ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ২০১১ সালের জুলাইয়ে ২৭তম কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সিদ্দিকী নাজমুল আলম। এর পর থেকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকান্ড এবং জিয়া পরিবার বিদ্বেষী এই নাজমুল বিভিন্ন কার্যকলাপের মাধ্যমে ব্যপক পরিচিত হয়ে উঠেন।
ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক হওয়ার মাত্র এক বছর পরই একটি নবগঠিত বানিজ্যিক ব্যাংকের উদ্যোক্তা বনে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষের এ শিক্ষার্থী।
২০১৩ সালের শুরুর দিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া দ্য ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেডের ৩৯ ব্যক্তি উদ্যোক্তার একজনে পরিণত হন তিনি।
প্রতিষ্ঠাকালেই ব্যাংকটির ১০ লাখ শেয়ারের মালিক হন জামালপুরের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে ঢাকায় আসা সিদ্দিকী নাজমুল আলম। প্রতিটি শেয়ারের অভিহিত মূল্য ১০ টাকা হিসাবে ফারমার্স ব্যাংকের মূলধনে ছাত্রলীগের এ সাবেক সাধারণ সম্পাদক জোগান দিয়েছেন ১ কোটি টাকা।
তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা বলছেন, নেতা হওয়ার পর আর্থিকভাবে অস্বাভাবিক উত্থান হয় নাজমুলের। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে তার লাইফস্টাইলে। দামি গাড়ি, ফ্ল্যাট, শহর ও গ্রামে বহুতল বাড়িসহ বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন তিনি।
ছাত্রলীগের পদে থেকে দামি গাড়ি ব্যবহারের বিষয়ে প্রশ্ন উঠলে তখন সিদ্দিকী নাজমুল আলম সে সময় বলেছিলেন, তার বন্ধু মেহেদী হাসান গাড়িটি তাকে উপহার দিয়েছেন। ব্যাংকের শেয়ার কিনে উদ্যোক্তা হওয়ার বিষয়েও গতকাল একই কথা বলেন তিনি। বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত সিদ্দিকী নাজমুল আলমের সেলফোনে যোগাযোগ করা হলে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ফারমার্স ব্যাংকের শেয়ারের মালিক আমি নই। আমার বন্ধু মেহেদী হাসান ব্যাংকটির উদ্যোক্তা পরিচালক। সে আমার নামে ব্যাংকটিতে ১ কোটি টাকার শেয়ার কিনেছে। শেয়ারবাজার বা ব্যাংক বিষয়ে তেমন কোনো ধারণা নেই আমার।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে ফারমার্স ব্যাংকের পরিচালক মেহেদী হাসানের সেলফোনে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় ব্যাংকের উদ্যোক্তা হওয়ায় লঙ্ঘিত হয়েছে সংগঠনের গঠনতন্ত্রও। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের ৫ (গ) ধারায় বলা হয়েছে, বিবাহিত, ব্যবসায়ী ও চাকরিতে নিয়োজিত কোনো ছাত্র ও ছাত্রী ছাত্রলীগের নেতা হতে পারবেন না।
২০১১ সালের ১২ জুলাই থেকে ২০১৫ সালের ২৫ জুলাই পর্যন্ত ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্বে ছিলেন সিদ্দিকী নাজমুল আলম। সে সময়ে ব্যাংকের উদ্যোক্তা হয়ে গঠনতন্ত্রের এ ধারা লঙ্ঘন করেছেন তিনি।
১৯৯৮ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন বাহাদুর ব্যাপারী। এ বিষয়টিতে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অন্য কোনো কমিটির কোনো নেতা ব্যবসা করলেন, নাকি ব্যাংকের মালিক হলেন, তার জবাব ওই নেতাই ভালো দিতে পারবেন। তবে আমার মতে, প্রতিটি কমিটিরই গঠনতন্ত্র মেনে চলা উচিত।
সিদ্দিকী নাজমুল আলমের পরিচিতজনদের তথ্য অনুযায়ী, জামালপুরের পাথালিয়ার একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠেন তিনি। তার বাবা ছিলেন খাদ্য বিভাগের কর্মচারী। একতলা টিনশেডের একটি বাড়ি ছিল তাদের। জামালপুর জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হন সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজে। সেখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সিদ্দিকী নাজমুল আলম সবার বড়।
