DMCA.com Protection Status
title="৭

খেতাবে যায় তারকা চেনা

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ একটা সময় ছিল নতুন সিনেমা মুক্তি পেলেই এলাকায় এলাকায় মাইকিং চলতো সেই সিনেমার প্রচারে। সেখানে নানা বিশেষণে পরিচয় করিয়ে দেয়া হতো সিনেমার নির্মাতা ও তারকাদের। শোনা যেত, ‘আসিতেছে আপনার প্রিয় …..প্রেক্ষাগৃহে হার্টথ্রুব নায়ক রিয়াজ আর বাংলার নায়িকা শাবনূর অভিনীত প্রেমের তাজমহল’। সেসব মাইকিং শুনতে শুনতে অনেক তারকাদের পরিচয় তাদের নামের বাইরে স্বীকৃতি পেয়েছিল নানা উপাধিতে।

সিনেমার প্রচারে আরও একটি জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল বাংলাদেশ বেতার। সেখানে বিনোদন বন্ধু বলে খ্যাত মাজহারুল ইসলাম নানা উপমা-উপাধিতে তারকাদের নাম উচ্চারণ করে সিনেমার প্রচার করতেন। সেসব শুনে শুনেও অনেক তারকারা খ্যাতি পেয়েছেন অনেক বিশেষণে।

সেসব বিশেষণ আসতো তারকাদের বিশেষ গুণ, বিশেষ জনপ্রিয়তার হাত ধরে। কারো কারো নামের শেষে উপাধি যোগ হয়েছে তার অভিনীত সিনেমার জন্য। দেখে নেয়া যাক, নামের আড়ালে নানা উপমায় খ্যাত সেসব তারকাদের একটি তালিকা-

এ দেশের বাংলা সিনেমার নবাব বলা হয় প্রয়াত চলচ্চিত্র অভিনেতা আনোয়ার হোসেনকে। তিনি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার চরিত্রে অভিনয় করে এই খ্যাতি পেয়েছিলেন। তাকে এখনো তার ভক্ত-অনুরাগীরা বাংলা সিনেমার মুকুটহীন নবাব বলে সম্মান করেন।

ঢাকাই সিনেমাতে ‘মহানায়ক’ খ্যাতি পেয়েছেন বুলবুল আহমেদ। চলচ্চিত্রাচার্য আলমগির কবির রচিত ও পরিচালিত ‘মহানায়ক’ ছবিটি ১৯৮৪ সালে মুক্তি পায়। সেই ছবিতে নায়ক ছিলেন বুলবুল। তখন থেকেই তাকে মহানায়ক বলে সম্মানিত করা হয়। চলচ্চিত্রের অনেকেই অবশ্য এই নায়ককে ‘দেবদাস’ বলেও সম্বোধন করে থাকেন।

নায়কদের যিনি রাজা তিনিই নায়করাজ। আর এই উপাধি অলংকৃত করেছে বাংলাদেশের সিনেমার অন্যতম অভিনেতা রাজ্জাকের নাম। প্রখ্যাত সাংবাদিক ও চিত্রনাট্যকার আহমদ জামান চৌধুরী এই স্বীকৃতি দিয়েছিলেন নায়ক রাজ্জাককে। তিনি বিভিন্ন লেখাতে রাজ্জাককে নায়করাজ বলে লিখতেন। সেই থেকেই এই উপাধি তার নামের শেষে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, অভিনয় আর ব্যক্তিত্বে রাজ্জাক সত্যিকারেরই নায়করাজ হয়ে উঠেছিলেন ঢাকাই সিনেমাতে।

বুলবুল-রাজ্জাকদের সমসাময়িক আরেক নায়ক ছিলেন ফারুক। ক্যারিয়ারে অসংখ্য ছবিতে তিনি বাজিমাত করেছেন দুর্দান্ত অভিনয়ে। ‘সাহেব’সহ শহুরে ও নাগরিক জীবনের অনেক চলচ্চিত্রে তিনি দেখিয়েছেন অভিনয়ের মুন্সিয়ানা। তবে গ্রামীন ছবিগুলোতে নায়ক ফারুকের সাফল্য ছিল যে কোনো নায়কের জন্য ঈর্ষার। গ্রামের চরিত্রগুলোতে যেন ফারুক একটু বেশিই সাবলীল ছিলেন, যথেষ্ট ছিলেন। তাই তিনি হয়ে উঠেছিলেন সবার প্রিয় ‘মিয়া ভাই’। সম্মানের বিশেষ একটি উপাধি ‘মিয়া’, গ্রামে গঞ্জে বসবাস এই ‘মিয়া’দের।

