ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ রাশিয়ায় বিশ্বকাপ নিয়ে মেতে থাকার কথা পুরো ফুটবল বিশ্বের। কেউ ব্রাজিল, কেউ আর্জেন্টিনা, কেউ ইংল্যান্ড, ফ্রান্স কিংবা কেউ বেলজিয়াম- নানা দেশের মানুষের নানান দলের সমর্থক। ৩২টি দল নিয়েই নিঃসন্দেহে সারা বিশ্ব ভাগ হয়ে গিয়েছিল ৩২টি ভাগে; কিন্তু রাশিয়া বিশ্বকাপ ছেড়ে ছোট্ট একটি ফুটবল দল সারা বিশ্বের নজর এক সঙ্গে কেড়ে নিলো, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করলো। দল-মত নির্বিশেষে সারা বিশ্বের সব মানুষই এই একটি ফুটবল দলের জন্য অকাতরে নিজের সমর্থন বিলিয়ে দিলো।
যেভাবে শুরু হলো থাই কিশোরদের দুঃস্বপ্নের যাত্রা
মু পা, থাইল্যান্ডের ভাষা। ইংরেজিতে যার নাম, দ্য উইল্ড বোয়ার্স ফুটবল টিম। বাংলায় অর্থ দাঁড়ায়, বন্য শুকরের ফুটবল দল। যে দলটিতে রয়েছে ১২ জন ফুটবলার। যাদের বয়স ১১ থেকে ১৬ বছর। কোচের বয়স মাত্র ২৫ বছর।
২৩ জুন, দিনটি ছিল শনিবার। দলের একজনের জন্মদিন। সব সময় যারা একসঙ্গে থাকে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ফুটবল খেলে, হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ ভাগ করে, তারা কি করে একজনের জন্মদিন পালন করবে না! সুতরাং পরিকল্পনা হলো, নিজেদের মধ্যেই ঘটা করে জন্মদিনটি পালন করার। সে জন্য তারা বেছে নিল, তাদের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা থ্যাম লুয়াং গুহা।
২৫ বছর বয়সী কোচ একাপল। দলের সদস্যদের তিনি সন্তানের মতোই ভালোবাসেন
শনিবার স্কুল ছুটির পর সেই জন্মদিন পালন করার জন্য ৭০০ বাথ (২৮ ডলার) দিয়ে স্থানীয় এক দোকান থেকে খাবার, পানি এবং মিষ্টি কিনে নিয়েছিল তারা। নিজেদের ব্যবহৃত বাইসাইকেল গুহা মুখে রেখে সেখানে প্রবেশ করলো জন্মদিনের উৎসব করার জন্য। গুহার প্রবেশমুখেই রাখা হলো সাইকেলগুলো এবং আরও ভেতরে প্রবেশ করলো তারা।
এই সময়ে গুহায় প্রবেশ করা ছিল নিষিদ্ধ
থ্যাম লুয়াংয়ের প্রবেশ মুখের অদুরেই কিন্তু সতর্কবাণী লেখা, ‘বৃষ্টির মৌসুমে গুহায় প্রবেশ করা নিষেধ। কারণ, যে কোনো সময় বন্যার পানি ধেয়ে আসতে পারে। তুমুলবৃষ্টিপাতে মুহূর্তেই পানিতে ভর্তি হয়ে যেতে পারে গুহার ভেতরের অংশ এবং বন্ধ হয়ে যেতে পারে বের হওয়ার রাস্তা।’ কিন্তু এই সতর্কবাণী তো শুধুই একটি লেখা মাত্র। এই কিশোররা প্রতিনিয়তই তো এটা দেখে এবং দেখে দেখে গুহার ভেতরে প্রবেশ করে। এই জায়গাটি যে তাদের খুব প্রিয় এবং ভালোবাসার!
