DMCA.com Protection Status
title="৭

জামিন হলেও মুক্তি পাচ্ছেন না খালেদা জিয়া,রয়েছে আরও ১০মামলার প্যাঁচ।

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ  জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দ-প্রাপ্ত কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হাইকোর্টের দেওয়া জামিন বহাল থাকলেও শিগগিরই মুক্তি পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। তারা বলছেন, সচরাচর কোনো আসামির যদি একাধিক মামলা থাকে, তাহলে সেসব মামলায় জামিন না পাওয়া গেলে মুক্তি পাওয়া যায় না। খালেদা জিয়াকে কারামুক্তি পেতে হলে আপাতত অন্তত ছয়টি মামলায় জামিন এবং চারটি মামলায় হাজিরা পরোয়ানা প্রত্যাহারের প্রয়োজন রয়েছে।

এর আগে গতকাল বুধবার সকালে হাইকোর্টের জামিনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদকের আপিল খারিজ করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির বেঞ্চ তার জামিন বহালের রায় দেন।

 

আদেশে আপিল বিভাগ বলেন, দুটি আপিলই খারিজ করা হলো। মামলায় হাইকোর্টে পেপারবুক প্রস্তুত। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চকে আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে এ মামলার আপিল নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হলো। রায় ঘোষণার প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর খালেদা জিয়ার আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলী আপিল বিভাগের কাছে জামিন বহালের সংক্ষিপ্ত আদেশের কপি চেয়ে আবেদন জানান; কিন্তু আদালত তা নাকচ করে দেন।

 

এর আগে ১২ মার্চ এ মামলায় হাইকোর্ট খালেদা জিয়ার চার মাসের জামিন মঞ্জুর করেন। এর পর রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদকের আবেদনে ১৪ মার্চ তার জামিন স্থগিত করেন আপিল বিভাগ। গতকাল রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদকের আপিল খারিজ করায় হাইকোর্টের জামিন বহাল থাকলেও কারামুক্তি বিলম্ব হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা।

 

রায় ঘোষণার পর খালেদা জিয়ার কারামুক্তির বিষয়ে তার আইনজীবী মওদুদ আহমদ বলেন, ‘এখনো তার কারামুক্তিতে কিছুটা বাধা আছে। কারণ সরকার নানা রকমভাবে তার কারামুক্তি বিলম্ব করার চেষ্টা করছে, করবে। কতগুলো মামলায় তাকে আসামি দেখানো হয়েছে। এটা সরকারের কৌশল। সব মামলা ভিত্তিহীন। ওইসব মামলায় ওনার কোনো ভূমিকা ছিল না; কিন্তু আইনের অপব্যবহার করে কোনো সম্পৃক্ততা না থাকা সত্ত্বেও তাকে সহযোগী আসামি দেখানো হয়েছে, যাতে করে তাকে আরও কিছুদিন জেলে রাখা যায়। এ মামলাগুলোয় তার জামিন নিতে হবে। এ জামিন নিতে যতটুকু সময় লাগে, সে সময়টুকু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। চেষ্টা করব খুব দ্রুত করার।’

 

আপিল বিভাগ খালেদা জিয়ার জামিন বহাল রাখায় নিম্ন আদালতে বিএনপি চেয়ারপারসনের জামিন পেতে খুব বেশি অসুবিধা হবে না বলে মনে করেন মওদুদ আহমদ। তিনি বলেন, একটি আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়া খুব শিগগির আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন।

 

আইনজীবী সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মোট ৩৬-৩৭টি মামলা রয়েছে। এসব মামলার মধ্যে কুমিল্লার তিনটি (একটি হত্যার অভিযোগে, একটি বিস্ফোরক আইনে ও একটি বিশেষ ক্ষমতা আইনের), ঢাকায় দুটি মানহানির অভিযোগে এবং নড়াইলে একটি মানহানির অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলায় আপাতত জামিন নিতে হবে। এ মামলাগুলোয়ও জামিন চূড়ান্ত হতে সময়সাপেক্ষ হতে পারে। কারণ যে ধাপেই জামিন হোক না কেন, সরকার প্রতিটি ধাপে আইনি লড়াইয়ে যাবে। চূড়ান্ত ধাপ অর্থাৎ আপিল বিভাগে আইনি লড়াই শেষ করার পর জামিন বহাল হলেই কেবল কারামুক্তির সম্ভাবনা তৈরি হবে। পাশাপাশি ইতোমধ্যে খালেদা জিয়ার চারটি মামলায় হাজিরা পরোয়ানা জারি রয়েছে। কারামুক্তির ক্ষেত্রে এই চারটি পরোয়ানার ব্যাপারেও আদালতের সিদ্ধান্ত লাগবে। এরপরও অন্য কোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর সম্ভাবনা থাকছে।

 

অন্যদিকে হাইকোর্টে খালেদা জিয়ার আপিল নিষ্পত্তি করতে সময় থাকছে মাত্র আড়াই মাসের মতো। এর মধ্যে সর্বোচ্চ আদালত সচল থাকবে দেড় মাসেরও কম। সেক্ষেত্রে অন্য মামলাগুলোয় চূড়ান্ত আইনি ধাপ শেষ করার আগেই যদি হাইকোর্টে আপিলের নিষ্পত্তি হয়ে যায় এবং সেক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার সাজা বহাল থাকে, তাহলে খালেদা জিয়ার কারামুক্তি আরও দীর্ঘসূত্রতার মুখে পড়বে।

 

