ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের যে সমঝোতা চুক্তি হয়েছে বৃহস্পতিবার তাতে তৃতীয় কোনো পক্ষের সম্পৃক্ততা নেই।
জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ভারত কিংবা ইউরোপিয় ইউনিয়ন এমন কোনো পক্ষের সম্পৃক্ততা ছাড়া এধরনের চুক্তি বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের এর আগে হয়েছে এবং নানা অজুহাতে স্বল্প সংখ্যক রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেওয়ার মাঝে এধরনের প্রক্রিয়া থমকে গেছে। এবারো বহুপক্ষীয় উদযোগ ছাড়া সমঝোতা হয়েছে দু’দেশের মধ্যে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যে সমঝোতা হয়েছিল তা থেকে এক চুল সরতে রাজি নয় মিয়ানমার। আগের ওই চুক্তিতে রাখাইন থেকে চলে আসা রোহিঙ্গাদের পরিচয় প্রমাণ সাপেক্ষে তাদের ফেরত নেওয়ার কথা ছিল।
তবে সব জেনে শুনে বাংলাদেশ কেনো এধরনের একটি আই ওয়াশ চুক্তি করতে রাজি হলো তা বিশেষজ্ঞদের বোধগম্য নয়।যেখানে এবিষয়ে জাতিসংঘের সাম্প্রতিক ভোটাভুটিতে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ বাংলাদেশের প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে ,সেই পরিস্থিতিতে তড়িঘড়ি করে এই আত্মঘাতি চুক্তি করার কোনো প্রয়োজন ছিলোনা বলে সংশ্লিষ্টগন মনে করেন।
নতুন যে সমঝোতা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে আগামী দুই মাসের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার কার্যক্রম শুরু হবে। মিয়ানমার এধরনের অঙ্গীকার করলেও কবে এধরনের প্রক্রিয়া শেষ হবে সে ব্যাপারে কোনো সময়সীমার বাধ্যবাধকতা নেই। মিয়ানমারের পক্ষ থেকে একটি ফর্ম থাকবে যেখানে রোহিঙ্গাদের বেশ কিছু তথ্য পূরণের পর তা পাঠাতে হবে মিয়ানমারে। মিয়ানমারের ইমিগ্রেশন বিভাগ তাতে ছাড়পত্র দিলে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ রাজি থাকলে এখন এ ফর্ম পাঠাবে মিয়ানমার।
এদিকে মিয়ানমারের এক শীর্ষ ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা বলেছেন, এই সমঝোতায় কোনো ধরনের আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা মানবে না তার দেশ।
বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে বারবার বলা হচ্ছে ১৯৯২ সালের পরিস্থিতি আর এবার রোহিঙ্গাদের এদেশে আশ্রয় নেয়ার পরিস্থিতি এক নয়। হত্যাযজ্ঞ, নির্বিচারে গণধর্ষণ, লুটপাট, বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগের মুখে এক কাপড়ে কোনো রকমে প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা এসে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। তাদের কাছে কোনো কাগজপত্র বা তথ্য প্রমাণ থাকার কথা নয় এ বিষয়টি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী একাধিকবার বলেছেন।
মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের দেশটির ভাষায় রাখাইন রাজ্যের বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের পদ্ধতিগতভাবে যাচাই ও গ্রহণ করার জন্যে বেশ কিছু নির্দেশক নীতি জুড়ে নির্ধারিত ফরম সরবরাহ করবে যা পূরণ করা অনেকাংশেই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।
বিবিসি বাংলাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে যে সমঝোতা চুক্তি করেছে তা কোনো দ্বিপক্ষীয় চুক্তি নয়, এমনকি কোনো ধরনের বোঝাপড়া নেই এ চুক্তিতে। এটি যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ। এর একটি ‘ক্লাসিক’ উদাহরণ হচ্ছে যে নির্দিষ্ট ফরম পূরণের কথা বলা হচ্ছে তা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে না নেয়ার প্রয়াস। অতীতেও মিয়ানমার এধরনের কালক্ষেপণ করেছে। সুতরাং এবার আশান্বিত হওয়ার কিছু নেই। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জাতিসংঘের বা কোনো তৃতীয় পক্ষের সম্পৃক্ততায় দু’দেশের মধ্যে সমঝোতা হয়নি।
বিবিসি বাংলাকে সি আর আবরার আরো বলেন, বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করে ঠিকই করেছে। তবে এর বাইরে জাতিসংঘের উপর বেশি আশা না করে যে সব দেশ রোহিঙ্গা নিধনকে ‘জেনোসাইড’ বলছে তাদেরকে সাথে নিয়ে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে বাংলাদেশকে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার দিপাক্ষিকভাবে সমঝোতা চুক্তি করে বিষয়টি নিয়ে তাদের ওপর চাপ থেকে পরিত্রাণ পেতে চাইছে।অতীতের মতই মিয়ানমার রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কালক্ষেপণের চেষ্টা করছে। এভাবে স্বেচ্ছায়, মর্যাদা ও নিরাপত্তার সঙ্গে রোহিঙ্গারা তাদের দেশে ফিরে যেতে পারবে না।