কিন্তু দুর্ভাগ্য হলে যা হয়! মু পা ফুটবল দলের ১২ সদস্য যে সময়টায় জন্মদিন উদযাপনে গুহায় প্রবেশ করেছিল, সেটা হয়ে পড়েছিল দুঃসময়। বড্ড অসময়ে প্রবেশ করলো তারা গুহায়। সময়টা প্রচুর বৃষ্টিপাতের। বছরের এই সময়টায় থাইল্যান্ডের চিয়াং রাই প্রদেশসহ ওই অঞ্চলটাতে তুমুল বৃষ্টিপাতের। মু পা দলের ১২ কিশোর গুহায় প্রবেশ করার পরপরই শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। যা তাদেরকে ভয়ানক এক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিলো।
মু পা ফুটবল দলের সদস্যরা। যাদের বয়স ১১ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে
১২ কিশোরের পরিচয়
কিশোরদের অধিকাংশই ছিল পার্বত্য অধিবাসী। শান, লাহু এবং লুয়া গোত্রের উপজাতি। অনেকেই আছে আবার ল্যানা থাই উপজাতির (যারা থাইল্যান্ডের উত্তরাঞ্চল থেকে আগত)। পাহাড়ি কিশোর হওয়ার কারণে চরম ডানপিটে, দুরন্তপনা- সবই ছিল তাদের মধ্যে। শুধু তাই নয়, দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডও তাদের খুব প্রিয়। এক কথায় দারুণ অ্যাডভেঞ্চারাস। বলে রাখা ভালো, ১২ কিশোরের ২৫ বছর বয়সী কোচ একাপল কিন্তু শুরুতে তাদের সঙ্গে ছিলেন না। কিশোররা নিজেরাই প্রবেশ করেছিল গুহার ভেতর।
যেভাবে শুরু হলো খোঁজাখুঁজি
বৃষ্টির কারণে তারা গুহার ভেতর থেকে বের হয়ে না আসার কারণে দিনের শেষ দিকে শুরু হয় খোঁজাখুঁজি। পরিবারের সদস্যরা খুঁজতে বের হয়, কোথায় গেলো তারা? পরিবারের সদস্যরা জানতো, এই কিশোররা ফুটবল ভালোবাসে এবং তাদেরকে ফুটবল ভালোবাসতে শিখিয়েছেন একাপলই। সুতরাং, তিনিই জানবেন, কোথায় আছেন তারা।
একাপলকে গিয়ে ধরলো পরিবারের সদস্যরা। তারা জোর করে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে কোচকে ঢুকিয়ে দিলো গুহার মধ্যে। নিজের দলের খেলোয়াড়দের তিনি খুব ভালোবাসেন। তাদের খোঁজার জন্য তিনি এগিয়ে গেলেন। একটু যেতেই দেখলেন, কিশোরদের বাইসাইকেল পড়ে আছে ওখানে। রয়েছে জুতাও।
সুতরাং একাপল নিশ্চিত হলেন তার দলের সদস্যরা রয়েছে ভেতরে। এ কারণে তিনি গুহার আরও গভীরে প্রবেশ করলেন। গভীর থেকে গভীরে। চেষ্টা করলেন ১২ কিশোর কোথায় গিয়ে আশ্রয় নিলো তা খুঁজে বের করার। খুঁজে পেলেই তাদের নিয়ে তিনি বের হয়ে আসবেন- এটাই ছিল ইচ্ছা।
গুহায় আটকে পড়া কিশোররা। তাদের চেহারায় ভয়ের কোনো চাপ ছিল না। ছিল দৃঢ়তা
কোচকে নিয়ে থাই মিডিয়ার সন্দেহ এবং তার অবসান
থাই কিশোরদের নিখোঁজ হওয়ার পর একাপলের ভূমিকা নিয়ে থাইল্যান্ডের সংবাদ মাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরুতে ছিল তুমুল সমালোচনা। সবার একটাই বক্তব্য ছিল খুব কমন। একাপলই হয়তো ইচ্ছা করে কোনো উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কিশোরদের লুকিয়ে ফেলেছেন। একাপল আধ্যাত্মিক আরাধনা করতেন, এ গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর এমন ধারণা করা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। যদিও পরে সবার ভুল ভাঙে। কারণ, একাপলের কারণেই দীর্ঘ ৯দিন পরও বেঁচে ছিল প্রতিটি কিশোর।
