DMCA.com Protection Status
title="৭

আজ কমরেড সিরাজ সিকদারের ৪২তম হত্যা বার্ষিকী

siraj-sikdarক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ আজ বাংলার চে-গুয়েভারা বিপ্লবী শহীদ সিরাজ শিকদারের ৪২তম হত্যা বার্ষিকী । ১৯৭৫ সালের ২রা জানুয়ারী  স্বৈরাচার মুজিবের হুকুমে তার পুলিশ বন্দী অবস্থায় গুলি করে হত্যা করে এই অমিত সাহসী বিপ্লবী বীরকে।এটাই ছিলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড-ক্রশ ফায়ার।

১৯৪৪ সালের ২৭শে অক্টোবর এই ক্ষনজন্মা বিপ্লবী সিরাজ সিকদারের জন্ম। বাংলার ইকারুস, সিরাজ সিকদারের বয়স যখন মাত্র ২৩ তখন তিনি তৈরি করলেন মাও সেতুং গবেষণাগার। একবার ভাবুনতো আজকের যুগে যারা ইকারুস হতে পারতো তারা কি করে? তারা রাত জেগে ফোনে কথা বলে, হিন্দি ফিল্মের নকল করে চুল কাটে আবার কাটে না, দাড়ি রাখে আবার রাখে না। তারা সারাদিন ঘুরে ঘুরে ঘরে ফিরে কোনো স্বপ্ন না নিয়ে। 

একবার ভাবুনতো চুল দাড়ি পেকে যাওয়া রাজনীতিবিদরা যখন পাকিস্তানের সঙ্গে আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের চোরাগলিত হাত পা ডুবিয়ে হাপিত্যিশ করছেন তখন মাত্র ২৪ বছরের যুবক সিরাজ সিকদার বললেন, দীর্ঘ স্থায়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করতে হবে। সিরাজ সিকদার স্বাধীন পূর্ব বাংলার জন্য কারা শত্রু, কারা মিত্র তার বিস্তারিত তত্ত্বায়ন করে জাতির সামনে হাজির করলেন ঐতিহাসিক “পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের থিসিস”।

ইতিহাস সাক্ষী পাকিস্তানের সঙ্গে শত্রু-মিত্রের প্রভেদ এমন সহজ করে এর আগে কেউ আমাদের জানায়নি। শ্রমিক আন্দোলনের থিসিসের যে সত্য, আজ যে কেউ পড়লে বুঝতে পারে ২৪ বছরের যুবক যে একদিন ৫৫ হাজার বর্গ মাইলজুড়ে মানুষের স্বপ্নের কারিগর হবেন তার আশ্বাস ছিলো ওই দলিলে।

আরও আশ্চার্যের বিষয় যে ১৯৬৯ সালের মহান গণঅভ্যুত্থানেরও আগে সিরাজ সিকদার তার থিসিস দিলেন দেশকে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক জাল থেকে মুক্ত করার জন্য আমাদের কি করতে হবে।

আজকের ডিজে আর ডিজুস প্রজন্মের ২৩ বছর বয়সী বন্ধুরা কি করেন এমন প্রশ্নের উত্তরে কোনো আশাব্যঞ্জক কথা শোনা যাবে না। আজকের তরুণ-তরুণিরা রাজনীতিকে ঘৃণা করে, কারণ আমাদের দেশের প্রধান ধারার দৈনিক পত্রিকাগুলো দেশজুড়ে যে বিরাজনীতিকরণের জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং তা সফল হয়েছে বলতেই হয়।

ফলে এই তরুণ-তরুণী বড়জোর বন্ধুসভা করে আর গণহারে রাজনীতিকে গালমন্দ করে। ভাবখানা এমন যে রাজনীতি মুক্ত হলে, রাজনীতি থেকে যে যতো দূরে থাকবে সে ততো বেশি স্মার্ট আর বুদ্ধিমান। অথচ এই নিরেট ঘিলুহীন তরুণ-তরুণী জানেনা যে, রাজনীতির জ্ঞান বর্জিত মানে অসম্পূর্ণ আনস্মার্ট জীবন। 

যে দেশে পত্রিকা জোর প্রচার চালায় রাজনীতি করা খারাপ, আর বিনা বাক্যে মেনে নেয় যে তরুণ-তরুণী তাদের আর কিইবা বলার আছে। তবে একই সাথে এই তরুণদের জানা থাকা দরকার তাদের বয়সী আরেক তরুন ১৯৬৭ সালের ৮ জানুয়ারি ঘোষণা দিয়েছিলো যে, পাকিস্তান আর টিকবে না। পাকিস্তানের পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের বিপরীতে একটি সুখি সমৃদ্ধশালী পূর্ব বাংলার স্বপন দেখতে পারে যে জাতির তরুণেরা সে জাতির আজকের তরুণ-তরুণীরা হাল আমলের চুলের ফ্যাশন আর মোবাইল ইন্টারনেট চালানোর পরও কি আনস্মার্ট জীবন যাপনই না করে!

