DMCA.com Protection Status
title="শোকাহত

আজকের সংবাদ-সম্মেলনে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুল্যবান ভাষণ

সংবাদ-সম্মেলনে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ভাষণ 
স্থান : বিএনপি চেয়ারপার্সনের কার্যালয়, 
তারিখ : ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, সময় : বিকাল ৫.০০

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
প্রিয় সাংবাদিক ভাই-বোনেরা, 
আসসালামু আলাইকুম। 
দেশজাতির চরম সংকটের সময়ে আজ আপনাদের মাধ্যমে প্রিয় দেশবাসীর উদ্দেশে কিছু কথা নিবেদন করতে চাই। 
ভাষা শহীদের মাসে মাতৃভাষার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন, আমি শুরুতেই তাঁদের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। 
আমরা সকলেই জানি, এ দেশের জনগণ গণতন্ত্রপ্রিয়। গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামই এই জাতিকে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পথে এগিয়ে দিয়েছিল। 
তাই স্বাধীনতার পর জনগণের সব অধিকার কেড়ে নিয়ে একদলীয় শাসন-ব্যবস্থা কায়েম করা হলে এ দেশের মানুষ তা মেনে নেয়নি। 
সে কারণেই বাংলাদেশের জনগণের প্রিয় নেতা শহীদ জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছিলেন। জনগণকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন কেড়ে নেয়া সব অধিকার। 
এরপর আবারো স্বৈরশাসন চেপে বসলে এদেশের মানুষ প্রতিবাদ-মুখর হয়ে উঠে। আমরা ছাত্র, তরুণ, পেশাজীবীসহ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে গণতন্ত্রের জন্য আপোষহীন সংগ্রাম শুরু করি। বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা বুকের রক্ত ঢেলে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনে।
জরুরী অবস্থা জারীর নামে দেশে অগণতান্ত্রিক শাসনকেও এদেশের সাধারণ মানুষ মেনে নেয়নি। ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের কারণেই তাদের শাসন দীর্ঘায়িত করার খায়েশ পূরণ হয়নি।

সাংবাদিক বন্ধুগণ,
গণতন্ত্রের প্রতি এদেশের জনগণের প্রবল অনুরাগের কারণেই আমরা রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি হিসাবে গণতন্ত্রকেই বেছে নিয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য এদেশের মানুষের। তারা রক্ত ঢেলে দিয়ে গণতন্ত্র এনেছে। বারবার সেই গণতন্ত্র এবং এদেশের মানুষের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের জনগণ তাদের কষ্টার্জিত গণতন্ত্র এবং অধিকারগুলো আজ আবার হারিয়ে ফেলেছে। তথাকথিত উন্নয়নের নামে শোষণ, বঞ্চনা, লুটপাট ও অত্যাচারের এক দুঃসহ দুঃশাসন আজ জনগণের বুকের ওপর চেপে বসেছে। এই স্বৈরশাসন জনগণকে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। তারা মানুষকে আজ ভাতে মারছে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।

