ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ গত ২৩ অক্টোবর যুক্তরাষ্টের সিনেটে অনুষ্ঠিত ১১৫ তম কংগ্রেসের প্রথম সেসনে বাংলাদেশের উপর আলোচনায় অংশ নিয়ে মার্কিন সিনেটের প্রভাবশালী সদস্য ভারমাউন্টের সিনেটর প্যাট্রিক লেইহে বলেন- "বেশ কয়েক বছর যাবত বাংলাদেশ সরকার কর্তৃপক্ষের সাথে আমাদের স্টেট ডিপার্টমেন্টের আলোচনায় অনেকের মত আমিও শেখ হাসিনা সরকারের বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনী , বিশেষ করে এলিট ফোর্স র্যাপিড একশান ব্যাটেলিয়ান (র্যাব) এর মাধ্যমে গুম, গণ গ্রেফতার, পক্ষপাতমূলক বিচার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং আইনের শাসনের লঙ্ঘন নিয়ে আমাদের গভীর উদ্বেগের কথা জানিয়েছি।
কিন্তু অন্যান্য সংস্থা কর্তৃক একই ধরণের অনুসন্ধান এবং আপিলের মতো, আমার উদ্বেগগুলোও বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষ হয় সরাসরি অস্বীকার করেছে, নয় বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিয়েছে; তারা এমনকি সরাসরি মিথ্যা তথ্য দিয়েও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
দায়িত্ব অস্বীকার করার এই অপচেষ্টার পরও এটা নিঃসন্দেহে সত্য যে, বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রায়শই আইনের শাসন লঙ্ঘন করে চলেছে। তাদের এই আচরণ এতই মজ্জাগত হয়ে উঠেছে যে, প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারকে 'রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অপরাধ সংঘঠনকারীদের সরকার' হিসেবে বর্ননা করলেও অত্যুক্তি হবে না।
সরকার সসবসময়ই এই ধরনের অভিযোগগুলো প্রত্যাখ্যান করে বলে যে- যারা গুম হয়ে গেছে, তারা জঙ্গিদের দ্বারা অপহৃত হয়েছে বা চরমপন্থী গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছে অথবা দাবি করছে যে তাদের অবস্থান সরকারের কাছে অজানা। সমস্যা হচ্ছে, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষদর্শীরা এইসব অপহরণকারীদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, বিশেষ করে সবচেয়ে কুখ্যাত র্যাব হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের সর্বশেষ দেশওয়ারী প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে লেখা হয়েছে- "মানবাধিকার সংস্থাসমূহ এবং মিডিয়া থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা গুম ও অপহরণের ঘটনা নিয়মিতভাবে ঘটছে। এই ধরণের ঘটনা প্রতিরোধ বা তদন্তে সরকারের চেষ্টা খুবই অপ্রতুল। গুম সংক্রান্ত জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ গত ৯ মার্চ তারিখে সরকারকে 'দেশে ভয়াবহ হারে গুমের সংখ্যা বৃদ্ধি'র বিষয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে এবং ১৮মে তারিখে এই সংক্রান্ত ৩৪ টি সমাধানবিহীন ঘটনার বিষয়ে সরকারকে পুনরায় তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে কিন্তু সরকারের তরফ থেকে কোন উত্তর পাওয়া যায়নি। গুমের ঘটনাগুলোর পর অপহৃতদের কাউকে কোনরূপ মামলায় অভিযুক্ত না করেই ছেড়ে দেয়া হয়েছে, কাউকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে, কারো কারো মৃতদেহ পাওয়া গেছে আর বাকীদের কখনোই খুঁজে পাওয়া যায়নি।"
বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাস্টডিতে নির্যাতনের বিষয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্ট উল্লেখ করেছে: "সংবিধান এবং আইন অনুযায়ী নির্যাতন ও অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক এবং অবমাননাকর আচরণ অথবা শাস্তি নিষিদ্ধ থাকার পরও স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও মিডিয়ার প্রতিবেদন হতে জানা যায় যে, র্যাব, গোয়েন্দা সংস্থা এবং পুলিশ আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় নির্যাতন এবং শারিরিক ও মানসিক দুর্ব্যবহার করে থাকে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তথাকথিত জঙ্গীদের নিকট থেকে নির্যাতনের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকলেও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ অনুযায়ী এই বাহিনীগুলো সরকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের দমন নিপীড়নের জন্যও একইভাবে নির্যাতন করে থাকে। প্রতিবেদন অনুযায়ী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের হাতে আটককৃতদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন থেকে শুরু করে, পেটানো, হাঁঠুতে গুলি করে পঙ্গু করে দেয়া, বৈদ্যুতিক শক দেয়ার পাশাপাশি ধর্ষণ এবং যৌন নিপীড়নের মত ন্যাক্কারজনক ঘটনাও ঘটায়। দু'টি শীর্ষ মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমান বছরের প্রথম নয় মাসে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনের ফলে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনটি এই বছরের শুরুতে প্রকাশিত হওয়ার পর পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়নি। গত সপ্তাহে ঢাকায় একটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের সাতজন শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের অবস্থান, আটকের অবস্থা এবং তাদের বিরুদ্ধে কি অভিযোগ সেটি এখনো পর্যন্ত রহস্যময়।
ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অন্যান্য খ্যাতনামা মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরা এই গুরুতর পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে; তবে প্রধানমন্ত্রী ওয়াজেদের সরকার এসব বস্তুনিষ্ঠ অভিযোগকে মিথ্যা এবং দেশের সার্বভৌমত্বের উপর বহি:শক্তির হস্তক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের এইসব আচরণ কেবলমাত্র আইনের শাসনকেই লঙ্ঘন করে না, এগুলো গণতন্ত্রের জন্যও হুমকীস্বরূপ। বাংলাদেশকে সহিংস চরমপন্থীদের একটি গুরুতর সমস্যা সব সময়ই মোকাবেলা করতে হয়, যা কার্যকরভাবে মোকাবেলা করা উচিত। কিন্তু শান্তিপূর্ণ মতপ্রকাশ এবং সরকারের নীতি, দুর্নীতি এবং পুলিশের অসদাচরণের নিন্দা করাকে যদি জঙ্গীবাদের সাথে তুলনা করা করা হয় এবং তা দমনের জন্য যদি ভয়-ভীতি প্রদর্শন, গণগ্রেফতার এবং গুম করার পথ বেছে নেয়া হয়, তাহলেই বরং চরমপন্থা বৃদ্ধি পাবে এবং গণতন্ত্রের ক্ষতি হবে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সরকার কর্তৃপক্ষ কয়েক ডজন গুমের ঘটনার বিষয়ে বাংলাদেশের সরকারকে সাড়া দেবার জন্য আহবান জানিয়েছে এবং এইসব গুমের ঘটনার গ্রহনযোগ্য তদন্ত ও এসব অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের যথাযথভাবে শাস্তি না দেয়া পর্যন্ত র্যাবকে চিরতরে বিলুপ্ত করা এবং এহেন অপরাধের সাথে জড়িত অন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে সাময়িকভাবে প্রত্যাহার জন্য আহবান জানিয়েছে। আমিও ঐ আহবানের সাথে গলা মেলাচ্ছি এবং এই বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের এই সকল বাহিনীর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে কোন ধরনের সহায়তা প্রদানের বিপক্ষে আমার অবস্থান ঘোষণা করছি।