বাদ দিন তরুণ-তরুণীদের কথা। যদি প্রশ্ন করা হয় তিনকাল পেরিয়ে যেসব বুড়ো অধ্যাপকেরা অপেক্ষা করছে কবরে বা শ্মশানে যাবার তাদের ভাড়ারে কি কি জমা আছে? উত্তর জানা আছে সবার। কারোরই কোনো উল্লেখযোগ্য অর্জন নেই, শুধু শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়ার পাশে দাঁড়ানো জরাগ্রস্ত কিছু ছবি ছাড়া।

সিরাজ সিকদারের যাত্রা শুরুঃ

ষাটের দশক পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের দশক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে। এ সময় পাকিস্তানের অভ্যন্তরেও বিকশিত হতে থাকে জাতীমুক্তির প্রশ্ন। পাকিস্তানপর্বে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকায় কমিউনিস্ট পার্টি বিভিন্ন পার্টির মধ্যে কাজ করতে থাকে, তা মূলত আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এর মধ্যে। 

এ পর্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টি ও বামপন্থিরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হবার নানা প্রক্রিয়া হাতে নেয়। এ সময়ই বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী আন্দোলনও জমে উঠে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার নামে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে আনা হয় লে.কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ও তার সঙ্গীদের। মামলার শেষ পর্যায় এসে শেখ মুজিবুর রহমানকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়।

এই দশকে ভারতের এ যাবতকালের সব থেকে বড় ধাক্কা আসে সশস্ত্র কৃষক আন্দোলনের মাঝখান থেকে। ১৯৬৭ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ির ফাশিদেওয়া, নকশালবাড়িতে ঘটে যায় এ সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ। 

সেই বিদ্রোহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পথ হিসেবে ছড়িয়ে দেয়ার কাজ নেয় চারু মজুদমদারের নেতৃত্বে একদল কমিউনিস্ট। পরে যারা সিপিআই (এম এল) নামে পার্টি তৈরি করেছিল। যা ভারতীয় উপমহাদেশে নকশাল আন্দোলন নামে নামকরণ হয়েছিল। নকশাল বাড়ির সেই প্রবল জোয়ার পূর্ব পাকিস্তানেও আছড়ে পড়ে।

পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি আগেই রুশ ও চীন দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এদের মধ্যে একজন ছিলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষবর্ষের মেধাবি ছাত্র সিরাজুল হক সিকদার বা সিরাজ সিকদার।

ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের ছাত্র বুয়েটের লিয়াকত হল শাখার সভাপতি সিরাজ সিকদার ইতোমধ্যেই মার্কসবাদের মৌলিক জ্ঞান আয়ত্ব করে ফেলেছেন। এই বয়সেই পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম এল) এর সদস্য পেয়েছেন।

পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম এল) চারু মজুমদারের সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবের তত্ব্ কে হঠকারি হিসেবে প্রস্তাব নিলো। এ অবস্থায় পার্টি থেকে বেরিয়ে এলেন সিরাজ সিকদার। 

সিরাজ সিকদারসহ অন্যান্য তরুণ কমীরা পার্টি থেকে বেরিয়ে গঠন করলেন রেডগার্ড। ঢাকা শহর ভরে উঠলো , ‘বন্দুকের নলই সকল মতার উৎস’ বা ‘নকশালবাড়ী জিন্দাবাদ’ এর মত দেয়াল লিখন বা চিকায়।

সিরাজ সিকদারের বিপ্লবী অপারশেনঃ

লেনিন যারা ভাল করে পড়েছেন তারা জানেন বিপ্লব করতে হলে বিপ্লবী তত্ত্বের প্রয়োজন পড়ে। তবে তার সঙ্গে প্রয়োজন হয় বিপ্লবের রণকৌশল। লেনিন থেকে শিক্ষা নিয়ে মাও সেতুং-এর দীর্ঘমেয়াদী সশস্ত্র গণযুদ্ধের তত্ত্বমতে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও করার মধ্য দিয়েই গড়ে উঠবে বিপ্লবী পার্টির সেনাবাহিনী। যে সেনাবাহিনী জনগনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে, এই লড়াইকে রাষ্ট্র ক্ষমতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

এই রণকৌশলকে আকড়ে ধরে সিরাজ সিকদার প্রথমে অন্যান্য ভাতৃপ্রতিম কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আলাপ আলোচনার অংশ হিসেবে মিয়ানমারে কমিউনিস্ট পার্টির সাক্ষাতের জন্য রওনা হলেন টেকনাফ হয়ে মিয়ানমারে। 

সেখানকার কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা থান-কিন-থাউর সঙ্গে দেখা করলেন নে-উইনের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামের স্বরূপ জানতে। তবে মিয়ানমারের কমিউনিস্ট পার্টির পার্টির নেতা থান-কিন-থাউর সংঙ্গে সিরাজ সিকদার নিজে দেখা করতে যাননি। তাদের চারজনের একটি প্রতিনিধি দল সেখানে প্রেরণ করেন। 

সেই প্রতিনিধি দলে ছিলেন, ফজলুল হক রানা। সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে রানা বলেন, আমরা মিয়ানমারে গিয়েছিলাম মূলত সেখানকার কমিউনিস্ট পার্টির লড়াইয়ের কৌশল সম্পর্কে জানার জন্য। আমাদের তারা ক্যাম্পে রেখে খেতে দিয়েছিলেন। অনেক বিষয় আমাদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল সে সময়।

ফিরে এসে চট্টগ্রামের পাহাড়ির অঞ্চলে ঘাটি নির্মানে লেগে গেলেন। বাকি কমরেডদের নিয়ে লেগে গেলেন পাহাড় কেটে সুরঙ্গ তৈরিতে। বিপ্লবের স্বপ্ন নিয়ে ঘোরের মধ্যে থাকা এই বিপ্লবীদের সঙ্গী সাথীর বয়স খুবই কম। তবে মানুষ ছাড়া বিপ্লব কার সঙ্গে করবেন? অবশেষে ক্ষান্ত দিয়ে ফিরে এলেন ঢাকায়।