একাপল : দেশ-পরিচয়হীন এক কোচ
একাপল ছিলেন একজন এতিম। বাবা-মা দু’জনই বার্মিজ। তবে ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়েছেন। তার ঘর-বাড়ি নেই। ছোটবেলায়ই আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। পড়ালেখা এবং বসবাস- দুটোই ছিল একটি মন্দিরে। লাম্পুন মন্দির। যেটার অবস্থান থ্যাম লুয়াং গুহা থেকে কয়েকঘণ্টা দক্ষিণে। তিনি মেডিটেশন এবং প্রার্থনা করতে পছন্দ করতেন। গুহার কাছাকাছি এক ব্যক্তি সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে আলাপে এমনটাই জানাচ্ছিলেন।
ওই ব্যক্তি আরো জানাচ্ছেন, ‘একাপল লাম্পুন মন্দির থেকে মায়ে সাইয়ে (চিয়াং রাইয়ে গুহার কাছাকাছি) চলে আসেন, তার দাদির কাছে থাকার জন্য। ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খুব ভালোবাসতেন তিনি। মায়ে সাইয়ে আসার পর থাই-মায়ানমার সীমান্তে পাহাড়ি এমন কিছু কিশোরকে সংগ্রহ করেন, যারা তার মতোই। খুবই গরিব এবং ফুটবল খেলার মতো সুযোগ-সুবিধা তাদের নেই বললেই চলে। তিন বছর আগেই ফুটবল দলটা গঠন করেন একাপল। দলের নাম দেন মু পা। যার সরাসরি অর্থই হলো, বণ্য শুকর। দলের প্রত্যেক সদস্যই পাহাড়ি কিশোর। ১২ জন সদস্যকে তিনি নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন এবং নিজের সন্তানের মতোই মনে করেন। ফেসবুক কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায়ই তার দল নিয়ে, কিশোরদের নিয়ে অনেক ছবি এবং লেখা পোস্ট করতেন তিনি।’
একাপল ভেতরে গিয়ে কিশোরদের খুঁজে পেলেও তাদের নিয়ে আর বের হতে পারেননি। তাদের পেছন থেকে ধেয়ে আসছিল পানি। জীবন বাঁচাতে সামনে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। তবে, একাপলের বেশ ভালো করেই চেনা ছিল গুহার ভেতর নানা অলি-গলি। যে কারণে, ১২ জন কিশোরকে নিরাপদ করার জন্য অনেক ভেতরে গিয়ে একটি উঁচু জায়গা বেছে নিলেন তিনি। যেখানে পানি উঠতে পারবে না এবং তারা নিরাপদ থাকতে পারবে। হয়তো ভেবেছিল, পানি কমে গেলে তিনি আবার কিশোরদের নিয়ে বের হয়ে আসবেন।
চলছে থাই কিশোরদের উদ্ধার অভিযানের প্রস্তুতি
খবর ছড়িয়ে পড়লো সারা বিশ্বে
কিন্তু একদিন, দুদিন, তিনদিন করে সময় যেতে লাগলো, পানি কমার কোনো লক্ষণ নেই। পুরো গুহা পানি ভর্তি। কিশোরদের কেউ সাঁতারও জানে না। দুর্গম, অন্ধকার, কবরের মতো নীরব-নিস্তব্ধ ভয়ঙ্কর জায়গাটা থেকে তাই আর বের হওয়া সম্ভব হলো না কারো।
