ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বেসিক ব্যাংকের ভয়াবহ ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মুখোমুখি হয়ে নিজেকে সম্পূর্ন নির্দোষ দাবি করেছেন ব্যাংকটির বহুল আলোচিত সমালোচিত সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু।
জিজ্ঞাসবাদকালে বাচ্চু বলেছেন, তার অনেক টাকা আছে। তাই তিনি বেসিক ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করেননি। এছাড়া আবারও বেসিক ব্যাংকের দায়িত্বে ফেরার আগ্রহ জানিয়ে তিনি বলেছেন, দায়িত্ব পেলে ব্যাংক থেকে বের হয়ে যাওয়া টাকা পুনরুদ্ধার করে দেবেন তিনি।
জিজ্ঞাসাবাদে বাচ্চু ব্যাংকের সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ অনিয়মের ঘটনা জানেন বলে স্বীকার করেছেন। তবে এর জন্য তিনি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ফখরুল ইসলাম, তিনজন ডিএমডি ও তিনজন শাখা ম্যানেজারের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা তিনটি সিন্ডিকেটকে দায়ী করেন।
সোমবার দুজন পরিচালকের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের তদন্ত টিম দুদকের নবনির্মিত জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত টানা ৪ ঘণ্টা বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
বাচ্চু নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, তার অনেক টাকা আছে। তাই তিনি বেসিক ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করেননি। মেয়াদের শেষ পর্যায়ে এসে তিনি বুঝতে পারেন, বড় ধরনের লুটপাট হয়ে গেছে। তখন আর তার কিছু করার ছিল না।
এদিকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বাচ্চু সাংবাদিকদের বলেন, যেসব অভিযোগ তদন্তাধীন, সেগুলোর বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছে। আমি বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব হয়েছে উত্তর দিয়েছি। জানা গেছে, জিজ্ঞাসাবাদের আবদুল হাই বাচ্চুকে মঙ্গলবারও তলব করেছে দুদক।
উল্লেখ্য, বাচ্চুর আগে রোববার পর্যন্ত দুদক বেসিক ব্যাংকের সাবেক ১০ পরিচালককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। এর ধারাবাহিকতায় ১৯ নভেম্বর দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাচ্চুকে নোটিশ দেন। তবে তাকে না পেয়ে তার বাসায় ওই নোটিশ পৌঁছে দেন তারা।
রোববার ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের আরও দুই সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। তারা হলেন- সাবেক পর্ষদ সদস্য আনোয়ারুল ইসলাম ও আনিস আহমদ। দুদক কার্যালয়ে এ দিন তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন পরিচালক জায়েদ হোসেন খান ও পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের টিম।
জিজ্ঞাসাবাদে এ দুই সদস্য নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। তবে অনিয়ম করে ঋণ অনুমোদনের তথ্য-প্রমাণ দেখালে তারা ‘চুপ’ হয়ে যান।
এ দুই সদস্যসহ ঋণ অনিয়মের ঘটনায় এ পর্যন্ত পরিচালনা পর্ষদের সাবেক ৯ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হল।
অন্য যে সাতজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, তারা হলেন- কামরুন নাহার আহমেদ, অধ্যাপক কাজী আকতার হোসেন, সাখাওয়াত হোসেন, ফখরুল ইসলাম, একেএম কামরুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর আখন্দ সেলিম, শ্যামসুন্দর শিকদার। গত ২২ নভেম্বর থেকে দুদকের এই জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখা থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ঋণ অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণের অভিযোগ ওঠার পর তদন্তে নামে দুদক।
ঋণপত্র যাচাই না করে জামানত ছাড়া, জাল দলিলে ভুয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়াসহ নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বিধিবহির্ভূতভাবে ঋণ অনুমোদনের অভিযোগ ওঠে ব্যাংকটির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধান শেষে এ অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনায় ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ১২৯ জনকে আসামি করে ৫৬ মামলা করে দুদক। আসামিদের মধ্যে ২৬ ব্যাংক কর্মকর্তা এবং বাকিরা ঋণগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক জরিপ প্রতিষ্ঠানে যুক্ত।
তবে আসামির তালিকায় বাচ্চু বা ব্যাংকটির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের কেউ না থাকায় দুদকের ওই তদন্ত নিয়ে উচ্চ আদালত থেকে প্রশ্ন ওঠে।
চলতি বছর আগস্টে এক মামলার শুনানিতে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের মামলায় বাচ্চু ও পরিচালনা পর্ষদকে আসামি না করায় উষ্মা প্রকাশ করেন।
ব্যক্তি যেই হোক না কেন, এ ধরনের মামলায় আসামি করার ক্ষেত্রে ‘পিক অ্যান্ড চুজ’ যেন না হয়, সে বিষয়ে দুদককে সতর্ক করেন আদালত। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দুদক বেসিক ব্যাংকের পর্ষদের বিরুদ্ধে তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয়।
শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ আবদুল হাই বাচ্চুকে ২০০৯ সালে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয় হাসিনা সরকার। ২০১২ সালে তার নিয়োগ নবায়নও হয়। কিন্তু ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠলে ২০১৪ সালে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলামকে অপসারণ করার পর চাপের মুখে থাকা বাচ্চু পদত্যাগ করেন।