পার্টি প্রস্তুতি সংগঠন ‘পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলনঃ

সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি হিসেবে পাকিস্তানের কালপর্বে ঘটে যাওয়া ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের প্রস্তুতিকালে ১৯৬৭-৬৮ সালে সিরাজ সিকদার গড়ে তোলেন মাও সেতুং থট রিসার্চ সেন্টার বা মাও সেতুংয়ের চিন্তাধারা গবেষণা কেন্দ্র। 

মাওসেতুং গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলা হয় মালিবাগে । মালিবাগে এ বাসাটি ভাড়া নেয় ফজলুল হক রানা। এ সময় পাকিস্তান জামাত ইসলামের ছাত্র সংগঠন ছাত্র সংঘের কর্মীদের আক্রমনের কারণে রিসার্চ সেন্টারটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন সিরাজ সিকদার।

তবে সিরাজ সিকদার দমে যাননি। এরপরেই ১৯৬৮ সালের ৮ জানুয়ারী তিনি গড়ে তোলেন পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন। এ সময় তিনি তার বিখ্যাত থিসিস দেন যা পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের থিসিস নামে খ্যাত। ১৯৬৮ সালের ১ ডিসেম্বরে পরিবর্ধীত ও পূনর্লিখিত দলীলটি পরবর্তীতে সর্বহারা পার্টি গড়ে ওঠার থিসিস হিসেবে তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের থিসিসে সিরাজ সিকদার পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের উপনিবেশ হিসেবে উল্লেখ করেন। এই থিসিসেই সিরাজ প্রধান ও মূল সংঘাতগুলো (কনট্রাডিকশনস) উল্লেখ করার পাশাপাশি একটি সফল বিপ্লবের বিভিন্ন পর্যায় ও তা সম্পন্নের রূপরেখা দেন। সম্মেলনে উপস্থিত সবার অনুমোদন পায় তা। 

থিসিসে সিরাজ সিকদার ভারতীয় উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ সারসংকলন করেন। কেন ভারতীয় উপমহাদেশে কমিউনিস্ট পার্টি ব্যর্থ হয়েছে সে বিষয় তিনি একটি পযালোচনা দেন।

পূর্ব বাংলার বিপ্লবের চরিত্র ব্যাখ্যা করে বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সংঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলা একটি স্বাধীন শান্তিপূর্ণ নিরপক্ষে প্রগতিশীল দেশ হিসেবে বিশ্বের সামনে মাথা উচু করে দাড়াবে। এক অর্থে তিরি তার পররাষ্ট্রনীতিও ঠিক করে ফেলেন।

দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধ করার জন্য বাহিনী তৈরির কাজেও তিনি লেগে যান। এরপর তিনি গঠন করেন ইস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট ও ইস্ট বেঙ্গল রেভুলেশনারী আর্মি যা পূর্ব বাংলার বিপ্লবী সেনাবাহিনী নামেও পরিচিত। এ

সময় তিনি ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে মাও এর শ্লোগান দিয়ে দেয়াল লিখন করেন। শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা মাওর বিখ্যাত উক্তি নিয়ে চিকা পড়ে: বন্দুকের নলই মতার উৎস। 

এ সময়ের একটি ঘটনা সম্পর্কে শ্রমিক আন্দোলনের কর্মী আবু ইসহাক বলেন, ভাই (সিরাজ সিকদারকে কর্মীদের অনেকে ভাই বলে সম্বোধন করতেন) আমাদের বললেন এই শ্লোগান ঢাকার বিভিন্ন ওয়ালে লিখতে। আমরা লিখতাম। একটু পরে পুলিশ এসে সারা রাত ধরে সেই শ্লোগান মুছতো। তখন ভাই হেসে বলতেন, এটা দিয়েই হবে।’

এ সময় শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করে। বিভিন্ন জায়গায় তারা গোপনে সামরিক ট্রেনিং নিতে থাকে। এর মধ্যে পার্বত্য অঞ্চল হয়ে দাড়ায় তাদের গোপন ট্রেনিংয়ের অন্যতম ক্ষেত্র।

বাংলাদেশের পতাকাঃ

শ্রমিক আন্দোলনের থিসিসের পরই শ্রমিক আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তান (পূর্ব বাংলা)স্বাধীনতার প্রশ্নে লড়াই শুরু করে। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও-এর তাত্বিক লাইন গ্রহণ করায় এ সময় সংগঠন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। মাদারিপুর, শরিয়তপুর, বরিশালসহ একাধিক অঞ্চলে শ্রমিক আন্দোলনের মজবুত ভিত গড়ে উঠে।

বরিশালের ঘাটশ্রমিকদের মধ্যে কিছু পরিমান অর্থনীতিবাদী প্রকাশ্য আন্দোলন সংগ্রামও গড়ে উঠে বলে জানিয়েছেন সর্বহারা পার্টির সাবেক নেতাকর্মীরা।

১৯৭০ সালের ৮ জানুয়ারী পার্টির দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবাষিকীতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একটি নতুন পতাকা উড়ানো হয়। এই পতাকাই আজকের বাংলাদেশের পতাকা। ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ ও ময়মনসিংহে ওড়া এই পতাকায় সবুজ জমিনের মাঝে লাল সূর্য। সে সময় নতুন একটি পতাকা উত্তোলনের ঘটনা বিভিন্ন পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়।

পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য. ফজলুল হক রানা আমাকে জানিয়েছেন, জাতীয় পতাকার মূল নকশার পরিকল্পকদের একজন ছিলেন অবাঙ্গালী, সাইফুল্লাহ আজমী। যার পরিবার বিহার থেকে অভিবাসী হয়ে এসেছিলেন এদেশে। এ পতাকার সঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশের পতাকার একটিই পার্থক্য, তাহলো সর্বহারা পার্টি কতৃক লাল সবুজের পতাকার মধ্যে শুধু মশাল জালানো একটি অংশ ক্ষদ্র জাতী সত্বার প্রতিনধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য রয়েছে, বাংলাদেশের নেই। 

এ প্রসঙ্গে সর্বহারা পার্টির একাংশের (সর্বোচ্চ বিপ্লবী পরিষদ) সাবেক সভাপতি (সিরাজ সিকদার নিহত হবার) রইসুদ্দিন আরিফ বলেছেন বলেন, আমাদের সংবিধান থেকে শুরু করে সবখানে উগ্র বাঙালী জাতীয়তাবাদের বর্হিপ্রকাশ। পতাকাতেও তার অবস্থান স্পষ্ট। কিন্তু সিরাজ সিকদার ভিন্ন ঘরানার রাজনীতি করতেন। এ কারণে তিনি পতাকায় তিনটি মশাল দিয়ে স্মরক রেখেছিলেন।এক, হলো ধর্মীয় সংখ্যালঘু, দুই, জাতীগত সংখ্যালঘু ও তিন, ভাষাগত সংখ্যালঘু।

বন্দুকের নল থেকে রাষ্ট্র ক্ষমতা বেরিয়ে আসেঃ

পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন শুধু তাত্বিক আর শান্তিপূর্ণ অবস্থানের কোন সংগঠন ছিল না। প্রথম থেকেই সংগঠনটি সশস্ত্র অনুশীলনের মধ্য দিয়ে নিজেদের বিকাশ নিশ্চিত করে। এরকম একটি ব্যর্থ হামলা চালায় ১৯৬৮ সালের ৬ মে কার্লমার্ক্সের জন্মদিনে। 

ওই দিন পাকিস্তান কাউন্সিলে দুটো হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটায় পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন। তবে হামলাটি সফল হয়নি। তবে হামলা থেমে থাকেনি। এই হামলার পরে আরও বেশ কিছু হামলা হয় বিদেশী দূতাবাসে। 

তার মধ্যে ওই বছরেরই অক্টোবর নাগাদ ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন, আমেরিকান ইনফরমেশান সেন্টারসহ আরো বেশ কিছু জায়গায়। বিদেশী শত্রুদের স্থানে হামলা চালানোর সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের বিরোধীতাকারীদেরও একটা তালিকা তৈরি হতে থাকে। সে তালিকায় ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে প্রথম নিহত হন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির এক চা বাগানের সহকারী ম্যানেজার হারু বাবু।

শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের কাছে খোলা চিঠিঃ

৭০ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিশাল জয়ের মধ্যে দিয়ে জাতীমুক্তির লড়াইয়ে পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত ও বুজোয়াদের ক্ষুদ্র সংগঠন আওয়ামী লীগ মূল নেতৃত্বে চলে আসে। তবে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে। এ সময় আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনার ডাক দেয় পাকিস্তানী জান্তা সরকার।

তবে সিরাজ সিকদার ও তার সংগঠন পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান নেয় পাকিস্তানের ওপনেবিশক শোষনের বিরুদ্ধে। এ সময় সংগঠনের পক্ষ থেকে সিরাজ সিকদার শেখ মুজিবুর রহমানেরর কাছে এক খোলা চিঠি লেখেন।

 ১ মার্চ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যথন সংসদ অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা দেন, উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা বাংলা। পরদিন ২ মার্চ পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন শেখ মুজিবকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার আহবান জানায়। এ

কই সময় সংগঠনটি সর্বস্তরের দেশপ্রেমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি অস্থায়ী বিপ্লবী জোট সরকার গঠন এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ পরিষদ গঠনের অনুরোধ জানায়। তবে মুজিব তখন ব্যস্ত আলাপ আলোচনায় সমাধান খুজতে।

চিঠির সংক্ষিপ্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশঃ

আপনার ও আপনার পার্টির ছয় দফা সংগ্রামের রক্তাত্ব ইহিতাস স্পষ্টভাবে প্রমান করেছে যে ছয় দফার অর্থনৈতিক দাবীসমূহ বাস্তবায়ন সম্ভব সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যমে, পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানকে থেকে বিচ্ছিন্ন, মুক্ত ও স্বাধীন করে।

আপনাকে ও আপনার পার্টিকে পূর্ব বাংলার সাত কোটি জনসাধারণ ভোট প্রধান করেছে পূর্ব বাংলার উপরস্থ পাকিস্তানের অবাঙালী শাসকগোষ্ঠীর উপনেবিশেকি শাসন ও শোষনের অবসান করে স্বাধীন ও সার্বভৌম পূর্ব বাংলা কায়েম করার জন্য।

পূর্ব বাংলার জনগনের এ আশা-আকাঙ্কা বাস্তবায়নের জন্য পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন আপনার প্রতি ও আওয়ামী লীগের প্রতি নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলি পেশ করছে:

১. পূর্ব বাংলার নির্বাচিত জনগনের প্রতিনিধি হিসেবে এবং সংখ্যাগুরু জাতীয় পরিষদের নেতা হিসেবে স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করুন।

২. পূর্ব বাংলার কৃষক-শ্রমিক, প্রকাশ্য ও গোপনে কার্যরত পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি ও ব্যক্তিদের প্রতিনিধি সম্বলিত স্বাধীন, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্রের অস্থায়ী সরকার কায়েম করুন।

