ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ সামান্য গাড়ীর হেলপার থেকে ব্যাংকের অডিট কমিটির চেয়ারম্যান, অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটেছে বেসরকারী ব্যাংক ফারমার্স ব্যাংকে। এক্ষেত্রে তার শিক্ষগত যোগ্যতাকেও আমলে নেয়া হয়নি। সূত্র জানায়, ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী (বাবুল চিশতী) স্বশিক্ষিত, ক্লাস থ্রি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। এই পরিমান বিদ্যা নিয়েই তিনি ব্যাংকার হয়েছেন। অডিট কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছেন। গ্রাহকদের শত শত কোটি টাকা বৈধ-অবৈধ ঋণ সুবিধা দিয়েছেন। আর এই অবৈধ ঋণ সুবিধা দিয়েই গ্রাহকের কাছ থেকে প্রায় ১৪৫ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন ফারমার্স ব্যাংকের অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী। দায়িত্বে থাকাকালে তিনি অবৈধভাবে ঋণ পেতে সহায়তা করে এই অর্থ হাতিয়ে নেন। এই টাকা গ্রহণে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন অত্যন্ত চতুরতার। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি। দুদকের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে থলের বিড়াল। এরই প্রেক্ষিতে ফারমার্স ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় চিশতী, তার স্ত্রী-সন্তানসহ ১৭ জনের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। দুদকের এক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে ওই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
এদিকে কি করে একজন স্বশিক্ষিত ব্যক্তি একটি ব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ের এমন দায়িত্ব পান এ নিয়েই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অনেকেই। তাদের মতে, সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে আইনের কোথাও যদি ফাঁকফোঁকর থাকে তা এখনই বন্ধ করা জরুরি। শিক্ষার ক্ষেত্রেও আইনের বাধ্যবাধকতা থাকা প্রয়োজন।
ফারমার্স ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ব্যাংকের নিয়ম লঙ্ঘন করে প্রতিদিন তিনি ব্যাংকে অফিস করতেন। ব্যাংকের অডিট কমিটির চেয়ারম্যানের কোন দপ্তর না থাকার পরও তিনি চেয়াম্যানের সমান সুযোগ-সুবিধা নিতেন। ব্যাংকের ভেতর বিলাসবহুল অফিস ছিলো তার। ব্যাংকের গাড়ি ব্যবহার করতেন এবং তার সুপারিশকৃত ঋণ পাশ করার জন্য খবরদারি করতেন সব সময়। শাখা ব্যবস্থাপকদের রাখতেন তোপের মুখে।
সূত্র জানায়, তার অফিস কক্ষে লোকজনের জট লেগেই থাকতো।
দুদক সূত্র জানায়, বিভিন্ন পর্যায়ের গ্রাহকের হিসাব থেকে নগদ অর্থ ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে ওই টাকা চিশতীর মালিকানাধীন বখশীগঞ্জ জুট স্পিনার্স মিলের হিসাবে জমা হয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে এই ঘুষ গ্রহণের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে দুদক সূত্র আরও জানায়, ২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি সময়ে চিশতীর ব্যাংক হিসাবে বিভিন্ন গ্রহকের হিসাব থেকে মোট ১৪৪ কোটি ৯৮ লাখ ৬১ হাজার ৬৪২ টাকা স্থানান্তর করা হয়। এই টাকা চিশতী ও তার পরিবারের সদস্যদের হিসাবে স্থানান্তর করা হলেও অবৈধভাবে ওই সংগ্রহ, উত্তোলন ও ভোগের ক্ষেত্রে মূল কর্তৃত্ব ছিল চিশতীর হাতেই। এর মধ্যে চিশতী ও তার স্ত্রী-সন্তানদের মালিকানাধীন বখশীগঞ্জ জুট স্পিনার্স মিলের ব্যাংক হিসাবে ১৩৮ কোটি ৮২ লাখ ৯২ হাজার ৬৪২ টাকা স্থানান্তর হয়। জামালপুরের বখশীগঞ্জে ফারমার্স ব্যাংকের শাখায় বখশীগঞ্জ জুট স্পিনার্স মিলের নামে খোলা ওই হিসাব থেকে টাকা উত্তোলনও করা হয়েছে। চিশতী ওই কোম্পানির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন।
দুদকের অনুসন্ধানে চিশতী ও তার পরিবারের সদস্যদের হিসাবে পে-অর্ডারের মাধ্যমে এক কোটি ৩৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ও চিশতীর মালিকানাধীন মেসার্স রাশেদ এন্টারপ্রাইজের হিসাবে আরেকটি পে-অর্ডারের মাধ্যমে এক কোটি ৮০ লাখ ৮৪ হাজার টাকা জমা হয়েছে। এই টাকাও ঘুষের বলে তথ্য রয়েছে দুদকের হাতে। অন্যের টাকায় চিশতী ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে শেয়ার কেনার তথ্যও মিলেছে। তাদের নামে কেনা শেয়ারের টাকা পরিশোধ করেছেন বিভিন্নজন।
গত বছরের ৭ মার্চ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত তাদের নামে কেনা হয়েছে এক কোটি ৩০ লাখ টাকার শেয়ার। এর মধ্যে এক কোটি ২০ লাখ টাকার শেয়ার কেনা হয় চিশতীর নামে। আরেকটি পর্যায়ে ১০ লাখ শেয়ার কেনা হয় তার ছেলে রাশেদুল হক চিশতীর নামে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চিশতী ও তার পরিবারের সদস্যদের হিসাবে জমা হওয়া টাকার সিংহভাগই ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে স্থানান্তর করা হয়েছে। এই শাখায় তিনি ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে ১৪টি হিসাব পাওয়া গেছে। ওই সব হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের ঘটনাও ঘটেছে।
