ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে রোগীর স্বজনদের মারপিটের অভিযোগ উঠেছে। ঘটনার পর আহত ওই দুই স্বজনকে জোরপূর্বক জয়পুরহাট সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়।
শুক্রবার রোগী মাহেলা বেওয়াকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দিলে তাকে জয়পুরহাটে নেয়ার পথে তিনি মারা যান। এর আগেও এক সিরাজগঞ্জের রোগীর স্বজনদের মারপিটের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনার পরে রোগী আলাউদ্দিনও মারা গিয়েছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২৪ অক্টোবর জয়পুরহাট সদর উপজেলার পুরানাপৈল গ্রামে মৃত বজলুর রশিদের স্ত্রী মাহেলা বেওয়াকে (৭৫) শজিমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের মহিলা ওয়ার্ডে (ইউনিট-১, বেড নং-অতিরিক্ত ৫) ভর্তি করা হয়। বৃহস্পতিবার রাত আনুমানিক ১১টায় রোগীর ছেলে গাজিউর রহমান (৪৫) ও তার ছেলে রুম্মান হোসেন শান্ত (২৫) তাকে দেখতে আসেন। এসময় রোগীর চিকিৎসা নিয়ে নাতি রুম্মান হোসেন শান্ত এক মহিলা ইন্টার্নকে আপা বলে সম্বোধন করে চিকিৎসার জন্য ডাকেন।
এঘটনার পরই ওই মহিলা ইন্টার্ন চিকিৎসকের সঙ্গে থাকা পুরুষ ইন্টার্ন চিকিৎসক রোগীর স্বজন শান্তর শার্টের কলার চেপে ধরেন। এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে বাকবিত-া হয়। এক পর্যায়ে শান্তর বাবা গাজিউর রহমান এগিয়ে এলে তার সঙ্গেও বাকবিত-ায় জড়িয়ে পড়েন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। একটু পরই ছুটে আসে একদল ইন্টার্ন চিকিৎসক ও মেডিকেল কলেজের কিছু শিক্ষার্থী। তারপর দু’জনকে ধরে বেধড়ক মারপিট শুরু করেন।
এসময় অন্যান্য রোগী ও তাদের স্বজনরা ভয়ে ছুটাছুটি করে বাহিরে চলে যেতে থাকেন। ঘটনার পর গণমাধ্যমকর্মীরা রাতেই হাসপাতালে গেলে তাদের প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। রাত ১টায় গণমাধ্যমকর্মীরা হাসপাতাল থেকে চলে এলে আহত ওই দু’জনকে হাসপাতাল থেকে জয়পুরহাটে পাঠিয়ে দেয়া হয়। পরে তারা জয়পুরহাট সদর হাসপাতালে রাতেই ভর্তি হন।
শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় হাসপাতালে গেলে গণমাধ্যমকর্মীদের ওই ওয়ার্ডে একা যেতে দেয়া হয়নি। হাসপাতালের উপ-পরিচালক নির্মলেন্দু চৌধুরী একজন কর্মচারীকে সঙ্গে দিয়ে ওই ওয়ার্ডে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশ করতে দেন। সেখানে কেউ কেউ মুখ খুললেও নাম-পরিচয় গোপন রাখার কথা বলেন। অন্যরা ভয়ে জানান, তারা কিছুই দেখেননি। এ সময় হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, কোনো ইন্টার্ন চিকিৎসক হাসপাতালে নেই। প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন করে চিকিৎসক দেখা গেছে।
ওই ওয়ার্ডের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দু’জন রোগী জানান, রোগীর চিকিৎসা নিয়ে কথাকাটাকাটির পর হঠাৎ করেই একদল ইন্টার্ন চিকিৎসক এসে ওই রোগীর দুই আত্মীয়কে মারপিট করতে করতে একটি রুমে নিয়ে যায়। এসময় তারা চিৎকার করতে থাকেন। মারপিটের ঘটনার সময় আমরা ভয়ে ওয়ার্ড ছেড়ে বাইরে যাই। বেশ কিছুক্ষণ মারপিটের ঘটনা ঘটে। আমাদের বলা হয়, কেউ বাইরের কাউকে এসব বিষয় বললে বিপদ আছে। ঘটনার পর গণমাধ্যমকর্মীদের আড়াল করতে রোগী মাহেলাকে সিসিইউতে সরিয়ে নেয়া হয়।