মানুষের কাজের সংস্থান নেই। চাকরির খোঁজে লুকিয়ে বিদেশে যাবার পথে আমাদের তরুণেরা সাগরে ডুবে মরছে।
উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় পাঁচ-দশগুণ বাড়িয়ে এরা লুটের রাজত্ব কায়েম করেছে। কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের নামে বিদ্যুৎ খাতকে বানিয়েছে হরিলুঠের কারখানা। শেয়ার বাজার এরা লুটে খেয়েছে। অর্থ লোপাট করে ব্যাংকগুলো করে ফেলেছে দেউলিয়া। হাজার হাজার কোটি টাকার তছরুপকে এরা ‘সামান্য ক্ষতি’ বলে উপহাস করছে। বিদেশে পাচার করছে হাজার হাজার কোটি টাকা। সুইস ব্যাংকে এরা পাচার করা অর্থের পাহাড় গড়েছে। যারা এই দুর্নীতি করছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত হয় না, তদন্ত হলেও সেই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়না। দোষীদের গ্রেফতার করা হয় না। বিচার হয় না। অন্যায়-অবিচার ও শোষণ-বঞ্চনা-লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সকল পথ এরা বন্ধ করে দিয়েছে। হামলা-মামলা, গ্রেফতার ও জেল-জুলুম চালিয়ে প্রতিবাদী সব কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়া হচ্ছে। গণতন্ত্রেও লক্ষ কর্মী আজ মানবেতর জীবনযাপন করছে। অপহরণ, গুম, খুনের এক ভয়াবহ বিভীষিকায় বাংলাদেশ আজ ছেয়ে গেছে। ঘরে ঘরে আজ হাহাকার। স্বজন হারানো কান্নার রোলে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। 
হেনস্তা ও অপমানের ভয়ে নাগরিক সমাজ স্বাধীন মত প্রকাশের সাহস হারিয়ে ফেলেছে। এই দুঃসহ অবস্থার মধ্যেও একদল উচ্ছিষ্টভোগী স্তাবকের গুণকীর্ত্তনে মানুষ অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছে। দলীয়করণ, ভীতিপ্রদর্শন ও নানা অপকৌশলের মাধ্যমে দেশের বিচার ব্যবস্থাকে আজ প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। 
২০১৪ সালে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি অবশ্যই সে নির্বাচনে অংশ নিতো। তাহলে বিএনপিই জনগণের সমর্থনে এখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব থাকতো। 
যাদের আজ ক্ষমতায় থাকার কথা সেই দলের সঙ্গে বিনাভোটের সরকার এমন আচরণ করছে যেন বিএনপি নির্মূল করাই তাদের প্রধান কাজ। 
আমাদেরকে অফিসে মাসের পর মাস আটকে রাখা হয়েছে। সেই সময়ে বাইরের নানা ঘটনার জন্য আমাকে আসামী করে মামলা করা হয়েছে। আমার দলের নেতা-কর্মীদের দিয়ে জেলগুলো ভরে ফেলা হয়েছে। হাজার হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে। যারা লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষ খুনের নির্দেশ দেয়, গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন দিয়ে বাসযাত্রী পুড়িয়ে মারে, যারা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের নামে ব্যাংকে আগুন, পেট্টোল পাম্পে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে, রেল লাইন তুলে দিয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধ করেছে দেশজুড়ে তা-ব চালিয়েছে, তারাই আজ আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করছে। আমরা সন্ত্রাসে বিশ্বাস করিনা। সারা দেশে প্রকাশ্য সন্ত্রাস করছে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয় না। তাদের কোনো বিচার হয়না।

প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ, 
দেশের সব প্রথা-প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা হয়েছে। কথা বলার অধিকার নেই, গণতন্ত্র নেই, মানুষের ভোটের অধিকার নেই। দশ টাকা দরে চাল খাওয়াবার ওয়াদাকে ভয়াবহ ভাঁওতাবাজি হিসাবে প্রমাণ করে মোটা চালের কেজি এখন পঞ্চাশ টাকা। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম। 
দেশে ন্যায়বিচার নেই। ইনসাফ নেই। জনগণের কোনো নিরাপত্তা নেই। নারী ও শিশুরা নির্যাতনের শিকার। 
দেশে আজ সত্যিকারের সংসদ নেই। তথাকথিত সংসদে নেই প্রকৃত বিরোধী দল। শাসকদের কোথাও কোনো জবাবদিহিতা নেই। 
সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কে বৈরী প্রচারণা ও ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে। দলীয়করণ ও অন্যান্য হীন পন্থায় প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীকে জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছে। শিল্পায়ন, উৎপাদন ও বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়েছে। মানুষের কাজ নেই। ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে গভীর মন্দা। ডলারের দাম বাড়ছে টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। মাদকের বিষাক্ত ছোবলে তরুণ সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমাদের ভবিষ্যৎ ডুবে যাচ্ছে এক গভীর অন্ধকারে।
এই দুঃসহ অবস্থা থেকে বাংলাদেশের মানুষ মুক্তি চায়। তারা তাদের অধিকার ফিরে পেতে চায়। তারা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের সেই আশা-আকাঙক্ষার প্রতিফলন ঘটাতেই আমরা গণতন্ত্রের জন্য আবারো সংগ্রাম শুরু করি। সেই সংগ্রামের পথে অনেক জীবন ইতোমধ্যে ঝরে গেছে। অনেক মানুষ গুম ও খুন হয়েছে। দুঃসহ বন্দীজীবন কাটাচ্ছে অগণিত নেতা-কর্মী। অসংখ্য মানুষ হামলা, মামলা, হুলিয়া, নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আজকের দুঃশাসনের হাত অনেক নিরাপরাধ মানুষের রক্তে রঞ্জিত। এই রক্তপিপাসু শাসকদের কবল থেকে গণতন্ত্রকে মুক্ত করা সহজসাধ্য কাজ নয়। কিন্তু আমরা হার মানিনি। জনগণ পরাজিত হবে না। দুঃশাসন একদিন থাকবে না। কিন্তু যে কলঙ্কের ইতিহাস তারা রচনা করছে সেই কলঙ্কের ছাপ চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে।