সূত্র জানায়, চিশতী ব্যাংকটির অডিট কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকাকালে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৫ ধারা লঙ্ঘন করে কৃত্রিম ও ভুয়া ঋণ সৃষ্টি এবং বিভিন্ন অপকৌশল অবলম্বন করে অর্থ স্থানান্তরের মাধ্যমে শেয়ার কিনেছেন। এ ছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতারণা, বিশ্বাস ভঙ্গ ও প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন গ্রাহককে ঋণসহ অন্যান্য সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন। জানা গেছে, বেশ কিছুদিন থেকে চিশতী সপরিবারে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তাদের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে দুদকের উপপরিচালক মো. সামছুল আলম স্বাক্ষরিত চিঠিটি মঙ্গলবার ঢাকার মালিবাগে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চে পাঠানো হয়।
এরপরই তাদের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। দুদকের উপপরিচালক সামছুল আলম ও উপসহকারী পরিচালক জয়নাল আবেদীন অভিযোগটি অনুসন্ধান করছেন। বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারির সঙ্গে জড়িত ১৭ জন হলেন- মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী, তার স্ত্রী রুজী চিশতী, ছেলে রাশেদুল হক চিশতী, মেয়ে রিমি চিশতী, মাজেদুল হক চিশতী, রাশেদুল হক চিশতীর স্ত্রী ফারহানা আহমেদ, ফারমার্স ব্যাংকের এমডি অ্যান্ড সিইও এ কে এম শামীম, ডিএমডি আবদুল মোতালেব পাটোয়ারী, ব্যাংকের এসইভিপি গাজী সালাহ্উদ্দিন, ইভিপি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম মজুমদার, এসভিপি জিয়াউদ্দিন আহমেদ, ভিপি লুৎফুল হক, ভিপি মো. মনিরুল হক, এফভিপি মো. তাফাজ্জল হোসেন, এভিপি মোহাম্মদ শামসুল হাসান ভূঁইয়া, এইও মাহবুব আহমেদ ও ইও মোহাম্মদ জাকির হোসেন।
ব্যাংকটির পদত্যাগী চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীর বিরুদ্ধে ঋণ জালিয়াতি, ঋণ দিতে কমিশন নেওয়া, গ্রাহকের হিসাব থেকে নিজের হিসাবে অর্থ স্থানান্তরসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। তবে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি।
এদিকে বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংকের অডিট কমিটির পদত্যাগী চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতীর জম্মস্থান জামালপুরসহ ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে তাকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছে স্থানীয় জনতা ও ভুক্তভোগিরা।
উল্লেখ্য, বেশ কিছুদনি যাবৎ ফারমার্স ব্যাংকের অডিট কমিটির পদত্যাগী চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতীর দুর্নীতি তদন্ত করে তাকে গ্রেফতারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে অবরোধ করেছে ভুক্তভোগীরা। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে অবরোধ চলাকালে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন স্থানীয় আকুয়া ইউনিয়ন চালক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ মুসা, শরীফ আহমেদ, খায়রুল আলম, রানা প্রমুখ। তারা বলেন, মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী কুখ্যাত দুর্নীতিবাজ। ফারমার্স ব্যাংক লুট করে ব্যাংকটির বারোটা বাজিয়েছেন তিনি। তার অনিয়ম ও দুর্নীতিতে অনেক মানুষ নিঃস্ব হয়েছে। নিজে পদত্যাগে বাধ্য হয়ে প্রমাণ করেছেন তিনি অনেক বড় দুর্নীতিবাজ।
অবিলম্বে তার সব অনিয়ম ও দুর্নীতির সুষ্ঠু তদন্ত করে তাকে গ্রেফতার করারও জোর দাবি জানান বক্তারা।
উল্লেখ্য, বাবুল চিশতী বিগত বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে চোরাকারবার করে কোটি কোটি টাকার মালিক হন। বিএনপি সরকারের সাবেক স্বরাস্ট্র প্রতিমন্ত্রী ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার অন্যতম আসামী লুৎফুজ্জামান বাবরের ঘনিষ্ট সহচর ছিলেন এই চিশতী। এয়ারপোর্টসহ দেশের বিভিন্ন বর্ডার এলাকায় চোরাকারবারি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন তিনি। বাবুল চিশতীর নামে যেসব পন্যবাহী ট্রাক রাস্তায় চলাচল করতো পুলিশ সেগুলো যথাযথ চেক না করেই ছেড়ে দিতো। বাবুল চিশতীর ট্রাকগুলোই ছিলো চোরাকারবারিদের নিরাপদ বাহন।
বিএনপি-জামাত জোট সরকারের বিদায়ের পর বাবুল চিশতী রাতারাতি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং পরবর্তিতে সাবেক স্বরাস্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরের সাথে শখ্যতা গড়ে তুলে ফারমার্স ব্যাংক গড়ে তোলেন।