সূত্র মতে, হাইকোর্ট সাজা বহাল রাখলে বা খালাস দিলে সংক্ষুব্ধ পক্ষ তার বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করতে পারবেন। সে অনুযায়ী হাইকোর্টের রায়ে সংক্ষুব্ধ পক্ষ আগস্টের মধ্যেই আপিল বিভাগে যাবে। আর আপিল বিভাগে গেলে সেখানেও মামলাটি দ্রুতই নিষ্পত্তি হবে। আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের আগেই এই মামলা আপিল বিভাগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হতে পারে। এই চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পর খালেদা জিয়ার সাজা বহাল থাকলে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়া তার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা আইন বিশেষজ্ঞদের।

 

বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল খালেদা জিয়ার মামলা প্রসঙ্গে বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে সর্বমোট ৩৬টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু দুটি মামলায় রয়েছে প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট। এ সংখ্যা আমি দায়িত্ব নিয়েই বলছি। কেননা, খালেদা জিয়ার মামলার সব ফাইল আমার কাছেই থাকে। এখন সরকার বাধা সৃষ্টি না করলে খালেদা জিয়ার এসব মামলায়ও মুক্তিতে বাধা থাকবে না। আর কোনো মামলাতেই জামিন নিতে হবে না।’

 

অন্যদিকে আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, ‘খালেদা জিয়ার কারামুক্তিতে আরও ৬ মামলায় জামিন পেতে হবে। এর মধ্যে ৪ মামলায় প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট আছে, এগুলো প্রত্যাহার করতে হবে।’

 

রায় ঘোষণার পর বুধবার নিজ কার্যালয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপিল বিভাগ খালেদা জিয়ার আপিল নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছেন। এখন আপিল শুনানির জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছি।’ তিনি বলেন, খালেদা জিয়া নিম্ন আদালতে এই মামলার বিচার ৯ বছর ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। আপিল বিভাগের আজকের আদেশের ফলে এখানে আর বিচারককে তিনি বিলম্বিত করতে পারবেন না বলে আশা করা যায়।

 

এক প্রশ্নের জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, সচরাচর কোনো আসামির যদি একাধিক মামলা থাকে, তাহলে সেসব মামলায় জামিন না পাওয়া গেলে মুক্তি পাওয়া যায় না। দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগে মূল আপিল নিষ্পত্তি করতে হবেÑ এটা উচ্চতর আদালতের নির্দেশ। আমরা অবশ্যই আপিল নিষ্পত্তির পদক্ষেপ নেব। আপিল বিভাগের এ রায়ের কপি পাওয়ার পর আমরা হাইকোর্ট বিভাগে যাব। আমরা আপিল শুনানি করতে প্রস্তুত আছি।

 

দলবল দেখে আমরা আদেশ দিই না : জামিন বহালের সংক্ষিপ্ত আদেশের কপি চেয়ে তার আইনজীবীরা আদালতে আবেদন জানালে তা নাকচ করে দেন আপিল বিভাগ। আদালত বলেন, সংক্ষিপ্ত আদেশ দেওয়ার বিধান নেই। তবে তাড়াতাড়ি জামিনের রায় প্রকাশ করা হবে। বেলা সাড়ে ১১টায় আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলী আদালতে বলেন, আমরা খালেদা জিয়ার জামিনের সংক্ষিপ্ত আদেশ চাচ্ছি। বেল বন্ড (জামিননামা) দাখিল করার জন্য সংক্ষিপ্ত আদেশ দরকার। আপনাদের আজকের রায় পত্রপত্রিকায়, টিভিতে প্রচার করা হয়েছে; হয়তো আপনাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হবে। আমাদের দিতে অসুবিধা নেই।

 

তখন অ্যাটর্নি জেনারেল আপত্তি জানিয়ে বলেন, খালেদা জিয়া তো আরও কয়েকটি মামলায় শ্যেন অ্যারেস্ট আছেন। এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, সেটি অন্য বিষয়। তবে এ মামলায় শর্ট অর্ডার (সংক্ষিপ্ত আদেশ) চাচ্ছি। আদালত বলেন, এ ধরনের শর্ট অর্ডার দেওয়ার নজির নেই। আপনার আবেদন রিফিউজ করা হলো। এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, হাইকোর্ট বিভাগের রুলসে শর্ট অর্ডার দেওয়ার বিধান আছে। আদালত বলেন, হাইকোর্টের বিধান কি আমাদের জন্য মানা বাধ্যতামূলক? আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, আমি তা বলছি না। এটা আছে তাই দেখালাম। আপনারা চাইলে তা দিতে পারেন। আদালত আবার বলেন, আপনার আবেদন রিফিউজ করা হলো।

 

এ সময় এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, শর্ট অর্ডারটা প্রয়োজন। সেজন্য আমি তো একা এসেছি। দলবল নিয়ে আসিনি। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, এটা কেমন কথা? দলবল নিয়ে এলেই কি আমরা আদেশ দিয়ে দিই? দলবল দেখে আমরা আদেশ দিই না।

 

বেঞ্চের অপর বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার এ মন্তব্যে উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, আপনি গুরুতর আপত্তিকর কথা বলেছেন। আপনি আমাদের ফোর্স করতে পারেন না। আপনারা ভুলে যান যে, কোর্টে আপনারা আইনজীবী; অফিসার অব দ্য কোর্ট। কোনো দলের লোক নন।

 

তখন এজে মোহাম্মদ আলী তার মন্তব্যের জন্য আদালতের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন। এ পর্যায়ে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, প্রধান বিচারপতি যেখানে নাকচ করে দিয়েছেন সেখানে আপনি তর্ক করছেন কেন? শেষে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনার আবেদন আমরা বিবেচনা করতে পারলাম না। বিবেচনা করার সুযোগ নেই।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!