৩. পূর্ব বাংলাব্যাপী এ সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগোষ্ট্রীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের আহবান জানান।

এ উদ্দেশ্যে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি বাহিনী গঠন এবং শহর ও গ্রামে জাতীয় শত্রু খতমের ও তাদের প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের আহবান জানান।

৪. পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার জন্য শ্রমিক-কৃষক এবং প্রকাশ্য ও গোপনে কার্যরত পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি ও ব্যক্তিদের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ‘জাতীয় মুক্তি পরিষদ’ বা ‘জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট’ গঠন করুন।

৫. প্রকাশ্য ও গোপন, শান্তিপূর্ণ ও সশস্ত্র, সংস্কারবাদী ও বিপ্লবী পদ্ধতিতে সংগ্রাম করার জন্য পূর্ব বাংলার জনগনের প্রতি আহবান জানান।

(এরপর ৬ নং পয়েন্টে শ্রমিক আন্দোলনের খোলা চিঠিতে ১৩টি করনীয় নির্ধারন হাজির করে। এর মধ্যে গ্রামঞ্চলে জমির বন্টন, শ্রমিকদের শ্রম শোষন বন্ধ, ভাষাগত, ধর্মীয়, জাতীগত সংখ্যালঘুদের সমধিকার দেয়ার বিধান সহ গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা হাজির করে)।

তবে শেখ মুজিব ও তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সিরাজ সিকাদের নেতৃত্বাধীন শ্রমিক আন্দোলনের এই খোলা চিঠিকে আমলে নেয়নি। হতে পারে নিরুঙ্কুশ ভোটে জয় পাওয়ার পর আওয়ামী লীগ তখন একলা চলো নীতিতে অটল ছিল।

তবে মুজিব নগর সরকার ১৭ এপ্রিল শপথ নেবার পর সেই সরকারের প্রতি আরেকটি খোলা চিঠি দেয়া হয় শ্রমিক আন্দোলনের পক্ষ থেকে। সেখানে যুদ্ধের ময়দানে করনীয় বিষয়ে তুলে ধরা হয়। তবে এবারও প্রবাসী সরকার শ্রমিক আন্দোলনের সেই চিঠিতে কর্ণপাত করেনি।

সর্বহারা পার্টি তৈরিঃ

১৯৭১ সালের ৩ জুন যুদ্ধের ময়দানে কামানের গোলার মধ্যে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে পার্টি তৈরি হয়। নাম হয় পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি। বরিশালের পেয়ারা বাগানকে বেছে নেয়া হয় পার্টির উদ্ধোনী অনুষ্ঠানের জন্য। এর আগে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বের পার্টিগুলোর নাম সবই মোটামুটি কমিউনিস্ট পার্টি বা এর কাছাকাছি নাম রাখে। কিন্তু সিরাজ সিকদার প্রলেতারিয়েতের বাংলা সর্বহারার নামে নামকরণ করেন পার্টির নাম।

সর্বহারা পার্টি গঠনের ওই দিনে বরিশালের পেয়ারা বাগানে উপস্থিত ছিলেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ফজলুল হক রানা। তিনি সেদিনের স্মৃতি হাতড়ে বলেন, বরিশালের পেয়ারা বাগানে সেদিন লাখ লাখ মানুষ উপস্থিত হয়েছে। পেয়ারাবাগান যেন কোন মুক্তাঞ্চল। এখানে নারী পুরুষে যে এক নতুন পৃথিবীর জন্মের আগে সমবেত হয়েছেন নতুন যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য।

সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বাধীন সর্বহারা পার্টি প্রথম দিকে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা কর্মীকে আশ্রয় দেয়। এ সময় সর্বহারা পার্টি কর্মসূচী হাতে নেয়, দেশপ্রেমিক মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলার ব্যাপারে। এই অবস্থা ১৯৭১ সালের আগস্ট পর্যন্ত সর্বহারা পার্টি ধরে রাথে। 

আগস্টের শুরুতে সর্বহারা পার্টির অন্যতম কেন্দ্রীয় সদস্য এবং বর্তমান বাংলাদেশের পতাকার নকশাকার সাইফুল্লাহ আজমীসহ ৫জন যোদ্ধাকে সাভারে পাঠানো হয় মুজিব বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকের উদ্দেশ্যে।মুজিব বাহিনী তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী দলের বাহিনীর সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বাধীন সর্বহারা পার্টির সকল ঐক্য ভেস্তে যায়। তবে এরও আড়ে ভারতে খুব গোপনে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’ (রির্সাস এন্ড এনালিস উইং)- এর নেতৃত্বে গড়ে উঠে মুজিব বাহিনী। মূলত এই বাহিনী গড়েই তোলা হয় যুদ্ধ খেকে কমিউনিস্টদের হটিয়ে দেবার জন্য।

১৯৭১ সালের আগস্ট পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে থেকে লড়াই সংগ্রাম করেছে মূলত এ দেশের বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টি এ গ্রুপ যার মধ্যে সর্বহারা পার্টি অন্যতম।

বরিশালের বানারিপাড়া অঞ্চলে অবস্থান নেয় শ্রমিক আন্দোলন, ৩০ এপ্রিল গঠন করে জাতীয় মুক্তিবাহিনী যা দখলমুক্ত করে পেয়ারাবাগানের খানিকটা। 

