ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ পাকিস্তানের আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন হামিদা শহিদ নামের এক নারী। কারণ তিনি পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী রক্ষণশীল উপজাতীয় এলাকা দির থেকে পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন; এই এলাকার নারীরা নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন না।
দির একসময় ছিল তালেবানের শক্ত ঘাঁটি। সেখানে মেয়েদের অধিকার ছিল খুবই কম, তাদের এমনকি ভোট দিতেও দেয়া হতো না।
গত বছরই দিরের এক কাউন্সিল নির্বাচনের ফলাফল গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিল পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন। কারণ সেখানে কোন নারীই ভোট দেননি। কমিশন তখন বলেছিল, কোন নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হতে হলে ওই এলাকার অন্তত ১০ শতাংশ নারী ভোটারকে ভোট দিতেই হবে।
হামিদা শহিদ তারই সুযোগ নিয়েছেন। তিনি সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের দল তেহরিক-এ-ইনসাফের টিকিটে দির আসনে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন।
আমি ভাবলাম, একজন নারী যদি ভোট দিতে পারে, তাহলে সে ভোট চাইতেও পারে- বলছেন হামিদা শহিদ। এই প্রথম সেখানে একজন নারী নির্বাচনে প্রার্থী হলেন। দির এলাকার পুরুষরা এখনও অভ্যস্ত হচ্ছেন এই নতুন দৃশ্যে – ভোটের জন্য প্রচারাভিযান চালাচ্ছেন একজন নারী।
বিবিসির সুমায়লা জাফরি লিখছেন, হামিদা এখন বাড়ি থেকে বের হলেই তার পুরুষ সমর্থকরা শ্লোগান দেয়, পিটিআই জিন্দাবাদ বলে। পিটিআই-এর পতাকার রঙের একটি স্কার্ফ দিয়েছেন ভক্তরা। সেটা পরে তিনি প্রচারাভিযানে যাচ্ছেন।
পাকিস্তানে নারীদের ভোট দিতে না পারাটা শুধু যে দির-এর মতো প্রত্যন্ত এলাকারই সমস্যা – তা মোটেও নয়। পাকিস্তানের সবখানেই এ সমস্যা আছে, আছে এমনকি পাঞ্জাবেও – যা দেশটির সবচেয়ে উন্নত প্রদেশ।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই নারীদের ভোট দেয়ার অধিকার আছে। কিন্তু সে অধিকার আইনে থাকা আর বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারা – দুটি আলাদা জিনিস।
রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে মাত্র ১৫০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম ধুরনাল। এ গ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস আছে – মেয়েদের ভোট দিতে না দেয়ার।
এখানে ১৯৬২ সাল থেকেই এমনটা ঘটছে। পাকিস্তানের পুরুষরা অনেকেই মনে করে- তাদের সম্মানের সাথে নারীদের রক্ষা করাটা জড়িত। সেই বছর ভোটের দিন এ নিয়ে একটা গোলমাল হয়। পুরুষরা অপমানিত বোধ করে নারীদের ভোট দেয়া নিষিদ্ধ করে। অর্ধ শতাব্দীর বেশি পার হয়ে গেলেও এখনো সেই নিষেধাজ্ঞা রয়ে গেছে।
এখানে সামাজিক চাপ এতই বেশি যে একজন তরুণী মেয়ে; যে ভোট দিতে ইচ্ছুক – সে তার পরিচয়ও প্রকাশ করতে দিতে চায়নি। চোখ ছাড়া তার মুখ পুরোটাই আবৃত।
আমার জীবনে আমি কোন নারীকে ভোট দিতে দেখিনি। পুরুষরা এ গ্রামের নারীদের ভোট কেন্দ্রে পাঠাতে চায় না। এটা একটা ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছে- তরুণীটি বললেন।
এখানে একজন পুরুষেরও ক্ষমতা নেই এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর, কারণ তাকেও এ সমাজে টিকে থাকতে হবে। স্থানীয় কিছু এনজিও মেয়েদের ভোট দিতে দেয়ার জন্য কাজ করছে। কিন্তু মেয়েদের সাথে এ নিয়ে কথা বলাটাও একটা কঠিন কাজ।
স্থানীয় একটি মসজিদের ইমাম কাজি হাফিজ আলি, যিনি গ্রামের একজন প্রভাবশালী। তিনি মেয়েদের ভোট দেয়ার ওপর কোন নিষেধাজ্ঞার কথা অস্বীকার করলেন, যদিও মেয়েদের মুখে শোনা যায় ভিন্ন কথা।
এখানে ইমরান খানের পার্টি থেকে প্রার্থী হয়েছেন আম্মার ইয়াসির। তার একটি নির্বাচনী সভায় গিয়ে দেখা গেল সেটা এক পুরুষের জনসমুদ্র। ইয়াসির বললেন, তিনি মেয়েদের ভোট দেয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা সমর্থন করেন না, কিন্তু এতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা কেউ করেনি। তিনি বলেন, তিনি নিজে এ নিয়ে স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিদের সাথে কথা বলেছেন, তারা ব্যাপারটি বিবেচনা করছেন।
পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনও এ জন্য চেষ্টা করছে। গত বছরই নিয়ম করা হয়েছে যে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার অন্তত ১০ শতাংশ নারী ভোট না দিলে সে নির্বাচন বৈধ বলে গণ্য হবে না।
পাকিস্তানের নির্বাচন হবে ২৫ জুলাই। তার আগে এখন শুরু হয়েছে নারী ভোটারদের তালিকাভুক্ত করার অভিযান। অতিরিক্ত ৩০ লাখ নারী এবার ভোট দিতে পারবেন। কিন্তু তার পরও মনে করা হয়, এখনো ৯০ লক্ষেরও বেশি নারী রয়ে গেছেন তালিকার বাইরে।
নির্বাচন কমিশনের জেন্ডার সংক্রান্ত কর্মকর্তা নিঘাত সিদিক বলছেন, তাদের বার্তা লোকের মধ্যে পৌঁছেছে, অনেক নারীই এগিয়ে আসছেন – তারা ভোট দিতে চান। আমরা নারী-পুরুষ সবাইকে সচেতন করার চেষ্টা করছি। ১০ শতাংশ নারীর ভোট না পড়লে ওই আসনের ফলই ঘোষণা করা হবে না, এবং নতুন করে ভোটগ্রহণ করা হবে। বিবিসি বাংলা।