তার সমসাময়িক সময়ে দায়িত্ব পালন করা ছাত্রলীগের একাধিক নেতা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির হওয়ার পর সবসময়ই আর্থিক টানাপড়েনে থাকতেন নাজমুল। কিন্তু ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর বদলে যায় তার জীবন। সাদামাটা জীবন ক্রমেই হয়ে ওঠে বিলাসবহুল। দলীয় পদকে এক্ষেত্রে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছেন তিনি। উদ্যোক্তা হয়েছেন ব্যাংকেরও।
ফারমার্স ব্যাংকের উদ্যোক্তা হিসেবে নাজমুলের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে ব্যাংকটির নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান আজমত রহমান বলেন, ‘নাজমুলের আমাদের ব্যাংকের উদ্যোক্তা থাকার বিষয়টি আমার জানা নেই। তার ভাই ফারমার্স ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে আছেন।’ নাজমুলের ভাই কে— এ প্রশ্নের জবাবে আজমত রহমান বলেন, ব্যাংকের পরিচালক মেহেদী হাসানকে নাজমুলের ভাই বলে জানি। ফারমার্স ব্যাংকে এক কোটি শেয়ার রয়েছে উদ্যোক্তা পরিচালক মেহেদী হাসানের। প্রতিটি শেয়ারের অভিহিত মূল্য ১০ টাকা হিসেবে ব্যাংকটিতে তার বিনিয়োগ ১০ কোটি টাকা।
তবে ভাই নয়, মেহেদী হাসান তার বন্ধু বলে দাবি করেন সিদ্দিকী নাজমুল আলম। তিনি বলেন, ব্যাংকটিতে আমার নামে যে শেয়ার আছে, তার মালিকও মেহেদী হাসান। ১৯৯৯ সাল থেকেই আমার নামে সরকারকে কর দেয়া হয়। বংশের বড় ছেলে হিসেবে আমার চাচা আমার নামেই ব্যবসার লাইসেন্স নিয়েছিলেন। ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের করই আমার নামে পরিশোধ করা হয়েছে। এ কারণে আমার নামে শেয়ার কেনার সময় কোনো সমস্যা হয়নি।
তবে ফারমার্স ব্যাংকের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এ ছাত্রলীগ নেতা। তিনি বলেন, বাবুল চিশতীর অনিয়মের কারণেই ফারমার্স ব্যাংকের আজকের পরিস্থিতি।
মোট ৩৯ জন ব্যক্তি উদ্যোক্তা ও ১২টি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগে ৪০১ কোটি ৬১ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে ২০১৩ সালে যাত্রা করে নতুন প্রজন্মের বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংক। ব্যাংকের মোট ৪০ কোটি ১৬ লাখ ১০ হাজার শেয়ারের মধ্যে ৩৯ জন ব্যক্তি উদ্যোক্তার শেয়ার ২৯ কোটি ৩৬ লাখ ১০ হাজার। প্রতিটি শেয়ারের অভিহিত মূল্য ১০ টাকা হিসেবে ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ রয়েছে ২৯৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা, যা ব্যাংকটির মোট শেয়ারের ৭৩ দশমিক ১১ শতাংশ। বাকি ১২ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর মূলধন ১০৮ কোটি টাকা।
ব্যাংকটির প্রভাবশালী অন্যান্য উদ্যোক্তার মধ্যে আছেন— সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ডের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মো. মাহবুবুল হক বাবুল চিশতী, পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের মেয়ে নাফিসা কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মুনতাসীর উদ্দিন খান মামুন (মুনতাসীর মামুন), লুসাকা গ্রুপের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান সরকার, মোহাম্মদ মাসুদ, আজমত রহমান, ড. মোহা. আতাহার উদ্দিন ও অমিকন গ্রুপের প্রধান নির্বাহী মো. মেহেদী হাসান।