এই মুক্তিবাহিনী পরিচালনা করতে সিরাজ শিকদারকে প্রধান করে সর্বোচ্চ সামরিক পরিচালনামন্ডলী গঠন করা হয়। বরিশালের পেয়ারা বাগান স্বাধীনতা সংগ্রাম চলার সময় প্রথম ঘাটি ও মুক্তাঞ্চল। 

এ বিষয়ে সর্বহারা পার্টির তৎকালিন বৃহত্তর বরিশাল (বরিশাল, মাদারিপুর, শরিয়তপুর, ফরিদপুর,ঝালখাটি, পিরোজপুর সহ) অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদক রইসুদ্দিন আরিফ (পরবর্তীতে সিরাজ সিকদার নিহত হলে অস্থায়ী সর্বোচ্চ বিপ্লবী সংস্থার সভাপতি) বলেন, বরিশালের পেয়ারাবাগান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে প্রথম ঘাটি ও মুক্তাঞ্চলে পাক বাহিনীর অনেক বড় বড় অপারেশন চালাতে হয়েছিল। আবার সর্বহারা পার্টি পাক বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে রাথতো। সর্বহারা পার্টি এ অঞ্চলে অজস্র সফল হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান বাহিনীর ওপর।

বরিশাল অঞ্চলে অসংখ্য সফল হামলা চালিয়ে সর্বহারা পার্টি পাকিস্তান বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। তবে স্বাধীনতা উত্তর যত ইতিহাস লেথা হয়েছে সেখানে বরিশালের যুদ্ধে সর্বহারা পার্টির নাম নিশানাও রাখেনি শাসকশ্রেণী।

বাংলাদেশের সরকারের প্রতি পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির খোলা চিঠিঃ

ভারতীয় বাহিনীর হস্তক্ষেপে দ্রুত বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ভারতীয় বাহিনীর এই ততপরতাকে সাদা চোথে দেখিনি সর্বহারা পার্টি। 

পার্টি মনে করে পাকিস্তানের উপনিবেশ থেকে দেশ এবার ভারতীয় উপনিবেশের মধ্যে গিয়ে পড়েছে। 

এ সময় নতুন বাংলাদেশে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলার প্রশ্নে সর্বহারা পার্টি বাংলাদেশের সরকারের প্রতি একটি খোলা চিঠি লেখে। 

উক্ত চিঠিতে বলা হয়, ভারতী সৈন্যদের অনাতিবিলম্বে সরিয়ে নেয়া, যুদ্ধের সৈনিকদের দিয়ে নৌ, আকাশ ও স্থল সেনাবাহিনী তৈরি করা, স্বাধীনতা বিরোধীতাকারী অপশক্তিদের সম্পত্তি বাজেয়প্ত করা ও তাদের বিচার নিশ্চিত করা, সকল দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃত্বে জাতীয় বিপ্লবী সরকার গঠনসহ ২৭টি দাবী পেশ করা হয়। তবে মুজিব সরকার সর্বহারা পার্টির সে সব দাবীর একটিতেও কর্নপাত করেনি। যদি সে সময় আওয়ামী লীগ বিচক্ষনার পরিচয় দিতো, তাহলে আজব্দি যুদ্ধাপরাধের বিচার ঝুলিয়ে রাখতে হোত না।

তবে রাষ্ট্রযন্ত্র থোড়াই পরোয়া করে। উঠতি মধ্যবিত্ত যে রাষ্ট্র পেল, যে রাষ্ট্র তারা ধর্মীয় জাতীগতভাবে ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশের কাছে হারিয়েছিল তা দখল করে নিলো নিজেদের মধ্যে। যদিও মুক্তিযুদ্ধ অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্রের মত গুরুত্বপূর্ন অনুসঙ্গ হাজির করেছিল, তবে বাস্তবে মুসলিম থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগ হয়ে আওয়ামী লীগের যে ইতিহাস সেখানে দুই ধারার মানুষের সম্মিলিন ঘটেছিল। এক সাবেকি মুসলিম লীগ দুই উঠতি মধ্যবিত্ত।

সর্বহারা পার্টির কোন দাবী না মেনে নেওয়ায় এবং স্বাধীনতার অব্যহতি পর থেকেই বিরোধী মতামতকে উগ্রভাবে দমন করার, ভারতীয় হস্তক্ষেপের বাড়াবাড়রি কারণে সিরাজ সিকদার নতুন থিসিস দিলেন।

এই নতুন থিসিসের নাম দিলেন, পূর্ব বাংলার বীর জনগণ আমাদের সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি , পূর্ব বাংলার অসামাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব (জাতীয় মুক্তি ও অথনৈতিক স্বাধীনতা) সম্পূর্ণ করার মহান সংগ্রাম চালিয়ে যান শীর্ষক এই দলিলটি বের হয় ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে পরে যা আবার ১৯৭৪ সালের মার্চে পূণপ্রকাশিত হয়। এই দলিলে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয় কিভাবে বাংলাদেশ নামের নতুন দেশটি ভারতীয় অর্থনৈতিক উপনেবেশে পরিণত হয়েছে।

এ কারণে সর্বহারা পার্টি ১৬ ডিসেম্বরকে বিজয় দিবসে হিসেবে পালন না করে ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমার্পন দিবস হিসেবে কালো দিবস ঘোষণা করে ওইদিন হরতাল পালানের আহবান জানায়। 

১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে সর্বহারা পার্টি সারাদেশে হরতালর ডাক দেয়। পার্টির মুখপত্র ‘স্ফুলিঙ্গ’ ও প্রচারপত্রে বলা হয়, ১৬ ডিসেম্বর হচ্ছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী শক্তির কাছে মুজিব সরকারের আত্মসমর্পণ দিবস।

