ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ অর্থ মন্ত্রনালয়ের বিস্বস্ত সূত্রে জানা যায় অবৈধ হাসিনা সরকার আরো ৩টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দিচ্ছে।এগুলো হলো (১) পিপলস ব্যাংক (২) বেঙ্গল ব্যাংক এবং (৩) ‘পুলিশ ব্যাংক’ ।এবং যথারীতি আগের গুলোর মতো এই ৩টি নতুন ব্যাংকও দেয়া হচ্ছে সম্পুর্ন রাজনৈতিক বিবেচনায়।
অর্থ বিশেষজ্ঞগন মনে করেন বিদ্যমান ভয়াবহ পরিস্থিতির উন্নতি না করে আরো ৩টি নতুন ব্যাংক ব্যাংকিং সেক্টরকে পৌছে দেবে রসাতলের অতলে।
‘পিপলস ব্যাংক’ আওয়ামী লীগের যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী নেতা এম এ কাশেমের এবং ‘বেঙ্গল ব্যাংক’ আওয়ামী লীগের সাংসদ মোরশেদ আলমেরএবং পুলিশ ব্যাংক হবে বাংলাদেশ পুলিশের নিজস্ব আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে দেশে ৫৮টি ব্যাংক, তফসিলি নয় এমন ৬টি নন-ব্যাংক এবং ৩৩টি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান জনসাধারণের কাছ থেকে আমানত নেয় এবং ঋণ বিতরণ করে।
২০১৩ সালে আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞদের প্রবল অাপত্তি সত্ত্বেও সরকারের ইচ্ছায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক আওয়ামীপন্থি নেতাদেরকে ৯টি নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয় যার বেশিরভাগেরই বর্তমান অবস্থা তথৈবচ এবং ফারমার্স ব্যাংক’, এনঅারবি কমার্শিয়াল,এনঅারবি গ্লোবসহ কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা খুবই নাজুক। এহেন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সকল মহলের তীব্র বিরোধিতার মুখে সরকার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাদের নিজেদের লোকদেরকে নতুন ব্যাংক দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এ সিদ্ধান্ত তাদের দেউলিয়াত্ব প্রমাণ করে।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকে ‘অশনি সংকেত’ বেজে উঠেছে। অর্থনীতির চালিকাশক্তি ব্যাংকিং খাত একেবারেই অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে। দুর্নীতি, অনিয়ম, অরাজকতা আর ঋণ জালিয়াতি নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাংক জগতে। ঋণের নামে আমানত কারীদের হাজার হাজার কোটি টাকার আমানত লুটপাট করে নিচ্ছে এরা। গেল অর্থবছরেই সোনালী ব্যাংকের ১২৫৭ কোটি টাকাসহ বিভিন্ন ব্যাংক হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। সুশাসন, জবাবদিহিতা আর নিয়মনীতি নির্বাসনে গেছে অর্থনীতির এই গুরুত্বপূর্ণ খাতে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও একটি সংঘবদ্ধ চক্র, অসৎ ব্যাংক কর্মকর্তা আর আওয়ামী লীগ সমর্থক ব্যাংক পরিচালকবৃন্দ ব্যাংক জগতে এই নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টির জন্য দায়ী।
আজ দেশের প্রায় সব কটি ব্যাংক খেলাপি ঋণের চাপে দিশেহারা। ২০০৯ সালে যেখানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা আজ ৮ বছরের মাথায় অর্থাৎ ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তা দাঁড়িয়েছে ৮০ হাজার ৩’শ কোটি টাকা অর্থাৎ প্রায় ৪ গুন। শুধুমাত্র জুন ’১৭ থেকে সেপ্টেম্বর’১৭-এই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ হাজার ১৫৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা যা রীতিমত অবিশ্বাস্য।
৩০ সেপ্টেম্বর ’১৭ পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৭ লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ কোটি ৪৫ লাখ যার মধ্যে খেলাপি ঋণের (নিম্নমান, সন্দেহজনক ও মন্দ ঋণ) পরিমাণ ৮০ হাজার ৩’শ কোটি টাকা এবং অবলোপন করা হয়েছে (যা ফিরৎ পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ) ৪৫ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী খেলাপি ঋণ আর অবলোপন মিলে মোট ১ লাখ ২৫ হাজার ৩’শ কোটি টাকা বা ১৬.৬৫ শতাংশ ঋণ অনিশ্চয়তার খাতায় পড়েছে । বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন (২০১৭) অনুযায়ী ভুয়া দলিলের মাধ্যমে ঋণ দেয়া হয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা এবং শিল্পের কাঁচামাল, মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র আমদানি খাতে ভুয়া এলসি খাতে ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। ‘লোন এ্গেনস্ট ট্রাস্ট রিসিট’ অর্থাৎ বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে ব্যাংকগুলো তাদের বড় বড় গ্রাহককে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে, যা আদায় হচ্ছে না।
বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে ব্যাংক পরিচালকদের ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আর ২০১৬ সালে তাদের ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি রয়েছে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা এবং প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকার উপরে। সরকার ব্যাংক লুটেরাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে এসব ডিফল্টার ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য (বিশেষভাবে সরকারি ব্যাংক) জনগণের ট্যাক্সের টাকায় ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৪ হাজার কোটি টাকা ‘মূলধন পুনর্গঠনে বিনিয়োগের’ নামে ভর্তুকি দিয়েছে, যা জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করা যেত। এ যেন “সরকারি মাল, দরিয়া মে ঢাল”।
এমতাবস্থায়, সরকার আর্থিক জগতের মেরুদন্ড ব্যাংক ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পরিবর্তে নতুন ব্যাংক চালুর ব্যবস্থা করে ব্যাংক জগতকে পুরোপুরি ধ্বংসের ব্যবস্থা করেছে সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী লীগ দলীয় লোকদেরকে সুবিধা দেয়ার লক্ষ্যে। জানা যায় সম্প্রতি সরকারের শীর্ষ মহলের সম্মতিক্রমে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তিনটি ব্যাংক অনুমোদন দিয়ে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবটি বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের আগামী বোর্ড মিটিংয়ে এ তিন ব্যাংক বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালানোর জন্য অনুমোদন পেতে যাচ্ছে।
অর্থমন্ত্রী নতুন ব্যাংকের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেছেন ‘দেশে অনেক ব্যাংক থাকলেও দেশের প্রচুর অঞ্চল রয়েছে ব্যাংক সেবার বাইরে।’ কিন্তু আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন আওয়ামী সরকারের সর্বশেষ দেয়া নয়টি ব্যাংকের মধ্যে অধিকাংশ ব্যাংকের অবস্থা যখন করুন এবং বাংলাদেশে অর্থনীতির যে আকার তাতে নতুন ব্যাংকের কোন প্রয়োজন নেই। ৭ নভেম্বর, ২০১৭ এক সভায় প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী সাইদুজ্জামান পরিষ্কার বলেছেন, আমাদের বর্তমান অর্থনীতির আকারের প্রেক্ষিতে নতুন তিনটি ব্যাংকের কোন প্রয়োজন নেই। ইতিপূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংকও অর্থ মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানিয়েছে যে দেশের অর্থনীতি ও অর্থ বাজারের আকার, সঞ্চয় সৃষ্টি ও মূলধন গঠনের হার, আর্থিক খাতের গভীরতা, বিদ্যমান ব্যাংকিং অবকাঠামো ও ব্যাংকিং সেবার চাহিদা এবং ব্যাংকগুলোর প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান বিবেচনায় নতুন কোন ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ যুক্তি সঙ্গত হবে না ’’ (সমকাল ২৯-১১-১৭) । কিন্তু আওয়ামী লীগ অর্থ জগতের বিশেষজ্ঞ, ব্যাংক জগত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক ও দলীয় স্বার্থে দেশের অর্থনীতি তথা ব্যাংক জগতকে আরো সমস্যাসংকুল অবস্থায় ফেলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করছে না।
জনগণের ভোট বিহীন নির্বাচনে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসীন হয়ে আওয়ামী লীগ ভবিষ্যতের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে নিজেদের লোকদের আর্থিকভাবে লাভবান করার জন্যই এ সব করছে। কারণ ভবিষ্যতে নির্বাচিত হতে জনগণের ভোটের তাদের কোন তোয়াক্কা নেই। তারা পুনরায় পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসীন হতে ওঁৎ পেতে আছে।
আমাদের মতে, “ফারমার্স ব্যাংকের অনুমোদন দিলেন সরকারদলীয় নেতা মহিউদ্দিন খান আলমগীরকে। তিনি চেয়ারম্যান হলেন। গ্রাহকের কয়েক’শ কোটি টাকা ঋণের নাম জালিয়াতি হয়ে গেল। গ্রাহক টাকা রেখেছিলেন, তুলতে এসে দেখছেন তার টাকা নেই। পদত্যাগ করে চলে গেলেন মহিউদ্দিন খান আলমগীর। এখন এমডিকে অপসারণ করল বাংলাদেশ ব্যাংক। গ্রাহকের টাকা ফেরত দেওয়ার দায়িত্ব এখন রাষ্ট্রের। এমডি তিন বছর ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে পারবেন না। কিন্তু মহিউদ্দিন খান আলমগীর প্রশ্নের উর্ধ্বে। তিনি চেয়ারম্যান মানে ব্যাংকের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে, কেন গ্রাহকের টাকা জালিয়াতি করার সুযোগ দিলেন- এই প্রশ্নের উত্তর তাকে দিতে হবে না, তদন্ত-শাস্তিতো বহু দূরের ব্যাপার। ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে, গ্রাহকের টাকায় বিত্তবান হয়ে পদত্যাগ। বড়লোক হওয়ার এমন ব্যবস্থা নিশ্চয় পৃথিবীতে বিরল।কোনো একটা রেকর্ডে নিশ্চয় নাম ওঠানো যায়”।