“পীর সাহেব মুরিদবিহীন একজন নি:স্ব মানুষ যিনি প্রচন্ড হতাশার মাঝে ডুবে আছেন।। আমি লক্ষ্য করেছি, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে কথা বলে অনেকেই জাতে ওঠার চেষ্টা করেন।। পীরের ভাষায় 'কুকুর' হলেও তারা দেশেরই সন্তান, ভিনদেশী প্রভুদের ক্রীতদাস নয়।।”
ব্যারিস্টার আবু সায়েম, লন্ডন নভেম্বর ২৬, ২০১৭: ইতিহাস কিন্তু ভিন্ন কথাও বলে, "আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে পারি কিন্তু আত্মপ্রতারণাও করতে পারি যখন নিজেদের মনোষ্কামনা পূরণ করতে আমরা অতীত থেকে সুবিধামতো সাবুদ উপস্থাপন করি।" মার্গারেট ম্যাকমিলানকে ধন্যবাদ তিনি ইতিহাস ফেরি করে বেড়ানো কিছু নকল মানুষের জন্য তার একটি লেখাতে উপযুক্ত এ উদ্ধৃতিটি ব্যবহার করেছেন।
যুদ্ধ, শান্তি ও ইতিহাসের ওপর মার্গারেটের অসাধারণ কিছু কাজ আছে, তবে 'ইতিহাসের ব্যবহার ও অপব্যবহার' শিরোনামে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণী অধ্যাপক ও সমকালীন সময়ের প্রখ্যাত এ ইতিহাসবিদের একটি লেখা বহুদিন আমার মনে গেঁথে থাকবে। অন্তর্গত দর্শনের বিবিধ বিষয়ে একমত না হলেও তার নৈর্ব্যক্তিক কিছু বক্তব্যের যথার্থতা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
The Uses and Abuses of History বইতে মার্গারেট লিখেছেন, "লোকেরা যখন 'প্রকৃত' ইতিহাসের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে, যেটি তারা বারংবারই করে, তখন তারা মূলত নিজেরা যে ইতিহাস চায় ও পছন্দ করে সেটিকেই বোঝায়।" তিনি আরও লিখেছেন, "ইতিহাস মানে অতীতকে স্মরণ করা, কিন্তু এটির আরেক অর্থ হচ্ছে আমরা যা ভুলতে চাই তা।" মার্গারেট ম্যাকমিলান রাশিয়া, চায়না, অ্যামেরিকাসহ আরও বহু দেশের উদাহরণ টেনে দেখিয়েছেন কালভেদে কীভাবে আসল ইতিহাসের বিকৃতি ঘটে। ইতিহাসকে তিনি ভৌগলিক ও সময়ানুক্রমিকভাবে পর্যালোচনার মাধ্যমে প্রমাণের চেষ্টা করেছেন বিবেকবর্জিতদের হাতে ইতিহাস কতটা বিপজ্জনক হতে পারে।
আমার আজকের লেখার উপজীব্য হালের এমনই এক বিবেকবর্জিত ইতিহাসবিদ যিনি সাধ ও স্বার্থের সংমিশ্রণে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক নসিহত করেছেন। আমরা চাইনি, কিন্তু তিনি গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল সেজে জানিয়েছেন, "ইতিহাসের শিক্ষাই হচ্ছে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেন না।"
ইতিহাস বলে, পীর হাবিবের স্বরূপ উত্থান ঘটেছিলো ১/১১'র অন্ধকার যুগে। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে আমরা যখন দেশেবিদেশে লড়াই করছিলাম তখন মঈন-ফখরদের স্তাবক হয়ে ইতিহাস রচনায় ব্যস্ত ছিলেন স্বৈরাচার এরশাদের পরীক্ষিত এ গুণগ্রাহী। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে নিয়মিত লেখালিখি করতে গিয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে তখন তুলাধুনা করলেও কৌশলে তিনি গায়ে আঁচড় পড়তে দেন নি এরশাদের। ২০১২ সালে এসেও পীর হাবিব এরশাদকে বাংলাদেশের ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। নিজস্ব কলামে পীর সাহেব তখন লিখেছিলেন, "গণঅভ্যুত্থানে পতিত সেনাশাসকরা দুনিয়ার কোথাও ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। এরশাদ এক্ষেত্রে বিরল। কারাগারে বসেই পাঁচটি করে আসনে বিজয়ী হয়েছেন দু'বার। তাকে জেলে নেওয়া হয়েছে। তাকে এবং পার্টিকে মামলায়-নির্যাতনে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। দল ভেঙেছে দুবার। দল ছেড়ে চলে গেছেন অনেকে। তবুও তিনিই দেশের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতা। ইতিহাসের চাকাকে উল্টে দিয়ে এরশাদ জীবনের পড়ন্ত বেলায় প্রধানমন্ত্রী হয়ে মসনদে ফিরতে চান।"