এদিকে খবরটা একজন, দু’জন করে মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে পুরো থাইল্যান্ডে। থাই মিডিয়া থেকে খবরটা মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে গেলো সারা বিশ্বে। চিয়াংরাই প্রদেশে ছুটে আসতে লাগলো বিদেশিরাও। সবাই নিশ্চিত, গুহার মধ্যেই প্রবেশ করেছিল ১২ কিশোর এবং কোচসহ ১৩ জন জলজ্যান্ত মানুষ। কিন্তু কোথায় তারা? দুর্গম গুহা, তারওপর পানিভর্তি। উদ্ধারকারী ডুবুরি এবং গুহা ডাইভাররা কিছুদুর গিয়ে খুঁজে-টুজে এসে পাচ্ছে না বলে জানান দিল।
হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে গেলো থ্যাম লুয়াং গুহার পাশে। অনেকেই অনেকভাবে খোঁজার চেষ্টা করলো। কেউ পরামর্শ দিলো। কেউ নানা সাহায্য করার চেষ্টা করলো। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। তবে ব্যতিক্রম ছিলেন কেবল দুই ব্রিটিশ নাগরিক। ৪৭ বছর বয়সী জন ভোলান্টেন এবং ৫৬ বছর বয়সী রিক স্ট্যান্টন। মাত্র এক বছরের গুহা ডাইভিংয়ের অভিজ্ঞতা তাদের।
খোঁজ মিললো ৯ দিন পর
এই অভিজ্ঞতা নিয়েই চলে এলেন থাই কিশোরদের উদ্ধার করতে এবং তারা নাছোড়বান্দা। থাই কিশোরদের উদ্ধার করবেনই। সে প্রত্যয় এবং প্রচণ্ড দুঃসাহস থেকেই ভোলান্টেন এবং স্ট্যান্টন ব্যক্তিগতভাবে খোঁজা শুরু করেন ১২ কিশোর এবং তাদের কোচ একাপলকে। ২৩ জুন নিখোঁজ হয় কিশোর ফুটবলররা। ব্যাপক খোঁজা-খুঁজির পর সেই ২ ব্রিটিশ ডাইভার ৯ দিন পর খুঁজে পেলেন নিখোঁজ ফুটবল দলকে।
দুই ব্রিটিশ ডাইভার। ৪৭ বছর বয়সী জন ভোলান্টেন এবং ৫৬ বছর বয়সী রিক স্ট্যান্টন। মাত্র এক বছরের গুহা ডাইভিংয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে এলেন থাইল্যান্ডে এবং তারাই খুঁজে বের করলেন গুহায় আটকে থাকা কিশোরদের
২ জুলাই সোমবার, রাত ৯.৪০ মিনিটে গভীর অন্ধকারের মধ্যে তারা দু’জন অনুভব করলেন সামনে কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে। সেই অনুভব থেকেই তারা হাতে থাকা টর্চ লাইটের আলো ফেললেন সামনে। দেখলেন ১০ বর্গফিটের মতো একটি জায়গায় গুটিশুটি হয়ে বসে আছে আতঙ্কিত কয়েকটি কিশোর। জীর্ণ-শীর্ণ। তবে খুবই শান্ত এবং চেহারায় দৃঢ়তার চাপ। ধারণা করা হচ্ছিল, একাপল যেহেতু মেডিটেশন জানতেন, এ কারণে তিনি নিজে এই কঠিন সংকটের মধ্যেও নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে কিশোরদেরকে শান্ত এবং দৃঢ় থাকার শিক্ষা দিয়েছিলেন।
জন ভোলান্টেন এবং রিকি স্ট্যান্টন যে মুহূর্তে কিশোরদের খুঁজে পেয়েছিলেন, তার ভিডিও করেন। কিশোরদের ওপর আলো প্রক্ষেপণ এবং তাদের সঙ্গে কথোপকথনের অডিওসহ প্রকাশ করেন পরে। যা ইতোমধ্যে কয়েক কোটিবার দেখা হয়ে গেছে সারা বিশ্বে এবং রীতিমতো ভাইরাল হয়ে গেছে তা।
দুই ব্রিটিশ ডাইভার তাদের জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোমরা কতজন এখানে?’