সাংবাদিক ভাই-বোনেরা, 
কেবল নিজেদের দলীয় স্বার্থে ও সুবিধার্থে সংবিধান বদল করে গায়ের জোরে যারা এখন ক্ষমতায় টিকে আছে তারা জনগণের ভোটে আসেনি। দেশের মানুষ তাদের নির্বাচিত করেনি। তাদের দেশ পরিচালনার প্রতি জনগণের সায় ও সম্মতি নেই। নৈতিক দিক থেকে এরা অবৈধ। তাই তারা যতই হুংকার দিক, তাদের কোনো নৈতিক সাহস ও মনোবল নেই।

এই শাসকদের কোনো গণভিত্তি নেই। পেশীশক্তি, সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে জনগণের বিরুদ্ধে অপব্যবহার করে ওরা টিকে আছে। জনগণের সমর্থন নেই বলেই তারা সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে ভয় পায়। আমরা গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চাই। জনগণের অধিকার তাদেরকে ফেরত দিতে চাই। তাই আমরা আন্দোলন করছি একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য। যে নির্বাচনে মানুষ অবাধে ভোট দিতে পারবে এবং সেই ভোট সঠিকভাবে গণনা করে সুষ্ঠুভাবে ফলাফল ঘোষণা করা হবে। সকল দল অংশগ্রহণ করতে পারবে। তেমন সুষ্ঠু নির্বাচন তারা চায় না। তাদের কথা, ক্ষমতায় থেকে এবং সংসদ বহাল রেখেই তারা নির্বাচন করবে। যাতে মানুষ ভোট দিতে না পারে এবং কারচুপির মাধ্যমে ফলাফল পাল্টে দেয়া যায়। এই প্রহসন তারা একবার করেছে। আবারো করতে চায়। সেই উদ্দেশ্যেই তারা আমাদেরকে নির্যাতন ও হামলা-মামলা ও বন্দি করে তটস্থ রেখে সরকারি খরচে এক বছর আগে থেকেই নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ প্রহসন নয়, সত্যিকারের নির্বাচন চায়। তেমন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছি বলেই আজ আমাদের ওপর এতো জুলুম-নির্যাতন, এতো মিথ্যা মামলা। 
আপনারা জানেন, আমার বিরুদ্ধে তেমনি এক মিথ্যা মামলায় আগামীকাল রায় হবে। এই রায়কে কেন্দ্র করে শাসক মহল আমাদের চেয়ে বেশি অস্থিও ভীত হয়ে জনগণের চলাচলের অধিকার প্রতিবাদের অধিকার সভা-মিছিলের সাংবিধানিক অধিকার, প্রশাসনিক নির্দেশে বন্ধ করা হচ্ছে। ভিত্তিহীন ও মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদের ভয়ে ভিত হয়ে এ হীন পথ খুঁজে নিয়েছে সরকার। সারাদেশে তারা বিভীষিকা ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। জনগণের প্রতিবাদের সম্ভাবনাকে তারা এতোটাই ভয় পায়!
আদালত রায় দেয়ার বহু আগে থেকেই শাসক মহল চিৎকার করে বলে বেড়াচ্ছে, আমার জেল হবে। যেন বিচারক নন, ক্ষমতাসীনরাই রায় ঠিক করে দিচ্ছে। প্রধান বিচারপতিকে চাপের মুখে পদত্যাগ ও দেশত্যাগে বাধ্য করার পর কোনো আদালত শাসকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার ও ইনসাফ কায়েম করতে সাহস পাবে কিনা তা নিয়ে সকলেরই সন্দেহ আছে। তারপরেও দেশবাসীর উদ্দেশে সগৌরবে জানাতে চাই যে, আপনাদের খালেদা জিয়া কোনো অন্যায় করেনি। কোনো দুর্নীতি আমি করিনি। 
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে কুয়েতের তৎকালীন আমীরের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিলো। তাঁর নামকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য কুয়েতের আমীর যে অনুদান প্রদান করেন তা তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কর্ণেল মোস্তাফিজুর রহমানের উদ্যোগে নিয়ে আসা, সেই অর্থের বিলিবন্টন, তহবিল পরিচালনা অর্থাৎ জিয়া অরফানেজের সঙ্গে আমি কখনো কোনোভাবেই জড়িত ছিলাম না। তাছাড়া এই অর্থ সরকারি অর্থ নয় এবং ট্রাস্টটিও প্রাইভেট ট্রাস্ট। ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে এ মিথ্যা মামলায় আমাকে জড়িত করা হয়েছে। আমার আইনজীবীরা আদালতে তা প্রমাণ করেছেন। সব চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, জিয়া অরফানেজের একটি টাকাও তছরুপ হয়নি। সমস্ত টাকা প্রতিষ্ঠানের নামেই ব্যাংকে জমা আছে। এখন সুদাসলে সেই টাকা বেড়ে প্রায় তিনগুণ হয়েছে। এ মিথ্যা মামলায় ন্যায়বিচার হলে আমার কিছুই হবে না। ইনশাআল্লাহ্ আমি বেকসুর খালাস পাবো। দেশে ন্যুনতম আইনের শাসন এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকলে এই জালিয়াতিপূর্ণ মামলা যারা দায়ের করেছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হওয়া উচিত। যারা এই মামলা দায়েরের নির্দেশ দিয়েছে তাদেরও সাজা হওয়া উচিত। আর যদি শাসক মহলকে তুষ্ট করার জন্য অন্য রকম কোনো রায় হয়, তাহলে তা কলঙ্কের ইতিহাস হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের মানুষ অন্যায়কারী কাউকেই ক্ষমা করে না, করবে না। 
আমি যে-কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত আছি। আমাকে জেল বা সাজার ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ হবে না। আমি মাথা নত করবো না। জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি থেকে পিছু হটবো না। জনগণকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। আমাকে রাজনীতির ময়দান ও নির্বাচন থেকে দূরে রাখা এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য আদালতকে ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু তাতেই একদলীয় শাসন কায়েম ও খালি মাঠে গোল দেয়ার খায়েশ পূরণ হবে বলে আমি মনে করি না। 
স্বৈরশাসক আইউব খান এক সময় মিথ্যা অভিযোগে মামলা করে এদেশের জনপ্রিয় রাজনীতিবিদের ‘এব্ডো’ অর্থাৎ নির্বাচন ও রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করেছিল। ইতিহাস সাক্ষী, সেই ‘এব্ডো’ টেকে নাই। গণঅভ্যুত্থানে আইউবের পতন ঘটেছিল। 
ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দিনের অবৈধ সরকার রাজনীতিবিদদের হেয় করা এবং দীর্ঘদিন ক্ষমতায় টিকে থাকার উদ্দেশ্যে আমাকে বিদেশে চলে যেতে বলা হয়েছিলো, আমি তাদের কথায় রাজি না হয়ে আপনাদের ছেড়ে দেশ ছেড়ে যাইনি। যার জন্য আমার এবং আমার সন্তানদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছিলো। আমাকে এক বছর নয় দিন কারারুদ্ধ করে রেখেছিলো। আমার দুই সন্তানকেও কারারুদ্ধ করে নির্যাতন করেছিলো। সেই অবৈধ সরকার আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছিল। 
সেই অবৈধ সরকারের সঙ্গে গোপন আঁতাত করে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনাসহ তাদের দলের নেতা-কর্মীদের হাজার হাজার মামলা তুলে নিয়েছে। আর আমিসহ আমাদের নেতা-কর্মীদের সেই সব মামলায় হেনস্তা করা হচ্ছে। যোগ হয়েছে হাজারো নতুন নতুন মিথ্যা মামলা। 
জরুরি সরকারের সে-সব মামলায় আওয়ামী লীগের অনেকের সাজা হয়েছিল। দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত সেই আসামীরাও বিনাভোটে এমপি-মন্ত্রী হয়ে এখন আমার বিরুদ্ধে হুংকার দিচ্ছে। তারা ক্ষমতায় থাকবেন আর আমাদের বিরুদ্ধে শুধু অবৈধ সরকারের দেয়া মামলা চলবেÑএই অন্যায় বাংলাদেশ মেনে নেবেনা।