এতটা গুরুত্বের সাথে এরশাদকে নিয়ে আর কেউ কখনো লেখার সাহস দেখিয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না। জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনের বাজারে অপরিহার্য করে তুলতে এই সেদিনও পীর হাবিব কলম হাতে নিয়েছেন। ৪ নভেম্বর ২০১৭ সংখ্যার পূর্বপশ্চিম পত্রিকা 'এরশাদকে রাষ্ট্রপতি, জাতীয় পার্টিকে ১০০ আসন: বিএনপির প্রস্তাব নিয়ে এক নেতা বেকায়দায়' শিরোনামের প্রতিবেদন ছাপিয়ে বোঝাতে চেয়েছে, বিএনপি নেতৃত্ব এরশাদের সাথে গাঁটছড়া বাঁধতে মরিয়া কিন্তু এরশাদ তাতে সায় দিচ্ছে না! এতবড় মিথ্যাচারও কেউ করতে পারে? আজব বিষয় হচ্ছে, 'বিশেষ প্রতিবেদক'র বরাত দিয়ে ছাপানো খবরটিতে না প্রকাশিত তথ্যের কোন উৎস বর্নণা করা আছে, না রয়েছে কোন বিশ্বাসযোগ্য রেফারেন্স। পীর হাবিবের মোটিভ বুঝতে সদ্যভূমিষ্ঠ একটি শিশুরও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। আমি হলফ করে বলতে পারি, হালে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার পরম শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে নিজেকে উপস্থাপিত করলেও পীরের আসল কিবলা ভিন্নমুখী। মূলত পতিত স্বৈরাচার হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে টিকিয়ে রাখতেই পীরালি সাংবাদিকতার এ প্রাণান্তকর অধ্যবসায়। তিনি জানেন, জাতীয় পার্টির একমাত্র আশ্রয়স্থল হচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন 'মহাজোট'। কিন্তু সে জোটেও যথাযথ মূল্যায়ন পেতে হলে বাংলাদেশের রাজনীতির সর্বকালের সেরা ক্লাউনকে বিএনপি ও ২০দলীয় জোটের কাছে 'গুরুত্বপূর্ণ' উপাদান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। দরকষাকষির মজলিশে এরশাদ তখন তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসতে পারবেন আর আখেরে পীরেরও স্বার্থসিদ্ধি হবে। বলাবাহুল্য, এ কূটিল আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে হলে এরশাদে নিস্পৃহ বিএনপিকেই সুড়সুড়ি দিতে হবে, পীরের তা অজানা নয়।
শখের ঐতিহাসিক পীর হাবিবুর রহমান তাই সম্প্রতি বিএনপি ও এ দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে খোঁচাখুঁচি শুরু করেছেন। দিন গুনলে সামনে নির্বাচন, আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা এখন মাইক্রোস্কোপের ছিদ্র দিয়ে পরিমাপ করতে হয়, বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে ঘিরে প্রতিদিন বাড়ছে জনগণের বাঁধভাঙা উচ্ছাস-উদ্দীপনা, প্রশাসন-পুলিশ-সেনাবহিনীতে শিথিল হয়ে আসছে অনির্বাচিত সরকারের নিয়ন্ত্রণ, নিয়ম মানছে না কেউ – পরিস্থিতির এহেন ভয়াবহতায় পীরের চোখের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। ডুবন্ত নৌকা তথা ভাঙা লাঙ্গল বাঁচাতে তিনি তাই টার্গেট করেছেন দক্ষিণ এশিয়ার এ মুহূর্তের সবচেয়ে দুই জনপ্রিয় ও আলোচিত রাজনীতিবিদ বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে।