‘১৩ জন’- ১৪ বছর বয়সী আদুল সামন উত্তর দেয়।
‘ব্রিলিয়ান্ট’
আদুল আবার চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে, ‘আজ কি বার?’ এরপর দুই ব্রিটিশ ডাইভারকে তারা জানায় যে, তারা খুব ক্ষুধার্ত। ব্রিটিশ ডাইভাররা তাদের বললো, ‘তোমরা চিন্তা করো না। আমরা মাত্র দু’জন এসেছি। এবার আরও অনেকে আসবে এখানে।’ গুহামুখ থেকে অন্তত চার কিলোমিটার ভেতরে নিখোঁজ ১২ কিশোর এবং তাদের ফুটবলারের সন্ধান নিয়ে ফিরে আসেন দুই ব্রিটিশ নাগরিক। সবাইকে জানানো হয় খোঁজ পাওয়ার ঘটনা এবং ছড়িয়ে দেয়া হয় ভিডিও। সেই ভিডিও দেখার পরই তোলপাড় শুরু হয় সারা বিশ্বে।
১৪ বছর বয়সী বিস্ময়কর কিশোর আদুল
আদুল সম্পর্কে পরে যা জানা গেছে তাতে অবাক না হয়ে পারা যায় না। এই এতটুকুন বয়সে চারটি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে সে। থাই, ইংরেজি, চাইনিজ এবং বার্মিজ। শুধু তাই নয়, খুবই ভদ্র-নম্র সে।
আদুলের স্কুল ব্যান পা মোয়েদ- এর শিক্ষক পানি তিয়াপ্রম তার সম্পর্কে সংবাদ সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘তার সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে প্রথম যেটা আমার মাথায় এসেছে, সেটা হলো- তার অসম্ভব ভালো আচরণ। অসাধারণ সুন্দর। প্রতিটি শিক্ষককেই সে খুব সম্মান করে ও হাত তুলে অভিবাদন জানায় এবং সব সময় খুব দ্রুত হেঁটে চলে যায়।’
ওয়া প্রদেশ থেকে এসেছে আদুল। মায়ানমারের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ এটা। মাদক ব্যবসায়ীদের স্বর্গ বলে পরিচিত প্রদেশটি। ওই এলাকার অনেক খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী তার মা-বাবা অন্য অনেকের মতোই ছোট বয়সে ভালো শিক্ষা পাওয়ার জন্য তাকে থাইল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলে পাঠিয়ে দেন।
সংকীর্ণ, দুর্গম এবং ভয়ঙ্কর বিদৎসঙ্কুল গুহার মধ্যে উদ্ধারকারী দল
দেশ-পরিচয়হীন ৪ লাখ মানুষের আবদ্ধ জীবন
আদুল ৪ লাখ মানুষের মধ্যে একজন, যারা থাইল্যান্ডে দেশ-পরিচয়হীন হিসেবে নিবন্ধিত। এমন একটি নির্দিষ্ট একটি এলাকায় তারা আবদ্ধ যেটাকে আইনগত ভিত্তি দেয়ার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে জাতিসংঘের হাই কমিশনার। এই ৪ লাখ মানুষের কোনো জন্ম সনদ নেই। আইডি কার্ড কিংবা পাসপোর্ট নেই। আদুলরা আইনগতভাবে বিয়ে করতে পারবে না, কোনো চাকরি করতে পারবে না, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে না, এমনকি ওই রাজ্যের বাইরে কোথাও সফরেও যেতে পারবে না। নিজেদের কোনো স্থাবর সম্পত্তি নেই, এমনকি কোনো ভোটাধিকার পর্যন্ত নেই।
আদুল কিন্তু অন্য অনেক কিশোরের মতোই ফুটবল ভালোবাসে। বিশ্বকাপে কি হচ্ছে, কে কেমন খেললো, সব খোঁজ-খবরই রাখে তারা। শুধু ফুটবলই নয়, আদুল গিটার বাজানো এমনকি গানও গাইতে পারে। স্কুলের পরিচালক বিদেশি মিডিয়ার কাছে তার একই সঙ্গে পড়ালেখা এবং খেলাধুলার অসাধারণ চেষ্টার উচ্চসিত প্রশংসা করেন।
রূদ্ধশ্বাস অভিযান শেষে অবশেষে উদ্ধার