প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ, 
আমি কম বয়সেই স্বামী হারিয়েছি। দেশের জন্য জিয়াউর রহমান জীবন দিয়েছেন। 
দলের নেতা-কর্মীদেও দাবিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় রাজনীতির বিপদসংকুল পথে পা বাড়িয়েছি। 
আরাম-আয়েশ, সুখ-শান্তি ও নিন্তরঙ্গ জীবন বিসর্জন দিয়েছি। 
আমার প্রিয় দেশবাসী আমাকে তার প্রতিদান দিয়েছে অপরিমেয় ভালোবাসায়। প্রতিবারের নির্বাচনে পাঁচটি করে আসনে পর্যন্ত তারা আমাকে নির্বাচিত করেছেন। কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে আজ পর্যন্ত আমি পরাজিত হইনি। জনগণের সমর্থনে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হবার গৌরব আমি অর্জন করেছি। তিন-তিনবার তারা আমাকে প্রধানমন্ত্রী করেছেন। এখনো আমি দেশের যে প্রান্তেই যাই উচ্ছ্বাসিত জনজোয়ারে আমি তাদের ভালোবাসায় অভিষিক্ত হই। আমি রাষ্ট্র পরিচালনায় কিংবা বিরোধী দলে যেখানেই থাকি এই জনগণ প্রতিটি সুখে-দুঃখে, শান্তিতে-সংগ্রামে আমার সাথী হন। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। 
রাজনীতির অঙ্গনে পা রাখার পর থেকে আমি জনগণকে যতটা সময় দিয়েছি, পরিবার ও সন্তানদের ততোটা সময় দিতে পারিনি। কারাগারে থাকতে আমি আমার মাকে হারিয়েছি। অফিসে অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় আমি একটি সন্তান হারিয়েছি। আরেকটি সন্তান নির্যাতনে পঙ্গু হয়ে দূরদেশে এখনো চিকিৎসাধীন। আমার এই স্বজনহীন জীবনেও দেশবাসীই আমার স্বজন। আল্লাহ্ আমার একমাত্র ভরসা। আমি যেমন থাকি, যেখানেই থাকি যতক্ষণ বেঁচে থাকবো দেশবাসীকে ছেড়ে যাবো না। 
প্রিয় দেশবাসীর প্রতি আমার আবেদন, আমাকে আপনাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা হলেও বিশ্বাস করবেন, আমি আপনাদের সঙ্গেই আছি। আপনারা গণতন্ত্রের জন্য, অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য, জনগণের সরকার কায়েমের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। বাংলাদেশে সব সময়ই ছাত্র-যুবক তরুণেরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেÑ ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছেÑ রাষ্ট্রভাষা বাংলা। সৈনিক, ছাত্র-জনতার মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা। এই ছাত্র-জনতা আন্দোলনেই স্বৈরাচার পরাজিত হয়েছে। আজ গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সেই ছাত্র, জনতাকে আহ্বান জানাই এগিয়ে আসতে বিএনপি, ২০ দলসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক দল, কৃষক শ্রমিকসহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে আমি বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি। 
আওয়ামী লীগেও অনেকে আছেন যারা গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকারে বিশ্বাস করেন এবং ভবিষ্যত পরিণতির কথা ভাবেন। তাদের প্রতিও আমার একই আহ্বান রইলো। 
আগামীতে অনেক ফাঁদ পাতা হবে, অনেক ষড়যন্ত্র হবে, সবাই সাবধান ও সতর্ক থাকবেন। বুঝে-শুনে কাজ করবেন। এই দেশ আমাদের সকলের। কোনো ব্যক্তি বা দলের নয়। 
আমরা সংঘাত, হানাহানি, নৈরাজ্য চাই না। আমরা শান্তি চাই। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। এখনো আমরা আশা করে বসে আছি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে। 
সেই প্রত্যাশা রেখেই আহ্বান জানাই, হুমকি-ধামকি ও নির্যাতনের পথ ছেড়ে আসুন, আমরা আলোচনার মাধ্যমে শান্তির পথে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করি। 
এ নির্বাচন কাউকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ এবং কাউকে ক্ষমতায় বসাবার নির্বাচন নয়। এ নির্বাচন হবে জনগণের রায় নিয়ে তাদের সম্মতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার নির্বাচন। 
আসুন, এই দুঃখী মানুষের দেশটাকে একটি শান্তির দেশে পরিণত করতে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে অবদান রাখি। 
আমাদের বয়স হয়েছে। আসুন, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর সম্ভাবনাময় দেশ রেখে যাই। 
এই বাংলাদেশটাকে আজ এক বৃহত্তর কারাগারে পরিণত করা হয়েছে। জনগণের শাসন কায়েমের মাধ্যমে দেশকে মুক্ত করতে পারলে আমরা সকলেই মুক্ত হবো ইনশাআল্লাহ্। 
আল্লাহ্ আমাদেরকে কামিয়াব করুন। 
সকলকে ধন্যবাদ। 
আল্লাহ্ হাফেজ। বাংলাদেশ-জিন্দাবাদ।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!