ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট এর মিথ্যা মামলায় পাঁচ বছরের কারাদন্ড প্রাপ্ত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আপিলের দ্রুত নিষ্পত্তি চায় অবৈধ হাসিনা সরকার। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ও সরকার পক্ষের আইনজীবীরা গত রবিবার জামিন শুনানিতে আদালতের কাছে এমনটাই দাবি করেছেন। তারা আদালতকে বলেছেন, জামিন দেওয়ার আগেই সাজার বিরুদ্ধে আপিলের শুনানি করা হোক এবং দ্রুত এর নিষ্পত্তি হোক।
এদিকে খালেদা জিয়াকে আগামী নির্বাচন থেকে দূরে রাখার অশুভ চেষ্টা থেকে এ ধরনের তাড়াহুড়া করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন তার আইনজীবীরা। এ অবস্থায়ও বিএনপি কঠোর কর্মসূচিতে না গিয়ে আরও কয়েকমাস শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যেতে চায়। সংঘাত-গ্রেপ্তার এড়াতে প্রয়োজনে ঘরোয়া কর্মসূচির দিকে যেতে চায় তারা। কিন্তু জামিন পাওয়ার ক্ষেত্রে ‘সময়ক্ষেপণ’ তাদের নতুন ‘রাজনৈতিক চিন্তায়’ ফেলছে। কারণ বিএনপির কাছে খবর আছে, সরকার মাস ছয়েকের মধ্যে এ মামলার আপিল নিষ্পত্তি করতে চায়। যদি তা-ই হয় এবং খালেদা জিয়ার সাজা বহাল থাকে, তবে তিনি নির্বাচনে অযোগ্য হবেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় খালেদা জিয়ার আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়টি দোদুল্যমান থেকে যায়। তবে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে আপিল নিষ্পত্তির পরও সাজা বহাল থাকলে সে ক্ষেত্রে তার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। সে কারণে আগামী নির্বাচনের আগেই সরকার দ্রুতই আপিল নিষ্পত্তি করতে চায়। জাতীয় নির্বাচনের জন্য সরকারের হাতে এখনো ৯-১০ মাস সময় রয়েছে। এটাকে সরকারের একটি রাজনৈতিক কৌশল বলেও মনে করছেন অনেকেই।
এ ব্যাপারে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গতকাল সোমবার আমাদের সময়কে বলেন, আপিল দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব। আমরা তাড়াতাড়িই নিষ্পত্তি চাই। আমরা আদালতকে বলেছি আপিল তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি করা হোক। সেভাবে আমাদের আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতিও রয়েছে।
তবে এভাবে তড়িঘড়ি করে আপিল নিষ্পত্তি করা হলে তা হবে ন্যায়বিচার পরিপন্থী বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ খন্দকার মাহবুব হোসেন। তার মতে, দেশে বর্তমানে ৩৩ লাখ মামলা বিচারাধীন। উচ্চ আদালতে বিচারাধীন ৪ লাখের ওপরে। এর মধ্যে ফাঁসির দ-ে দ-িত আছে কয়েকশ। তাদের আপিলের শুনানি হচ্ছে না। এমনকি আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী আছেন যারা নিম্নআদালতে দ-িত তাদের আপিলের শুনানি হচ্ছে না। তারা বহাল তবিয়তে মন্ত্রিত্ব চালিয়ে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় প্রসিকিউশন (সরকার ও দুদক) থেকে খালেদা জিয়ার মামলার আপিল শুনানির জন্য এত আগ্রহ কেন? এমন কি মধু আছে? যার কারণে এত তড়িৎ এ মামলার আপিল নিষ্পত্তি করতে হবে?
খন্দকার মাহবুব আরও বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের সময় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়কের আমলে মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়নের জন্য এ মামলা করেছিল। ওই সরকারের হাত ধরে ক্ষমতায় এসে আওয়মী লীগ তাদের মামলা বাতিল করেছে, প্রত্যাহার করেছে। এখন মাইনাস ওয়ান ফর্মুলা বাস্তবায়ন করতে চায়। অর্থাৎ খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে বাদ দেওয়ার জন্য একটা মিথ্যা মামলা দাঁড় করিয়ে সাজা দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি, এখন সব জায়গায় সরকারি ইচ্ছার প্রতিফলন হচ্ছে। এখন তাড়াহুড়া করে যেভাবেই হোক তারা যেন উচ্চ আদালতে সাজা বহাল রাখতে পারেন, সেই চেষ্টাই করছে। এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার মাহবুব বলেন, তারা যদি কোনোমতে মিথ্যা সাক্ষ্য-প্রমাণ দেখিয়ে সাজাটা উচ্চ আদালতে বহাল রাখতে পারে, তা হলে তারা তাকে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে দূরে রাখার অশুভ প্রচেষ্টায় সফল হবে। সে চেষ্টাই করা হচ্ছে। তারা বলবে সাজা বহাল থাকবে, এটা আগেই কীভাবে বলছি। আমার কথা হচ্ছে তা হলে এত তাড়াহুড়া কেন?