বিএনপি সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের ইতিহাসচর্চা পীরের ভালো লাগে নি। তারেক রহমান ইতিহাসের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত দ্বারা প্রমাণ করেছেন, জিয়াউর রহমানই ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। গালিগালাজে জর্জরিত করলেও আজব্দি তার দাবীকে কেউ গঠনমূলক সমালোচনায় চ্যালেন্জ করতে পারে নি। কিন্তু এতেই ভীষণ গোস্বা হয়েছেন পীর সাহেব। রাষ্ট্রপিতা শহীদ জিয়াউর রহমানকে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক ও প্রথম প্রেসিডেন্ট মানতে একেবারেই নারাজ। ২২ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে বাংলাদেশ প্রতিদিনে 'তারেক বিএনপির বোঝা না আওয়ামী লীগের শত্রু???' শিরোনামে প্রকাশিত লম্বা একটি নিবন্ধে তিনি তীব্র বিষোদগার করেছেন তারেক রহমান সম্পর্কে। পীর ফতোয়া জারি করেছেন, তারেক রহমান দল ও দেশের রাজনীতির জন্য 'বোঝা' এবং প্রকারান্তরে বিএনপি নেতাকর্মীদের উস্কানোর চেষ্টা করেছেন যেন তারা তারেক রহমানকে বাদ দিয়েই আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।
যেসব অশ্রাব্য বিশেষণে পীর হাবিব ২২ তারিখের লেখায় তারেক রহমানকে আক্রমণ করেছেন রেফারেন্স হিসেবেও সেগুলোর পুনরুক্তি করা শিষ্টাচারবহির্ভূত। তবে পীর যদি কেবল তারেক রহমানের বিরুদ্ধেই লিখতেন তাহলে হয়তো আমি তার প্রত্যুত্তরে যেতাম না। আমি লক্ষ্য করেছি, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে কথা বলে অনেকেই জাতে ওঠার চেষ্টা করেন। বাংলাদেশ ও বিএনপির ভবিষ্যৎ কর্ণধারকে জড়িয়ে একটু প্রলাপ বকলে বা খানিকটা মাতলামো করলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসা যায়, সুতরাং গুটিকতক খোজা মানব এর সুযোগ নেবে তাতে আর সন্দেহ কি। ভার্চুয়াল পোর্টালের যুগে যার যখন খুশি যা ইচ্ছে লিখে ফেললে জবাবদিহি করতে হয় না, পীর হাবিবও তা-ই করেছেন। সেসবে আমার এতটুকু আগ্রহ নেই। কিন্তু পীর সাহেব তিনদিন পর অর্থাৎ ২৫ নভেম্বর তার পূর্বপশ্চিমে আবারও দোয়াত খুলে বসেছেন এবং এবার তিনি তারেক রহমানের অনুসারীদের 'প্রভুভক্ত পোষা কুকুর' বলে অভিহিত করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। তথাপিও যদি চুপ মেরে থাকি, যদি সত্য প্রকাশে তারপরও ইতস্তত করি, তাহলে নিজের বিবেকের কাছেই অপরাধী বনে যাবে, তাই কলম হাতে নিয়েছি। ইতিহাস যে একপেশে হয় না, ইতিহাসের যে এপিঠ-ওপিঠ দু'পিঠ থাকে তা পীর সাহেবদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেই আমার এ লেখার অবতারণা।
২২ নভেম্বর ও ২৫ নভেম্বরের দু'দুটি লেখায় পূর্বপশ্চিম সম্পাদক পীর হাবিবুর রহমান অজস্র তীর ছুঁড়েছেন জিয়াউর রহমান, বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান দিকে। তবে বোধগম্য কারণেই তার সর্বাধিক তীরের লক্ষ্যবস্তু ছিলো বিএনপির সেকেন্ড-ইন-কমান্ড। কিন্তু উদ্ভূত সকল মিথ্যাচারের যথাযথ উত্তর দিতে গেলে এবং ইতিহাস বিনির্মাণে পীরের আনাড়িপনা অথবা চতূরতার বিস্তারিত বর্নণা দিতে হলে এ লেখা তার স্বাভাবিক গতি হারাবে। আমি তাই তার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেই আজ নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখবো। বাকি বিষয়গুলোতে আশা করি ভিন্ন কোন সময়ে কথা বলা যাবে।