৯ দিন পর ব্রিটিশ দুই ডাইভারের অসম সাহসিকতায় খোঁজ মেলার পর শুরু হয় তাদেরকে উদ্ধারের নানা পরিকল্পনা। প্রথমে ভাবা হয়েছিল, পানি না কমা পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে। তাতে অন্তত চার মাস সময়ও লেগে যেতে পারে বলে জানানো হয়েছিল; কিন্তু পরে দেখা গেলো গুহার ভেতর অক্সিজেন কমে যাচ্ছে। তারওপর তুমুল বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। তেমনটি হলে গুহার যে জায়গায় কিশোররা আটকা, সেটাও ডুবে যেতে পারে এবং বিপন্ন হতে পারে তাদের জীবন।
সুতরাং, থাই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ১৮ দেশের বিশেষজ্ঞ উদ্ধারকারীদের নিয়ে অভিযান শুরু করা হয় ৮ জুলাই, রোববার। অবশেষে ১৭ দিনের রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে মঙ্গলবার (১০ জুলাই) বিকেল নাগাদ ১২ কিশোর ও তাদের কোচসহ সবাইকে সুস্থভাবে উদ্ধার করা হয়। ১৮টি দেশের মোট ৯০ জন (৬০ জনই বিদেশি) উদ্ধারকারী দল অংশ নিয়েছিল রুদ্ধশ্বাস এই অভিযানে।
এরপর উদ্ধার হওয়া এই ১৩ জনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হাসপাতালে। শারীরিক অবস্থা তাদের এতটাই খারাপ যে, এই মুহূর্তে বিশ্বকাপের ফাইনাল দেখার চেয়ে চিকিৎসাই বেশি প্রয়োজন। ফিফাও ঘোষণা দিয়েছে, তারা আপাতত এই ১৩ জনকে ফাইনাল দেখতে নিচ্ছে না।
পানি সেচ করার জন্য সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিয়ে যাচ্ছেন ওয়াটার পাম্প
নিষ্ঠুর নিয়তিই তাদেরকে এভাবে ঠেলে দেয় কঠিন সংগ্রামের পথে
থ্যাম লুয়াং গুহায় আটকে পড়া ১৩ কিশোর এবং তাদের কোচের এই ঘটনা থাইল্যান্ডের গহীনের গভীর এক অন্ধকার জগতকে উন্মোচিত করে দিয়েছে সারা বিশ্বের সামনে। চিয়াং রাই প্রদেশে আটকে থাকা ৪ লাখেরও বেশি দেশ-পরিচয়হীন মানুষের গভীর দুর্দশার কথা জানতে পারলো বাকি বিশ্ব। মিডিয়ার সামনে উজ্জ্বল হয়ে গেলো এই এলাকার দেশহীন মানুষগুলোর করুন অবস্থা। থাইল্যান্ড সরকার এখানকার হাজার হাজার শিশু-কিশোরকে শিক্ষা দিচ্ছে- এটা ঠিক। কিন্তু তাদেরকে নাগরিকত্ব কিংবা ন্যূনতম অধিকার দেয়ার বিষয়টা ধীর গতির। অনেকাংশে না দেয়ার মতোই। এবার এ বিষয়টা উঠে এলো আলোচনায়।
থাইল্যান্ডের একেবারে উত্তরাঞ্চলে কিছু কিছু দরিদ্র এলাকা রয়েছে, যেগুলো মিয়ানমারের ৭০ বছরব্যাপী চলা গৃহযুদ্ধের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এবং এসব এলাকায় শান্তি প্রক্রিয়ার ধীরগতির কারণে এথনিক গোষ্ঠিগুলোর ভিড় ধীরে ধীরে বাড়ছে থাইল্যান্ডের ওপর। যেমনটা ব্যাপক হারে বাড়ছে বাংলাদেশেও।
থাই সরকার চাইলে, সারা দেশ থেকে আদুলদের মতো এমন হাজার হাজার কিশোর প্রতিভাকে খুঁজে বের করে যথাযথ শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের নিজেদের দেশের সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে। কারণ, ফিফা যে ঘোষণা দিয়েছিল, বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে উদ্ধার হলে এই কিশোরদের রাশিয়ায় বিশ্বকাপের ফাইনাল সরাসরি দেখার সুযোগ করে দেবে। কিন্তু যাদের নাগরিকত্ব নেই, আইডি নেই, পাসপোর্ট নেই- তারা কীভাবে ভিন্ন কোনো দেশে গিয়ে বিশ্বকাপের খেলা দেখার সুযোগ পাবে?
সূত্র : পার্থনাউ.কম.এইউ’র অবলম্বনে