ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বরিশালে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় এসে ঘটনাচক্রে পুলিশ কমিশনারের ওপর চড়াও হলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ নেতা শাহে আলম মুরাদ।
একটি যাত্রীবাহী লঞ্চের কেবিনে এই নেতা প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে সিনিয়র সহকারী কমিশনার মর্যাদার এক কর্মকর্তাসহ তিন পুলিশ সদস্যকে পেটালেন।
এ সময় পুলিশ কমিশনার (ভারপ্রাপ্ত) মাহফুজুর রহমানকেও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। শনিবার সন্ধ্যারাতে বরিশাল লঞ্চ টার্মিনালের এই ঘটনায় বরিশাল পুলিশ প্রশাসনে তোলপাড় চলছে। ঘটনার প্রায় ২৪ ঘণ্টা পরে বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশের এসআই নিজাম মাহমুদ ফকির বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় ১ জনের নাম উল্লেখ করে ২০ থেকে ২৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ সুন্দরবন-১১ লঞ্চের ভিআইপি কেবিনের সামনে অন্তত অর্ধশত নেতাকর্মী নিয়ে অবস্থান করছিলেন।
প্রায় একই সময় ঢাকায় যাওয়ার উদ্দেশে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফয়েজ আহম্মেদ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব সাজ্জাদুল হাসান লঞ্চঘাটে যান। সরকারি এই কর্মকর্তাকে প্রটোকল দিতে সেখানে গিয়েছিলেন ডিআইজি মো. শফিকুল ইসলাম ও পুলিশ কমিশনার (ভারপ্রাপ্ত) মাহফুজুর রহমান। কিন্তু ঘটনাচক্রে সচিবকে পেছনে ফেলে পুলিশের এই দুই কর্মকর্তা চলে যান লঞ্চের ভিআইপি কেবিনের লাউঞ্জে।
সেখানে গিয়ে দেখতে পান অর্ধশতাধিক লোকের মধ্যে বসেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা শাহ আলম মুরাদ। এই নেতার সঙ্গে থাকা অপরাপর বেশ কয়েক ব্যক্তি পিস্তল হাতে নিয়ে নানা অঙ্গভঙ্গি করছিলেন। সেই দৃশ্য দেখে কমিশনারের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার জাহিদুল ইসলাম ছুটে গিয়ে অস্ত্র প্রদর্শনের বিষয়টি জানতে চান এবং পিস্তলের বৈধতা যাচাইয়ের জন্য কাগজপত্র দেখতে চান। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতা শাহে আলম মুরাদ ও তার সঙ্গে থাকা লোকজন পুলিশের সঙ্গে বাক-বিতণ্ডায় জড়ান।
এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ কমিশনারের দেহরক্ষী ছুটে গিয়ে তাদের দ্রুত স্থান ত্যাগের অনুরোধ করেন। এই সময়ে তুমুল বাকবিতন্ডার একপর্যায়ে শাহে আলম মুরাদের সঙ্গে থাকা সৈকত ইমরানসহ ২০ থেকে ২৫ জন একত্রিত হয়ে সহকারী জাহিদুল ইসলাম ও দেহরক্ষী হাসিবকে এলোপাতাড়ি পিটুনি দেয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুলিশ কমিশনার চেয়েছিলেন সকলকে বের করে দিয়ে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে নেয়ার। কিন্তু ক্ষুব্ধ শাহে আলম ও তার লোকজন পুলিশ কমিশনারকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। একপর্যায়ে শাহে আলম কমিশনারের মাথায় পিস্তল ধরেন।
এমনকি কমিশনারকে এই সময়ে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন তার সঙ্গে থাকা ইমরান সৈকতসহ বেশ কয়েকজন। এই চিত্র ক্যামেরায় ধারণ করতে গেলে কমিশনারের সঙ্গী ওবায়েদকেও মারধর করা হয়। একপর্যায়ে তার সঙ্গে থাকা ক্যামেরাটি ছিনিয়ে নিয়ে যায় শাহে আলমের লোকজন।
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে পুলিশ কমিশনার দ্রুত ফোন করে ঘটনাস্থলে আরো পুলিশ ডেকে নেন। কিন্তু বরিশাল পুলিশ চাইছিল না সরকারের দুইজন সচিবের উপস্থিতিতে এই ধরনের বিষয় প্রকাশ্যে আসুক।
যে কারণে ঘটনার পর জড়িতদের গ্রেপ্তারের প্রস্তুতি নিতে লঞ্চটি থামিয়ে রাখা হলেও পরবর্তীতে ছেড়ে দেয়া হয়।
তবে একটি সূত্র দাবি করছে এই ঘটনার পর বিষয়টি তাৎক্ষণিক শাহে আলম মুরাদ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতাকে মুঠোফোনে অবহিত করেন। এর পরেই কমিশনারের মোবাইল ফোনে কোন ব্যক্তিবিশেষ ফোন করে কথা বলেন। মূলত মুঠোফোনে আলাপচারিতার পরই বরিশাল পুলিশ গ্রেপ্তারের মতো কোনো ঘটনার দিকে না গিয়ে লঞ্চটি ছেড়ে দেয়।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোটা লঞ্চের যাত্রীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই এই লঞ্চে ঢাকায় যাত্রা নিরাপদ নয় মনে করে টার্মিনালেই নেমে যান। এ ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয় পুলিশ প্রশাসনে। ঘটনার প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানায় সরকারি কাজে বাধা, হত্যার উদ্দেশ্যে পুলিশ সদস্যদের মারপিট ও গুরুতর আহত করার দায়ে এসআই নিজাম মাহমুদ ফকির বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। যার নম্বর ৩৩/১৮। মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় কোতোয়ালি মডেল থানার এসআই মহিউদ্দিন মাহিকে।
ঘটনার বিষয়ে শাহে আলম মুরাদ বলেন, ঘটনায় আমি জড়িত নই। দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সাদা পোশাকের পুলিশের বাক-বিতণ্ডা হয়েছিল। যা পরে মিটমাট হয়ে গেছে।