পীরালি ব্যাখ্যামতে, রাষ্ট্রপিতা শহীদ জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন নি এবং তিনি বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্টও ছিলেন না। আরও সহজভাবে তার দাবি হচ্ছে, মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন স্বাধীনতার প্রকৃত ঘোষক এবং তিনিই ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন সেক্টর কমান্ডার যিনি শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছেন কেবল। শেখ মুজিবুর রহমানের সীমাতিরিক্ত বন্দনা করতে গিয়ে পীর সাহেব লিখেছেন, "১৯৭১-এর পরাজিত বিশ্বমোড়লদের দলিল-দস্তাবেজ, নথিপত্রেও এ দেশের স্বাধীনতার মহানায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথাই ঠাঁই পেয়েছে, আর কারও কথা আসেনি।"
প্রয়াত শেখ মুজিব আমাদের স্বাধীনতার 'মহানায়ক' কিনা কিংবা তার ডাকেই স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছিলো কিনা অথবা আদৌ তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন কিনা বা কমের পক্ষে কখনো তা চেয়েছিলেন কিনা সে বিতর্কের সূত্রপাত এখানে আমি করবো না। কারো কারো চোখে তিনি যদি মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কও হন তাতে আমার বাদ সাধতে যাওয়াটা এ লেখার স্বার্থে নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু ইতিহাসের চুলচেরা পোস্টমর্টেম যদি ভিন্ন কিছু বলে আমার তখন নৈতিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় সেটা জনগণের কাছে তুলে ধরা। দেখা যাক, শুদ্ধ ইতিহাস আমাদের কী শেখায়।
এটা সর্বজনবিদিত যে, পীর হাবীব অন্ধ ভারতপূজারী একজন সাংবাদিক। প্রতিবেশী বৃহৎ দেশটির প্রতি তার বিশেষ অনুরক্ততার কথা কে না জানে? ২০১২ সালে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, "বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারত ঐতিহাসিকভাবে আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু। স্বাধীনতার পর থেকে ভারত হেঁটেছে উদার গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার পথে… ভারত আজ দুনিয়ার বুকে মাথা উঁচু করা চতুর্থ শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র… প্রতিকূল বৈরী স্রোতের বিরুদ্ধে জনগণের অব্যাহত সংগ্রামে বাংলাদেশ হাঁটছে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক পথে। আঘাত নানা সময়ে এলেও পথহারা হয়নি বাংলাদেশ ও তার জনগণ। বাংলাদেশের বন্ধু ভারতের বরেণ্য রাজনীতিবিদ অভিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জিও বলেছেন, গণতান্ত্রিক সমাজে সংলাপের বিকল্প নেই। সংলাপ এবং সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছার পরামর্শই তিনি দিয়েছেন।" একই বছরে ছাপানো ভিন্ন এক নিবন্ধে পীর লিখেছিলেন, "আজ রক্তে লেখা স্বাধীনতার এই পবিত্র মাসে গণতান্ত্রিক দুনিয়ার বৃহত্তম ভারতের রাষ্ট্রনায়ক প্রণব মুখার্জিকে সম্মান দিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে সম্মানিত করতে খালেদা জিয়া সংসদে যান। প্রণব মুখার্জি সংসদে যখন ভাষণ দেবেন তখন সংসদ নেতা শেখ হাসিনার সঙ্গে আপনিও টেবিল চাপড়ে অভিনন্দিত করবেন। সব সংসদ সদস্য একতালে টেবিল চাপড়াবেন। আমরা দেশের মানুষ আনন্দচিত্তে বলব, বাহ কী সুন্দর আমাদের সংসদ। আমাদের মহান সংসদের প্রতিনিধিরা। প্লিজ খালেদা জিয়া, প্রণব ভাষণ দেবেন। আপনি সংসদে যান। বর্জনের পথে হাঁটবেন না।"