একমাত্র জনযুদ্ধের মাধ্যমেই জনগণের বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা করে প্রকৃত বিজয় আসতে পারে। মাওবাদীদের বিরুদ্ধে মুজিব সরকারের ব্যপক দমন-পীড়ন, হত্যা-নির্যাতনের প্রতিবাদে সর্বহারা পার্টি ঢাকায় হরতাল আহ্বান করলে সন্তোষ থেকে মওলানা ভাসানী বিবৃতি দিয়ে একে সমর্থণ করেন। হরতাল সফল হয়। দেশব্যাপী থানায় থানায় সশস্ত্র আক্রমন পরিচালিত হয়।

এই হরতালের বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলের সর্বহারা পার্টির সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন রইসুদ্দিন আরিফ। হরতালের কথা স্মরণ করতে গিয়ে আরিফ বলেন, আমি ছিলাম ফরিদপুরের দিকে। হরতালের আগের রাতেভর এলাকার কৃষকেরা মহাসড়কে গাছ কেটে ফেলে রাখে। এতো বেশি গাছ তারা কেটে ছিল যে, মহাসড়ক থেকে গাছ সরাতে সরকারের লোকদের বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।

যে রাতে সাভারের মাটি লাল হলোঃ

১৯৭৫ সালের ইংরেজি নববর্ষের প্রথম দিন, ১ জানুয়ারি। আগের মাস ডিসেম্বরে দেশব্যাপী সফল হরতাল পালনের মধ্য দিয়ে পার্টির কার্যক্রমকে গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করছেন সর্বহারা পার্টির এক সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সিরাজ সিকদার। কেন্দ্রীয় কমিটিতে এক সদস্য হবার কারণ হলো ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যান্য সদস্য মুজিব বাহিনী অথবা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে। 

কেন্দ্রীয় কমিটি এক সদস্য হওয়ায় এ সময় পার্টি রাজনৈতিক, সামরিক ও সাংগঠনিক কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য প্রত্যেক সেলে দুইজন করে লোক নিয়োগ দেয়, যারা হলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শ্রমিক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ফজলুল হক রানা।

চট্রগ্রাম থেকে আত্মগোপন করে সিরাজ সিকদারকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল পার্টির গোয়েন্দা উইং। তিনি পার্টির শহীদ এক কর্মীর বাসায় যাচ্ছিলেন দেখা করার জন্য। এরপরেই চট্রগ্রাম ত্যাগ করে কোন ঘাটি অঞ্চলে ডুব দিবেন। একটি স্কুটার নিয়েছেন যাবেন পাহাড়তলিতে। চট্রগ্রামের নিউমার্কেট এলাকায় এলে স্কুটার থামায় সাদা পুলিশ। সিরাজ সিকদার নির্বিকার ভঙ্গিতে নিজেকে পরিচয় দেন ব্যবসায়ী হিসেবে। এমনকি চট্রগ্রাম চেম্বারস অব কমার্স এর সদস্য হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিলে ঘাবড়ে যায় ডিবির সাদা পুলিশের দল। এবার কয়েক ব্যবসায়ীকেও ফোন করা হয়। তারা জানান, যে ইনি একজন ভাল ব্যবসায়ী। তবে ঢাকার গোয়েন্দা সদর দপ্তর নিশ্চিত যে, যাকে ধরা হয়েছে তিনি সিরাজ সিকদার। ঢাকায় পাঠানো হয় ওই দিনেই সিরাজ সিকদারকে।

পরদিন অর্থাৎ ২ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার (১৯৭৫) রাতে একটি পুলিশ ভ্যানে সিরাজ সিকদারকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর অদূরে সাভার এলাকায়। তখন রাত প্রায় সাড়ে ১১টা। হঠাৎ গর্জে ওঠে পুলিশের রাইফেল। কয়েক রাউন্ড গুলির আওয়াজে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে সাভারের তালবাগ এলাকা। পুলিশ হেফাজতে থাকা এবং হাতে হ্যান্ডকাফ পরিহীথ সিরাজ সিকদার নিহত হন।

এ সময় চারটি ঘাতক বুলেট সিরাজ সিকদারের শরীর ভেদ করে বেরিয়ে যায়। এর মধ্যে একটি বুলেট তার বুক ভেদ করে এফোড় ওফোড় করে দেয় হৃদপিন্ড। সেটাই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ক্রসফায়ার। তবে পরের দিন পত্রিকায় পাঠানো পুলিশের প্রেসরিলিজ যা সাংবাদপত্রগুলো পাঠায় তা ভাষা আর আজকে যখন ক্রসফায়ারের পর যে প্রেসরিলিজ ছাপনো হুবহু।

`কোথায় আজ সেই সিরাজ সিকদার`-সংসদে শেখ মুজিবঃ

শেখ মুজিব সেদিন পার্লামেন্টে দাড়িয়ে বলেছিলেন ,কোথায় আজ সিরাজ সিকদার? আইনি পদ্ধতিতে বিচার করতে না পেরে, বে আইনি বিচার বহিভূত হত্যার পর এক রাষ্ট্রপতির এই দম্ভ সেদিন অনেককেই আতঙ্কিত করেছিল, বিস্মিতও করেছিল। 