আহত রুম্মান হোসেন শান্ত জানান, তার দাদি মাহেলা বেওয়ার শরীরে রক্ত দেয়া হচ্ছিল। রক্ত শেষ হলেও তা খুলে দেয়া হয়নি। বিষয়টি একজন মহিলা ডাক্তারকে বলতে গিয়ে আপু বলে ডাক দিয়েছিলাম। এতে তিনি ও তার সঙ্গে থাকা অন্য একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক মাইন্ড করেন। এ কারণেই আমার কলার চেপে ধরা হয়। তারপর মারপিট করেন। একটু পরই একদল ইন্টার্ন চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীরা ছুটে আছেন। তারা আমাকে ও আমার বাবাকে বেঁধে কিলঘুষিসহ রড দিয়ে মারপিট করতে থাকেন। আমরা চিৎকার করলেও কেউ বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। পরে অসুস্থ অবস্থায় প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে জোর করে আমাদের জয়পুরহাট সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং বলা হয় বগুড়ার কোনো ক্লিনিক বা হাসপাতালে যেন চিকিৎসা নেয়া না হয়। শান্ত আরও জানান, বৃহস্পতিবার রাতেই বগুড়া শজিমেক হাসপাতাল থেকে তার মুমূর্ষ দাদিকে ছাড়পত্র দেয়া হয়। পরে জয়পুরহাটে নেবার পথে তিনি মারা যান।
শুক্রবার সকালে হাসপাতালের উপ-পরিচালক নির্মলেন্দু চৌধুরী জানান, রোগীর দুই স্বজন মহিলা চিকিৎসককে ইভটিজিং করায় এবং অশালিন ভাষায় কথা বলায় বাকবিত-ার এক পর্যায়ে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের উপর তারা হামলা চালালে ৩ জন ইন্টার্ন চিকিৎসক আহত হন। তবে তিনি তাদের নাম বলতে পারেননি।
তিনি আরও জানান, রোগী মাহেলা বেওয়াকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। হাসপাতালের উদ্ভূত ঘটনা নিয়ে পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. গোলাম রসুল তার অফিসে জরুরি সভা ডেকেছেন।
উপ-পরিচালক নির্মলেন্দু চৌধুরী আরও জানান, রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় স্বজনরা স্বেচ্ছায় রিলিজ নিয়েছেন। ইন্টার্নরা কর্মবিরতি ঘোষণা করেননি তারা কাজ করছেন। তিনি বলেন হাসপাতালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এখন থেকে রোগীর সঙ্গে পাশসহ দু’জনের বেশি কেউ থাকতে পারবেন না। এছাড়া সন্ধ্যার পর অতিরিক্ত আনসার নিয়োগ থাকবে।
উল্লেখ্য, এর আগে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার কোনাগাতি গ্রামের আলাউদ্দিন সরকার হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে তার ছেলে আবদুর রউফ শজিমেক হাসপাতালে আসেন। এরপর তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা তাকে ও তার আত্মীয়দের মারপিট করে। তখন ওই ঘটনায় নারী ইন্টার্ন চিকিৎসককের ইভটিজিং-এর অভিযোগ আনা হয়। ওই ঘটনার পর আলাউদ্দিনও চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ইন্টার্ন চিকিৎসকরা ধর্মঘট ডাকেন। ওই ঘটনাতেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীর স্বজনদের বিরুদ্ধে নারী ইন্টার্নকে ইভটিজিং-এর অভিযোগ এনেছিলো।