ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর গতকাল ২৩শে মে সকালে ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন কংগ্রেসের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটিতে তাঁর প্রথম শুনানিতে বিশ্বজুড়ে আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য ও নির্ধারণ প্রক্রিয়া তুলে ধরেন ট্রাম্প প্রশাসনের অন্যতম নীতিনির্ধারক সাবেক কংগ্রেসম্যান ও সাবেক সিআইএ প্রধান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পিও।
শুনানিতে অন্যান্য দেশের পাশাপাশি উত্তর কোরিয়া দেশটি ছিল আলোচনার শীর্ষে। উল্লেখ্য মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএর পরিচালক থাকাকালীন মাইক পম্পিও এক গোপন সফরে উত্তর কোরিয়া গিয়ে ওই দেশটির নেতা কিম জং আনের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
বিশ্বজুড়ে আলোচিত রুদ্ধদার এই মার্কিন শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের তিন তিন বারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক বৈদেশিক উপদেষ্টা ও বিএনপির বিশেষ দূত জাহিদ এফ সরদার সাদী। মার্কিন শুনানিতে উপস্থিত থেকে নতুন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পিও এর সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন জাহিদ এফ সরদার সাদী।
সৌজন্য সাক্ষাৎ আর শুভেচ্ছা বিনিমেয়ের পাশাপাশি সাদী বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত অবহিত করেন মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের নতুন চীফকে।
তিনি বাংলাদেশে গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু এবং সংবাদমাধ্যমের প্রতি সরকারের ‘নেতিবাচক আচরণের’ বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদনে উঠে আসাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পিও কে উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়ে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
উল্লেখ্য মাইক পম্পিও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির তীব্র সমালোচনা করে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ করার অধিকার বাংলাদেশের আইনে থাকলেও সরকার তা সীমিত করেছে। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সভা-সমাবেশ করতে হচ্ছে।”
একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীকে প্রতিবেদনে ‘এনজিও’ হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, “এক সময়ের রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী এনজিও হিসেবে ঘরোয়া বৈঠকের অনুমতি চেয়েও পায়নি।”
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, প্রিন্ট ও অনলাইন গণমাধ্যম খুবই সরব এবং তাদের মতামত নিঃসংকোচে প্রকাশ করতে পারলেও যেসব গণমাধ্যম সরকারের সমালোচনা করে তারা নেতিবাচক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়।
রিপোর্টে “বাংলাদেশে সংবাদ মাধ্যম ও বাকস্বাধীনতায় নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানে বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিতের কথা বলা হলেও সরকার সে অধিকারের প্রতি ‘সম্মান প্রদর্শন করে না’ এবং এই অধিকারের প্রতি সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। গত বছর বাকস্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা ছিল উল্লেখযোগ্য। অনেক সাংবাদিক হয়রানি ও রোষানলের ভয়ে সরকারের সমালোচনার ক্ষেত্রে ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ আরোপ করছেন।” “কথা বলার অধিকারের প্রতি সরকারের একটি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কোনো কোনো সাংবাদিকও নিজে থেকেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেন সরকারের দমন-পীড়নের আতঙ্কে।”
বিচার বিভাগ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, আইনে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকলেও ‘দুর্নীতি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে’ তা কার্যকর হচ্ছে না।
বাংলাদেশের বিচার বিভাগে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের পাশাপাশি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে সরকারের সঙ্গে টানাপড়েনের মধ্যে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পদত্যাগের প্রসঙ্গও এসেছে প্রতিবেদনে।
ওই বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, “বছরের (২০১৭ সাল) শেষ দিকে সরকার প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা অভিযোগ উত্থাপন করতে থাকে। আর সরকারের এসব কথাবার্তাকে মানবাধিকার নিয়ে রাজনৈতিক অভিসন্ধিপূর্ণ বলে অভিযোগ করেছেন।”
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিচারক, সরকারি কৌসুলি ও আদালতের কর্মকর্তারা অনেক আসামির কাছে ঘুষ দাবি করেন। “ঘুষ যারা চাচ্ছেন তাদের প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত।”
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এই প্রতিবেদনে আরো বলেছে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে কথিত বন্দুকযুদ্ধে (ক্রসফায়ার) ১৬২ জন নিহত হয়েছেন এবং গত বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১১৮ জন ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ শিকার হন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিপীড়নের ঘটনায় দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তাদের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে ও বিচারে সরকার সামান্যই পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি আস্থা না পাওয়ায় অনেকেই তাদের কাছ থেকে সহযোগিতা নেন না বা অপরাধের অভিযোগ করেন না।” “বাংলাদেশে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিচারে সরকারের পদক্ষেপ সীমিত”।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে ৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে আর বছরের প্রথম ছয় মাসে ‘আটক ছয়জনকে হত্যা করে’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
৪২ বছরের প্রথা অনুযায়ী বিশ্বের প্রায় ২০০টি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট।
শুনানীর ইউটিউব ভিডিও লিংকঃhttps://youtu.be/iEVrd-g1Zes