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক বোরহান আল জায়েদ, গ্রীস যুবদলের সভাপতি এম মোরশেদ খান, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সাবুল মিয়া, গ্রীস সেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আজিম ঢালী ও ইলিয়াস মুক্তি পরিষদের আহ্বায়ক শাহ্ রিজ্জাদুর রহমান। এদিকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে রবিবার বিকেলে বর্ণাঢ্য এক র্যালিরও আয়োজন করে গ্রীস বিএনপি। অ্যাথেন্সের কয়েকটি রাস্তা ঘুরে র্যালিটি দলীয় কার্যালয়ে গিয়ে শেষ হয়। দোয়াপ্রার্থনা, কেক কাটা ও মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে গ্রীস বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন। কর্মসূচীগুলোতে অংশগ্রহণ করেন বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও জিয়া পরিষদের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী ও সমর্থক।