ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ জাপানের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) যে বাণিজ্য চুক্তি হয়েছে, তাকে বিশ্ব বাণিজ্যে এক সুদুরপ্রসারী এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে বর্ণনা করা হচ্ছে। এই চুক্তির মাধ্যমে কার্যত বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গঠিত হয়েছে, যেখান থেকেই আসে বিশ্ব অর্থনীতির মোট জিডিপির এক তৃতীয়াংশ।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন মুক্ত বাণিজ্য থেকে সরে গিয়ে সংরক্ষণবাদী একলা চলো নীতিতে যাচ্ছেন, তখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাপানের এই চুক্তি একেবারেই তার উল্টো পদক্ষেপ। এই চুক্তি ট্রাম্পের সংরক্ষণবাদী বাণিজ্য নীতিকে খর্ব করতে ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জাপান এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই চুক্তি কিভাবে বদলে দিতে পারে বিশ্ব বাণিজ্যের ধারা? এ থেকে কার কী লাভ হবে? এই বাণিজ্য চুক্তির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক :
এক. বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল
ইউরোপীয় ইউনিয়ন হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় একক বাজার। জিডিপির হিসেবেও এটি বিশ্বের বৃহত্তম। এর সদস্য ২৮টি দেশ। প্রায় ৫০ কোটি মানুষ এই অভিন্ন বাজারের অন্তর্ভুক্ত।
অন্যদিকে জাপান বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। কাজেই জাপান এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে এই বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে যে অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠিত হচ্ছে, সেটি বিশ্বের বৃহত্তম। এর সমতুল্য অর্থনৈতিক জোট আর নেই।
বিশ্ব জিডিপির এক তৃতীয়াংশ আসবে এই অঞ্চল থেকে। আর মোট ৬০ কোটি মানুষ এই বাজারের অন্তর্ভুক্ত।
দুই. সংরক্ষণবাদের বিরুদ্ধে বার্তা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে যে সংরক্ষণবাদী বাণিজ্য নীতি অনুসরণ করছেন, তা বিশ্ব বাণিজ্যে উদ্বেগ ও অস্থিতিশীলতা তৈরি করেছে। তিনি বহু দশকের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাপানের বিরুদ্ধে পর্যন্ত শুল্ক বসিয়েছেন ইস্পাত এবং অ্যালুমিনিয়ামের মতো শিল্পে। তার এই সংরক্ষণবাদী নীতির বিরুদ্ধে ইইউ-জাপানের এই বাণিজ্য চুক্তি একটা শক্ত বার্তা দেবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান জ্যঁ ক্লদ জাঙ্কার বলেছেন, বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত ।
তিন. কার কী লাভ?
এই বাণিজ্য চুক্তি থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কী সুবিধা হবে, আর জাপানই বা কীভাবে লাভবান হবে?
জাপান বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আশা করছে, সেই বাজারে তারা অনেক ব্যবসা করতে পারবে। অন্যদিকে জাপানের অর্থনীতি বহু বছর ধরেই ততটা ভালো করতে পারছে না। তারা আশা করছে, ইউরোপীয় বাজারে ঢুকতে পারলে তাদের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠবে। জাপান থেকে ইউরোপে যায় মূলত গাড়ি। অন্যদিকে ইউরোপ থেকে জাপানে যায় কৃষিজাত পণ্য, বেশিরভাগই দুগ্ধজাত পণ্য।
চুক্তিটি যখন পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে, তখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে জাপানে চিজ বা ওয়াইনের মতো পণ্য রফতানির ওপর শুল্ক বলতে গেলে উঠেই যাবে। এতে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর শুল্ক বাবদ বেঁচে যাবে প্রায় একশ' কোটি ইউরো। জাপানও বিনা শুল্কে ইউরোপীয় বাজারে তাদের গাড়ি এবং যন্ত্রাংশ রফতানি করতে পারবে।
ধারণা করা হচ্ছে, এর ফলে ইইউর অর্থনৈতিক উৎপাদন বাড়বে প্রায় শূন্য দশমিক আট শতাংশ, অন্যদিকে জাপানের শূন্য দশমিক তিন শতাংশ। দু'পক্ষের অর্থনীতিই এর থেকে বিপুলভাবে লাভবান হবে।
চার. কিন্তু ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধ কী থামানো যাবে
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাপান দুটিই বড় অর্থনীতি এবং তাদের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্যে উভয় পক্ষের যত লাভই হোক, সেটা বাদ বাকী দুনিয়ার বাণিজ্যে কতটা কী প্রভাব রাখবে, সেটা নিয়ে অনেকে সন্দিহান। যুক্তরাষ্ট্র যদি বিভিন্ন দেশের রফতানি পণ্যের ওপর শুল্ক বসানো অব্যাহত রাখে, এই লাভ খুব গোনায় আসবে না বলে মনে করেন তারা।
রয়টার্সের বিশ্লেষক সোয়াহ পটনায়েক বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীনা পণ্যের বিরুদ্ধে আরও শুল্ক আরোপের হুমকি দিচ্ছেন। মোটর গাড়ির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক বসানো যায় কি-না তার পরিকল্পনা করছেন। যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে হয়তো ২০২০ সাল নাগাদ বিশ্ব অর্থনীতির যে প্রবৃদ্ধি হবে বলে আশা করেছিল আইএমএফ, প্রকৃত প্রবৃদ্ধি তার চেয়ে দশমিক পাঁচ শতাংশ কম হবে।
তার মতে, এটি হবে বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য এত বিরাট একটা ধাক্কা, জাপান আর ইইউ'র এই সাংঘাতিক তাৎপর্যপূর্ণ বাণিজ্য চুক্তি দিয়েও আসলে সেই ক্ষতি পোষানো যাবে না। বিবিসি বাংলা।