প্রণব বাবু এবং ভারতের প্রতি পীরের যে হৃদয়াকুল করা মহব্বত তা আমাকে বিস্মিত করে ভিন্ন কারণে। প্রণব মূখার্জীদের প্রেসক্রিপশনে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে আওয়ামী লীগ; গণতন্ত্রের স্বাভাবিক চর্চার পথ রুদ্ধ করে তারা দেশকে ঠেলে দিয়েছে অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে; গণজাগরন মঞ্চের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়ে প্রণব বাবু দুদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন সেসময়; এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর নির্বাচন নামক প্রহসনও আদতে তাদেরই কারসাজি। এতদসত্ত্বেও পীর হাবিবদের মতো একচোখা বুদ্ধিজীবীরা ভারততোষণ নীতিকেই বেছে নিয়েছেন তাদের জীবনজীবিকার পাথেয় হিসেবে, এ নিয়েও আমার কোন হতাশা নেই। ইতিহাস বলে, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিয়ে যারা নিজভূমে হাসিমুখে দাসত্ব বরণ করে, সে দালালরা হয় মাটিরই অভিশপ্ত সন্তান। মীর জাফর, জগৎ শেঠ, লেন্দুপ দর্জি কিংবা হামিদ কারজাই – এরা ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা ছিলো না, যার যার মাতৃভূমিতেই তাদের জন্ম হয়েছিলো। যেমনটি লিখেছি, আমার ক্ষোভ অন্যত্র আর তা হলো পীর সাহেবের দ্বিচারিতা।
সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, কলকাতায় অবস্থিত ভারতীয় জাতীয় জাদুঘরে জিয়াউর রহমানের ছবির পাশে পরিচয় লেখা আছে 'বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি'। সেখানে আরও লেখা রয়েছে, "তিনিই (১৯৭১ সালে) জাতির উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা প্রথম ঘোষণা করেন।" এখন কী বলবেন পীর হাবিবুর রহমান? তারেক রহমান না হয় 'ঔদ্ধত্য' দেখিয়েছেন রাষ্ট্রপিতাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক ও প্রথম প্রেসিডেন্ট বলে ইতিহাস রচনা করে, কিন্তু প্রণব বাবুদের হাঁটুর উপরিভাগ চাটতে চাটতে ক্লান্ত পীরদের কি মানাবে ভারতস্বীকৃত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেও চ্যালেন্জ করা? সেটা কি তাদের জন্য আত্মপ্রতারণার সামিল হয়ে যাবে না? The Uses and Abuses of Hostory বইতে মার্গারেট ম্যাকমিলান এমন প্রতারকদের হাতেই ইতিহাসকে বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
না আলোচনা করলেও হয়তো হতো, তবে নিতান্তই প্রাসঙ্গিক বিধায় একটু বলার লোভ সামলাতে পারছি না। পীর সাহেব লিখেছেন, জিয়াউর রহমান কখনো তার জীবদ্দশায় দাবি করেন নি তিনি স্বাধীনতার ঘোষক অথবা বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। আমি পীর-আউলিয়া নই, ধ্যানজ্ঞানে তথ্য পাই না, কিন্তু যতটুকু লেখাপড়া করে শিখেছি তাতে জানি অ্যাব্রাহাম লিংকনও বেঁচে থাকতে কখনো নিজমুখে বলেননি তিনি অ্যামেরিকান ইউনিয়নের রক্ষাকর্তা কিংবা মুক্তিকামী দাসদের উদ্ধারক, জর্জ ওয়াশিংটন বা থমাস জেফারসনও নিজেদের অ্যামেরিকান কনফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে জাহির করেন নি। মানবতার মুক্তিদূত নেলসন ম্যান্ডেলার কোন বক্তব্যেও শুনিনি তিনি নিজেকে আধুনিক দক্ষিণ আফ্রিকার জনক বলে দাবী করেছেন। কিন্তু লোকেরা সত্যিকারের ইতিহাস জানে ও মানে। পীর হাবিব আর একটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন, "বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সেদিন স্বভাবসুলভ কায়দায় এক জায়গায় বলেছেন, জিয়ার