আওয়ামী লীগের আমলে রক্ষি বাহিনীর অত্যাচারে হাজার হাজার বামপন্থি, কমিউনিস্টরা হত্যার শিকার হয়। সে সব হত্যা ছিল হয় রক্ষি বাহিনী, অথবা সরকারী বাহিনীর গুপ্ত হত্যা। কিন্তু হ্যান্ডকাপ পরিহিত অবস্থায় পুলিশের হেফাজতে হত্যা ছিল বাংলাদেশ যাত্রায় সেটাই প্রথম। সেই খুনের রাস্তা থেকে বাংলাদেশ এখন উঠে আসতে পারেনি। পুরো জনপদই তৈরি হয়েছে খুনের জনপদে।

সিরাজ সিকদার হত্যা মামলাঃ

৪ জুন ১৯৯২ সালে সিরাজ সিকদারকে হত্যার দায়ে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল ও মোহাম্মদ নাসিমসহ ৭জনকে আসামি করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের (সিএমএম) আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। 

সিরাজ সিকদার পরিষদের সভাপতি শেখ মহিউদ্দিন আহমদ বাদী হয়ে এই মামলা দায়ের করেন। মামলার আসামিরা হলেন: (১) সাবেক পুলিশ সুপার মাহবুব উদ্দিন আহমেদ (২) আব্দুর রাজ্জাক (৩) তোফায়েল আহমদ  (৪) সাবেক আইজি পুলিশ ইএ চৌধুরী (৫) সাবেক রক্ষীবাহিনীর মহাপরিচালক কর্নেল (অবঃ) নূরুজ্জামান (৭) মোহাম্মদ নাসিম গং। আসামিদের বিরুদ্ধে ৩০২ ও ১০৯ নং ধারায় অভিযোগ আনা 

সিরাজ সিকদার হত্যার পর দিন ইত্তেফাকে প্রকাশিত সংবাদঃ
গ্রেফতারের পর পলায়নকালে পুলিশের গুলীতে সিরাজ সিকদার নিহত

গতকাল (বৃহস্পতিবার) শেষ রাত্রিতে প্রাপ্ত পুলিশের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানান হয় যে, ‘পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি’ নামে পরিচিত একটি গুপ্ত চরমপন্থী দলের প্রধান সিরাজুল হক সিকদার ওরফে সিরাজ সিকদারকে পুলিশ ১লা জানুয়ারি চট্টগ্রামে গ্রেফতার করেন। একই দিন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁহাকে ঢাকা পাঠানো হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি স্বীকারোক্তিমূলক এক বিবৃতি দেন এবং তাহার পার্টি কর্মীদের কয়েকটি গোপন আস্তানা এবং তাহাদের বেআইনী অস্ত্র ও গোলাবারুদ রাখার স্থানে পুলিশকে লইয়া যাইতে রাজী হন।

সেইভাবে ২রা জানুয়ারি রাত্রে একটি পুলিশ ভ্যানে করিয়া তাহাকে ওইসব আস্তানার দিকে পুলিশ দল কর্তৃক লইয়া যাইবার সময় তিনি সাভারের কাছে ভ্যান হইতে লাফাইয়া পড়িয়া পলায়ন করিতে চেষ্টা করেন। তাহার পলায়ন রোধ করার জন্য পুলিশ দল গুলীবর্ষণ করিলে তত্ক্ষণাত্ ঘটনাস্থলেই তাহার মৃত্যু হয়। এ ব্যাপারে সাভারে একটি মামলা দায়ের করা হইয়াছে।

এখানে উল্লেখ করা যায় যে, সিরাজ সিকদার তাহার গুপ্ত দলে একদল দুর্বৃত্ত সংগ্রহ করিয়া তাহাদের সাহায্যে হিংস্র কার্যকলাপ, গুপ্তহত্যা, থানার উপর হামলা, বন অফিস, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ইত্যাদির উপর হামলা, ব্যাংক, হাটবাজার লুট, লঞ্চ ট্রেন ডাকাতি, রেললাইন তুলিয়া ফেলার দরুন গুরুতর ট্রেন দুর্ঘটনা, লোকজনের কাছ হইতে জোর করিয়া অর্থ আদায়ের মত কার্যকলাপের মাধ্যমে দেশের শান্তি শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করিয়া আসিতেছিলেন।

সাহসের একটাই নাম শহীদ সিরাজ সিকদারঃ

সর্বহারা তথা প্রলেতারিয়েতের এত সুন্দর বাংলা এর আগে বাংলায় হয়নি। এখানে ইসলামী বলি কমিউনিস্ট বলি সবাই তাকিয়ে থাকে বাইরের দিকে। নিজের দেশের মাটি, নদী, ঝড়-বৃষ্টিতে সিক্ত যে ভূমি তার দিকে কারোর নজর নেই। সেদিক থেকে সিরাজ সিকদার অন্যান্য। দেশীয় ইতিহাস, ঐতিহ্যের সঙ্গে রাজনীতি, রণকৌশল হাজির করাই ছিল সিরাজ সিকদারের বড় কৃতিত্ব।

আজকের তরুণরা যখন দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত নয়। যে কোন প্রকার একটা ক্যারিয়ার, চাকরি হলেই সে খুশি। করপোরেট কোম্পানীর শ্রমদাস হওয়ার জন্য কাতারে কাতারে তরুণ-তরুণী কি ব্যগ্র ব্যাকুল। স্বদেশ প্রেম, লড়াই যেন আজ ’এ্যাকুরিয়ামের পঁচা মাছ’। অথচ এই বয়সে, সিরাজ সিকদার বাংলাদেশকে কাপিয়ে দিয়েছিলেন এক আজন্ম স্বপ্নের সাম্যবাদী সমাজের আন্দোলনের নেতা হয়ে।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!