দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ প্রতিবেদনঃ ছয় দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে গত রোববার ভারতে পৌঁছান ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।ভারতের প্রথা অনুযায়ী বিমানবন্দরে একজন মন্ত্রী তাঁকে স্বাগত জানাবেন—এমনই কথা ছিল। তবে সবাইকে চমকে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেই হাজির সেখানে। করমর্দন করে বুক মেলান প্রানের ‘বন্ধু’ নেতানিয়াহুর সঙ্গে।
ছয় মাস আগে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইসরায়েল সফরে গিয়ে এক ভাষণে নেতানিয়াহুকে ঘনিষ্ট ‘বন্ধু’ সম্বোধন করেন মোদি। বলেন, বন্ধুত্ব শুধু ভারত-ইসরায়েলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, মোদি-নেতানিয়াহুরও রয়েছে গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্নায়ুযুদ্ধের সময় ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের প্রকাশ্য কোনো সম্পর্কই ছিল না। তবে গত প্রায় ২৫ বছরে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে ভারত। কিন্তু কেন এতো মাখামাখি,কেন এতো দহরম মহরম ???
ইতিহাস অবশ্য বলে, শুরু থেকেই যেন ইসরায়েলের প্রতি কিছুটা নমনীয় ভারত। ১৯৪৭ সালে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের জাতিসংঘের পরিকল্পনার বিপক্ষে ভোট দেয় ভারত। ১৯৫০ সালে নয়াদিল্লি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় ইসরায়েলকে। ১৯৫৩ সালে ইসরায়েল কনস্যুলেট খোলে মুম্বাইয়ে। পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন-যুক্তরাষ্ট্র স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ব্লকে ছিল ভারত। আবার ওই সময় জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) অন্যতম রূপকার ছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। বলা হয়, এসব কারণেই হয়তো ওই সময়টায় যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলের সঙ্গে প্রকাশ্যে কোনো সম্পর্ক রাখেনি নয়াদিল্লি।
তবে ভারত-ইসরায়েল আবার কাছাকাছি আসে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর। ১৯৯২ সালে ভারত পুরোপুরি কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে ইসরায়েলের সঙ্গে। এরপর মসৃণ গতিতে এগিয়ে যেতে থাকে দুই দেশের সম্পর্ক। এর ধারাবাহিকতায় ২০০২ সালে মহাকাশ গবেষণা সহযোগিতার জন্য ইসরায়েলি মহাকাশ সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। ২০০৬ সালে দুই দেশের মধ্যে কৃষি সহযোগিতাবিষয়ক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। আর গত বছর ২৫০ কোটি ডলারের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়তে যৌথ কর্মসূচি নেয়।
যদিও ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার পক্ষেও বিভিন্ন সময় অবস্থান দেখা যায় ভারতের। কারও কারও মতে, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছুটা ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছে ভারত। এর একটি কারণ হলো ভারতের বিপুলসংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠী। ভোটের কারণে কোনো সরকারই তাদের নাখোশ করতে চায় না। অন্য কারণটি হলো, ভারত তেল আমদানির জন্য ইরান ও আরব দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল। এই দেশগুলো স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে। তাদের এই অবস্থানের বিরুদ্ধে যেতে চায়নি নয়াদিল্লি।
গত মাসেও জাতিসংঘে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে দেখা গেছে ভারতকে। পবিত্র জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বীকৃতি প্রত্যাহারের পক্ষে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব অনুমোদন হয়। ওই প্রস্তাব নিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অনুষ্ঠিত ভোটাভুটিতে ১২৮ সদস্য ওই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। যার একটি ছিল ভারত। নয়াদিল্লির এমন অবস্থানের বিষয়ে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামীদের সংগঠন বিডিএসের ভারত শাখার প্রধান অপূর্ব গৌতম বলেন, জাতিসংঘের ভোটাভুটির সময় ভারত আসলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মতের বাইরে যেতে চায়নি। আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি চাপও ছিল নয়াদিল্লির ওপর।
ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের দাবি থেকে ইসরায়েলের চাওয়া হয়তো ছিল জাতিসংঘে ভারত অন্তত ভোটদানে বিরত থাকুক; যেমন বিরত ছিল অন্য ৩৫ দেশ। ও পি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির জিন্দাল স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের ডিন শ্রীরাম চাউলিয়া বলেন, ইসরায়েল ভারতের বাস্তব পরিস্থিতির বিষয়টি বুঝতে পেরেছে। এ কারণে বিপক্ষে ভোট দেওয়ার পরও ইসরায়েল ভারতের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে কোনো শর্ত দেয়নি।
জেরুজালেম পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, স্নায়ুযুদ্ধের সময় নেহরু ইসরায়েলের সঙ্গে প্রকাশ্যে সম্পর্ক না রাখলেও ১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের সময় অস্ত্র চান ইসরায়েলের কাছে। ওই সময় অস্ত্র সহায়তা দেয় ইসরায়েল। এ ছাড়া ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালেও ভারতকে অস্ত্র দেয় ইসরায়েল। ১৯৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা ছিল ভারত-পাকিস্তানের ওপর। তাই তৃতীয় কোনো দেশের কাছে যেতে হয় নয়াদিল্লিকে। এরপর সোভিয়েতের পতনের পর ভারত মূলত সহজে আধুনিক অস্ত্র পেতে তাই ইসরায়েলের কাছে যায়। কারণ হিসেবে বলা যায়, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ভারত বিভিন্ন সময় পুরোনো প্রথাগত অস্ত্র কিনেছে। আধুনিক অস্ত্রের জন্য ইসরায়েলই তাদের কাছে ভালো বিকল্প।
এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভারত। ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে হাতে গোনা কয়েকটি দেশের একটি হিসেবে ভারতকে কাছে পাচ্ছে ইসরায়েল। এটাকেও ইসরায়েলের জন্য একধরনের পাওয়া বলা যায়। এ ছাড়া ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র আমদানিকারক দেশ ভারত। দেশটি প্রতিবছর ১০০ কোটি ডলারের অস্ত্র বা সরঞ্জাম আমদানি করে ইসরায়েলের কাছ থেকে। এর বাইরে ধীরে ধীরে জ্বালানি, কৃষিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার ক্ষেত্র বাড়ছে তাদের। এটাকে বড় ইতিবাচকভাবে দেখছে ইসরায়েল। এ কারণেই কি না জাতিসংঘে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ভোটের প্রসঙ্গ তুলে ভারতে নেতানিয়াহু বললেন, ‘কোনো কোনো সময় পারস্পরিক সম্পর্ককে শুধু একটি ভোট দিয়ে বিচার করা যায় না।’
১৫ বছরের মধ্যে প্রথম ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারতে আসা নেতানিয়াহুর সঙ্গে নিয়ে এসেছে ১৩০ জনের প্রতিনিধিদল। নয়াদিল্লি বলছে, নেতানিয়াহুর এই সফরে দুই দেশের মধ্যে সাইবার নিরাপত্তা, জ্বালানি, মহাকাশে সহযোগিতা ও চলচ্চিত্র নির্মাণ খাতে চুক্তি হবে। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে এর আগে স্বাক্ষরিত প্রযুক্তি, পানি ও কৃষিবিষয়ক চুক্তিগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হবে।
তবে ভারত-ইসরায়েলের পারস্পরিক সহযোগিতার কেন্দ্রে থাকবে প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা খাত—সেটা বলাই যায়।