সেই স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ আমাদের উজ্জীবিত করেছিল। কিন্তু এ নিয়ে বাড়াবাড়ির কী আছে?" অর্থাৎ "I Declare Independence of Bangladesh." উচ্চারণ করেও পীরের বয়ানে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণার পাঠক! এ বিষয়টি বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের প্রতি আমাকে বেশ উৎসুক করে তুলেছে। বহু ঘটাঘাটি করেও আমি আজতক এ ধরণের কোন ঘোষণার পাঠক পাইনি যার কন্ঠে শোনা গেছে "I Declare Independence…" আমাদের চোখের সামনে সর্বশেষ স্বাধীনতার ঘোষণাটি এসেছে স্পেনের ক্যাটালনিয়া থেকে। বিবিসি, সিবিএসসহ আন্তর্জাতিক সকল মিডিয়া খবর প্রচার করেছে, ক্যাটালনিয়ার পার্লামেন্ট সে দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। পাঠক ও ঘোষকের বিভাজনে এখানে মিডিয়া পালন করেছে ঘোষকের ভূমিকা। জিয়াউর রহমান যদি শেখ মুজিবের ঘোষিত স্বাধীনতার খবরই পাঠ করতেন তাহলেতো কমন সেন্সই বলে তিনি বলতেন, "শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।" পাঠক হলে শহীদ জিয়া নিশ্চয়ই বলতেন না, "আমি, মেজর জিয়া, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।" অনেক জটিল বিষয়ের সমাধান খুব সহজ, তার জন্য বেশি জ্ঞানী হতে হয় না। মুখে মুখেই বহু বড় অংকের উত্তর বের করে ফেলা যায়, দরকার শুধু কমন সেন্স। দুর্ভাগ্যের বিষয়, পীরতত্ত্বে আক্রোশ যতটা ফুটে উঠেছে, কমন সেন্স ততোটা নয়।
পীর হাবিবুর রহমান বাংলাদেশের কোটি মানুষের প্রিয় নেতা, তৃণমূল রাজনীতির প্রবক্তা, সমৃদ্ধ বাংলাদেশের রূপকার, পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে অশ্রাব্য ভাষায় আক্রমণ করে চলেছেন যার পুনরুক্তিও আমার রুচিশীলতায় বাধে। সুস্থ মানসিকতার কোন সাংবাদিকতায় এমন ভাষার জন্ম হয় না; ভাড়া খাটলে যখন মানবের বিবেক লোপ পায়, কেবল তখনই কেউ তার অশিতে এরকম ছোরা শানায় আর প্রলাপ বকে, 'তারেক রহমান বিএনপি ও দেশের বোঝা'। তবে সুখের কথা, পীর সাহেব শুনে হয়তো আহত হবেন কিংবা নতুন ফন্দি আঁটবেন, পীরদের ঝাড়ফুঁকে জনগণ এখন আর বিশ্বাস করে না। দুনিয়া এগিয়েছে। মানুষ এখন ইতিহাসও জানে, ধান্দাবাজিও বোঝে। তথ্য আর তত্ত্বের মাঝে পার্থক্য কী সেটাও তাদের অজানা নয়। ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বলে যে একটা বিষয় আছে আর Parasite Journalism যে আমাদের সুন্দর-সুস্থ জীবনকে প্রতিদিন আষ্টেপৃষ্ঠে গিলে খাচ্ছে, সে পুস্তকও আমরা পাঠ করেছি। বিএনপি ও এ দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধ ষড়যন্ত্রমূলক নিবন্ধ পীর হাবিব আগেও বহু লিখেছেন। আমি উদাহরণ হিসেবে এখানে কেবল একটি উদাহরণ টানবো। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মানবজমিনে প্রকাশিত একটি লেখায় পীর সাহেব ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে বিএনপি সরে আসতে পারে। এমনকি দল ক্ষমতায় এলে তারেক রহমান দেশে ফিরবেন না এবং রাজনীতিতে প্রভাব রাখবেন না এমন আপার্তবৈপরীত শর্তেও রাজি হয়ে বেগম খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন। বিএনপিতে ভাঙন ধরাতে, নেতাকর্মীদের মনোবল ভাঙতে কত কী করে যাচ্ছে ভাড়াটিয়া লেখকরা, দেখতে দেখতে ঘেন্না ধরে গেলো। কিন্তু এসবে কল্কে মিলবে না।