জানা গেছে, খালেদা জিয়া কারাগারে থাকলেও সময় অনুকূলে না থাকায় এ মুহূর্তে বড় কর্মসূচিতে যেতে চাচ্ছে না বিএনপি। কিন্তু শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে সরকার যেভাবে বাধা দিয়ে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করছে তাতে কিছুটা চিন্তিত দলের নেতারা। এ বিষয়ে দলের ভেতর দুটি মত রয়েছে। আপাতত কোনো কর্মসূচি থেকে বিরত থাকা অথবা ঘরোয়া কর্মসূচি পালন করা। কারণ এভাবে নেতাকর্মীরা গ্রেপ্তার হতে থাকলে জুন-জুলাইয়ে যে বড় ধরনের আন্দোলনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তা সফল করা কঠিন হবে।
এদিকে নথি আসা পর্যন্ত খালেদা জিয়ার জামিনের বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্ত ঝুলে থাকার বিষয়টি দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা নতুনভাবে চিন্তা করছেন। কেন এমনটি হলো তা নিয়ে গতকালও নেতারা নিজেদের মধ্যে আলাপ করেছেন। আইনজীবীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু আমাদের সময়কে বলেন, খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেওয়ার পর সরকার বিএনপিতে বিভক্ত তৈরি এবং তারেক রহমানকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই নেতাকর্মীদের হতাশায় ফেলতে নানা ধরনের ফন্দি করছে। তাদের নানাভাবে উসকানি দিচ্ছে।
এর আগে খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের শুনানিকালেও আপিল দ্রুত নিষ্পত্তির দাবি জানিয়েছে দুদক ও সরকারপক্ষ। জামিন শুনানিকালে সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতে বলেছেন, ‘অত্যাধুনিক মেশিন আছে। এক মাসের মধ্যে এ মামলার পেপারবুক রেডি করা সম্ভব। আপিলের শুনানি করেন। মামলার নথি আসুক, পেপারবুকও রেডি হোক। এখনই জামিন দিলে তা হবে বৈষম্যমূলক। দ্রুতই মামলাটির এসপার ওসপার হওয়া দরকার। তিনি আরও বলেন, জামিন পেলে এই আপিলের আর শুনানি হবে না। বিচারিক আদালতে এ মামলার বিচার বিলম্বের বিষয়টি তুলে ধরে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সেখানে যেটা হয়েছে, এখানেও আমরা সেটা হতে দিতে চাই না।
আর আদালতের কাছে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খানের বক্তব্য হচ্ছে, ‘আদেশ দিয়ে একবারে আপিল নিষ্পত্তি করতে পারেন। আদালত আদেশ দিলে পেপারবুক তৈরিতে এক মাসের বেশি লাগার কথা নয়। শর্ট সেনটেন্স (কম সাজা) ও স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনায় জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সিরিয়াস অবজেকশন (গুরুতর আপত্তি) আছে।’ তারা খালেদা জিয়ার জামিনের আগেই আপিল নিষ্পত্তির জন্য আদালতের কাছে দাবি জানিয়েছেন। তবে হাইকোর্ট এ মামলার নথি আসার পর খালেদা জিয়ার জামিনের বিষয়ে আদেশ প্রদানের জন্য ধার্য করেছেন।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিচারিক আদালত খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদন্ড দিয়েছেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে তিনি হাইকোর্টে আপিল করেছেন। আদালত গত ২২ ফেব্রুয়ারি তার আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেছেন। এ অবস্থায় খালেদা জিয়ার আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করছে নির্বাচন কমিশন ও উচ্চ আদালতের ওপর। কারণ এ ব্যাপারে আইনে স্পষ্টভাবে কিছুই বলা নেই। আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় দ-প্রাপ্তদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে সর্বোচ্চ আদালতেরও দু’ধরনের রায় রয়েছে। একটি রায় অনুযায়ী আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় দ-প্রাপ্ত ব্যক্তিরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। আরেকটি রায় অনুযায়ী অংশ নিতে পারবেন না।
দন্ডিত ব্যক্তির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের (২)(ঘ) উপ-অনুচ্ছেদে। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ‘নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদ-ে দ-িত হন এবং তাঁহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে’ তা হলে তিনি নির্বাচিত হওয়ার অযোগ্য হবেন। সংবিধানের এই বিধানটিও অস্পষ্ট। কারও দরকার হলে এবং সেই দ-ের বিরুদ্ধে আপিল বিচারাধীন থাকলে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়টি কী হবে সেটা এখানে উল্লেখ নেই। এ কারণে সরকার আপিল নিষ্পত্তির কৌশল নিয়েছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে ৫ বছর সশ্রম কারাদ- দেন আদালত। এ ছাড়া তারেক রহমানসহ অপর পাঁচ আসামিকে ১০ বছর করে সশ্রম কারাদ- দেওয়া হয়। এর পর ১৯ ফেব্রুয়ারি বিচারিক আদালতের এই রায়ের অনুলিপি প্রকাশিত হয়। পরের দিন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা হাইকোর্টে আপিল দায়ের করেন। মূল রায়সহ ১২২৩ পৃষ্ঠার আপিল আবেদনে ৪৪টি যুক্তি দেখিয়ে খালেদা জিয়ার খালাস চাওয়া হয়। আপিলটির গ্রহণযোগ্যতার শুনানির জন্য সেদিনই বিচারপতি ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে মেনশন (উত্থাপন) করেন। আদালত পরে ২২ ফেব্রুয়ারি শুনানি নিয়ে আপিলটি শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। এ ছাড়া ওই দিন খালেদা জিয়ার জামিন চেয়ে আবেদন করা হয়। যে আবেদনের ওপর গত রবিবার শুনানি হয়।