বাংলা ছবিতে মুগ্ধ এক নাম কবরী সারোয়ার। রাজ্জাক-ফারুকদের সঙ্গে রোমান্টিক কবরী সব প্রজন্মের দর্শকের কাছেই স্বপ্নের নায়িকা। তার প্রেমময় সংলাপ প্রেমিকের বুকে মধুর বেদনা হয়ে বাজে বারবার। তার হাসি আজও নস্টালজিয়ায় নিয়ে যায় তার প্রজন্মকে। স্বভাবতই তাকে ‘মিষ্টি মেয়ে’ বলা হয়। ঢাকাই ছবিতে কবরীর উপাধি ‘মিষ্টি মেয়ে’।

নায়িকা শাবানা শব্দের চেয়ে অভিনেত্রী শাবানাই যেন এ বাংলার দর্শককে বেশ স্বাচ্ছ্যন্দ দেয়, আনন্দ দেয়। বেশ কয়েকটি প্রজন্ম এই দেশে গড়ে ওঠে একজন রুচিশীল, মার্জিত অভিনেত্রী শাবানার অভিনয় দেখে দেখে। তাকে রোমান্টিক বা আবেদনময়ী নায়িকার চেয়ে একজন চমৎকার অভিনেত্রী হিসেবেই বেশি গ্রহণ করেছে বাংলা ছবির দর্শক। অনেক বিশেষণেই শাবনা তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ভূষিত হয়েছেন। তবে ‘বিউটি কুইন’ শাবানা উপমাটিই এই অভিনেত্রীর গুণ প্রচারের সেরা স্বীকৃতি হয়ে আছে।

ঢাকাই সিনেমাতে ফোক চলচ্চিত্রগুলো সবসময়ই সুপার ডুপার হিট ব্যবসা করেছে। তেমনি একটি ছবির নাম ‘রুপবান’। এই ছবিতে অভিনয় করে রুপবতী অভিনেত্রী সুজাতা পেয়েছিলেন রুপবানের খেতাব। রওশন জামিলের উপস্থিতি ছিল কূটচালে পটু নারীদের ভূমিকায়। তেমন কোনো খেতাব বা উপাধি স্বীকৃত না হলেও পর্দায় রওশন জামিলকে দেখলেই দর্শক ‘কুটনা বুড়ি’ বলে ডেকে উঠতেন। একই সুনাম অর্জন করেছিলেন তার পরবর্তী প্রজন্মের অভিনেত্রী রীনা খান।

চলচ্চিত্রের সব্যসাচী মানুষ খান আতাউর রহমান পরিচিতি পেয়েছিলেন খান আতা নামে। সোহেল রানাকে বলা হয় ড্যাশিং হিরো। তিনি ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই অ্যাকশান হিরো হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তার ছোট ভাই রুবেলের বিশেষ গুণ ছিল মার্শাল আর্টে। প্রায় সব ছবিতেই দেখা যেত তার কুংফুর শৈল্পিক উপস্থাপনা। তাই রুবেল পেয়েছিলেন কুংফু স্টার উপাধি।

জনপ্রিয়তার নিরিখে বাংলার নায়ক বলা হয় ইলিয়াস কাঞ্চনকে। তার বেশ কিছু ছবির নায়িকা অঞ্জু ঘোষ বেদের মেয়ে জোছনা বলে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তবে তাকে ড্যান্স কুইনও বলা হয়। নতুন মুখের সন্ধান আয়োজন দিয়ে এসে চলচ্চিত্র মাতানো দিতিকে বলা হয় তিলোত্তমা নায়িকা। সর্বজননীন দর্শকের মন জয় করে নিতে পেরেছিলেন শাবনূরকে বলা হয় বাংলার নায়িকা। মিষ্টি হাসির নায়িকা মৌসুমীর নামের আগে যোগ করা হয় প্রিয়দর্শিনী। বাপ্পারাজকে সিনেমার বিজ্ঞাপনগুলোতে পরিচয় করিয়ে দেয়া হতো স্যাক্রিফাইজিং সুপারস্টার হিসেবে। প্রায় ছবিতেই বাপ্পারাজকে দেখা যেত পরিবারের জন্য, বন্ধুর জন্য প্রেম ও সুখ ত্যাগ করার দারুণ সব চরিত্রে। আর দুই বাংলার নায়ক বলা হয় ফেরদৌসকে। চলচ্চিত্রের জেন্টল ম্যান রিয়াজ।