তারেক রহমান ভালো কি মন্দ, দলের বোঝা নাকি আশীর্বাদ, জনতার নেতা না রাহুগ্রাস, বিএনপিতে তার প্রভাব থাকবে কি থাকবে না, সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে কেবল দলের নেতাকর্মীরা আর বাংলাদেশের আপামর জনগণ। ফয়সালার জন্য প্রয়োজন কেবল হাসিনাবিহীন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন যা হবে নির্দলীয় সরকারের অধীনে। কোন পীরের মন্ত্রে আমাদের ভাগ্য পরিবর্তন হতে দেবো না আমরা। পীর হাবিবকে অনুরোধ করবো, তারেক রহমানের পেছনে লেগে না থেকে বাংলাদেশের হারানো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য দোয়াদরূদ পড়ুন, তাবিজকবজ দিন। একবার শুধু আমরা আমাদের ভোটের অধিকার ফিরে পাই, তখন দেখবেন, জনতা তাদের কাঁধ থেকে কোন্ কোন্ বোঝা নামিয়ে ফেলে। বাংলাদেশের খেটে খাওয়া কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি জনতার কাছে তারেক রহমান নয় বরং আপনার মতো পরান্নভোজী পীরমুর্শিদ এবং আপনাদের প্রভুরাই সবচেয়ে ভারি বোঝা। এ বোঝা আমরা আর বহন করতে পারছি না। একটা সুন্দর নির্বাচন দিন, আমরা সব বোঝা নামিয়ে ফেলবো।
পীর হাবিবুর রহমানের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই নেই, দু'দুটি বাজে লেখা পড়ার পর জানার আগ্রহও লোপ পেয়েছে। কোথায় তিনি সাংবাদিকতার ওপর লেখাপড়া করেছেন অথবা আদৌ এ বিষয়ে তার অ্যাকাডেমিক কোন জ্ঞান আছে কিনা আমি তা জানি না। তবে ভাষা ব্যবহারে তিনি যে বিকারগ্রস্ততার পরিচয় দিয়েছেন তাতে অনুমান করতে পারি, নিজের একান্ত ভূবনে পীর সাহেব মুরিদবিহীন একজন নি:স্ব মানুষ যিনি প্রচন্ড হতাশার মাঝে ডুবে আছেন। তিনি তারেক রহমানের আশপাশের নেতাকর্মীদের আখ্যায়িত করেছেন 'প্রভুভক্ত পোষা কুকুর' নামে; বরেণ্য শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, প্রফেসর এমাজ উদ্দিনকে বলেছেন 'বিএনপির পোষ্য বুদ্ধিজীবি'। সুনির্দিষ্ট দুষ্ট লক্ষ্য না থাকলে এমনভাবে কেউ লিখতে পারে না। পীর হাবিব ইতিহাসকে দেখতে চেয়েছেন তার প্রভুদের চোখে। তাই তিনি 'সিলেক্টিভলি' ব্যবহার করেছেন বাংলাদেশের অতীত, মার্গারেট ম্যাকমিলানের ভাষায় 'অপব্যবহার'। কোন সন্দেহ নেই, ইতিহাস সম্পূর্ণ অরক্ষিত এই প্যারাসাইটদের হাতে।
পরিশেষে, পীর সমীপে নয়, কেবল পাঠকদের অবগতির জন্য জানিয়ে রাখছি, তারেক রহমান যাদের নিয়ে কাজ করেন তাদের অধিকাংশই দেশবিদেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ হতে কৃতিত্বের সাথে শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করে আসা। পেশাগত জীবনেও তারা সফল। তারা মেধাবী, রুচিশীল, উন্নতমনা ও দেশপ্রেমিক। পীরের ভাষায় 'কুকুর' হলেও তারা দেশেরই সন্তান, ভিনদেশী প্রভুদের ক্রীতদাস নয়। এদের অনেকের জীবনে এমনসব অর্জন রয়েছে যা কয়েক প্রজন্মের পীরালি দিয়েও লাভ করা যায় না।
উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতার পংক্তি মনে পড়ছে- "ভাতৃভাব ভাবি মনে, দেখ দেশবাসীগণে, প্রেমপূর্ণ নয়ন মেলিয়া। কতরূপ স্নেহ করি, দেশের কুকুর ধরি, বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া।।" বাংলাদেশের আমজনতা বিদেশী ঠাকুরদের পদলেহন করার চেয়ে দেশীয় 'কুকুর'দের প্রতি মমতা পোষন করতেই বেশি ভালোবাসে। পীর হাবিবরা ব্যতিক্রম।।
লেখক:
ব্যারিস্টার আবু সালেহ মো. সায়েম,
আইনজীবি, রাজনীতিবিদ এবং
বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা।
(কপিরাইট@ব্যারিস্টারআবুসায়েম)