চলচ্চিত্রে দিলদারের উপস্থিতি মানেই হাসির খোরাক। তার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশ ছোঁয়া। চলচ্চিত্রে তার ভূমিকা ছিল সুপারস্টারের মতোই। রেডিও বিজ্ঞাপনে মাজহারুল ইসলাম কিংবা পত্রিকার কাগজে সিনেমার বিজ্ঞাপনে দিলদারের নামের আগে উচ্চারিত হতো ‘কমেডি ম্যান’ শব্দ যুগল।

শক্তিমান অভিনেতা হুমায়ূন ফরীদিকে বলা হতো ভয়ঙ্কর মানুষ। চলচ্চিত্রে তার ভয়ঙ্কর সব উপস্থিতি সত্যি ভয় ধরিয়ে দিতো দর্শকের মনে। অভিনেতা রাজিবকে বলা হতো শক্তিমান অভিনেতা। নায়ক মান্নার স্বীকৃতি ছিল ম্যানলি হিরো। চলচ্চিত্রের ডেঞ্জার ম্যান বলা হয় অভিনেতা ডিপজলকে। 
চলচ্চিত্রে অ্যাকশান লেডি বলে খ্যাতি পেয়েছেন মুনমুন ও পপি।

বলিউডে বেশ কয়েকজন খানের (শাহরুখ, সালমান, আমির, সাঈফ, ইরফান) ছড়াছড়ি। তাই একেক খানকে একেক নামে আলাদা করা হয়। শাহরুখ খানকে বলা হয় কিং খান। তিনিই খানদের রাজা বলিউডে। ঢাকাই ছবিতে খানদের এত ছড়াছড়ি না থাকলেও খানদের রাজা আছেন। তিনি শাকিব খান। ‘কিং খান’ নামের একটি ছবি করার পর থেকেই তাকে এই নামে ঢাকা হয়ে থাকে। তার সর্বাধিক ছবির নায়িকা অপু বিশ্বাসকে বলা হয় ঢালিউড কুইন।

মঞ্চ নাটকে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ এই অঙ্গনের মানুষরো মঞ্চ সারথি বলেন আতাউর রহমানকে। মঞ্চের যুবরাজ প্রয়াত অভিনেতা খালেদ খান। গানের যুবরাজ বলা হয় আসিফ আকবরকে। মঞ্চকুসুম অভিনেত্রী শিমুল ইউসূফ।

ছোটপর্দার নায়ক আফজাল হোসন। ছোটপর্দার মেগাস্টার বলা হয় অভিনেতা জাহিদ হাসানকে। ছোট পর্দার সুপারস্টার সজল ও অপূর্ব। তবে টিভি নাটকে চরিত্রের খ্যাতিতে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা পাওয়া অভিনেতার নাম আসাদুজ্জামান নূর। তিনি ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে ‘বাকের ভাই’ চরিত্রে অভিনয় করে আজও বাকের ভাই হিসেবে পরিচিত ও সম্মানিত হন।

উপমহাদেশের গায়িকা বলা হয় কিংবদন্তি রুনা লায়লাকে। প্লে-ব্যাক সম্রাট বলা হয় এন্ড্রু কিশোরকে। আর ফোক গানের সম্রাজ্ঞীর মুকুট মাথায় নিয়েছেন মমতাজ। গানের আঙিনায় লালন কন্যা বলা হয় ফরিদা পারভীনকে। গানের পাখি সাবিনা ইয়াসমিন। ব্ল্যাক ডায়মন্ড বলে খ্যাতি পেয়েছেন বেবী নাজনীন। গানের ভুবনে গুরু বলে খ্যাত প্রয়াত পপগুরু আজম খান। নগর বাউলের জেমসও গুরু বলে খ্যাতি লাভ করেছেন তার ভক্তদের মাঝে। এবি বলে পরিচিত এলআরবি ব্যাণ্ডের গায়ক আইয়ূব বাচ্চু।

চলচ্চিত্রের চিরসবুজ নায়ক বলা হয় প্রয়াত নায়ক জাফর ইকবালকে। সিনেমার মেগাস্টার প্রয়াত নায়ক জসীম। বিগ ম্যান বলা হতো প্রয়াত খল অভিনেতা জাম্বুকে। আর অকাল মৃত্যু চলচ্চিত্রের অমর নায়ক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে রোমান্সের রাজা সালমান শাহকে।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!