ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ আপনি যদি মনে করেন নাটক-সিনেমা কেবল বিনোদনের জন্য তাহলে এই লেখা আপনার জন্য ভিন্ন কিছু বলতে চাইছে। বাস্তবতা হলো, ভিজ্যুয়াল’র প্রভাব মানব মস্তিষ্কে সুদূরপ্রসারী এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়। যেটা টেক্সট বা রচিত বই’র ক্ষেত্রে এভাবে হয় না। এই বাস্তবতা মেনে নিলে ভারতের চলচ্চিত্র মাধ্যম বর্তমানে তাদের মিডিয়ায় ইতিহাস বিকৃতির যে প্রকল্প হাতে নিয়েছে এটার বিরুদ্ধে আমাদের নূন্যতম প্রতিবাদ থাকা দরকার।
যারা ক্ষমতায় আছেন। সেই সব রাজনৈতিক এলিটদের সরকারি ভাবে এসব প্রবণতাকে কনডেম করার দরকার ছিলো কিন্তু এখনও দেখি এইসব নিয়ে আমাদের কারো হুঁশ নেই।
যে সিনেমার সূত্র ধরে কথা বলছি সেই ‘রাজি’ চলচ্চিত্র।ইতোপূর্বে ভারতের গুন্ডে, গাজি অ্যাটাক চলচ্চিত্র দু’টিতে তারা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে তাদের নিরঙ্কুশ বিজয় বলে চালিয়ে দিয়েছে। এবার ‘রাজি’তেও একই কাজ করেছে। এই সিনেমায় বিষয়গুলা আরো খোলাখুলি বলেছে যেটা এর আগে আর কোনটাতে এমনভাবে করেনি । এমনকি মুক্তিবাহিনীর হাতে পকিস্তান আর্মির আত্মসমর্পণকে এরা দেখাচ্ছে ভারতের হাতে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ হিসেবে। এখানে নাই কোন মুক্তিযোদ্ধার ক্রেডিট, আমাদের জনগনের আত্মদানের কোন চিত্রও নেই। বরং পুরো ব্যাপারটা তারা উপস্থাপন করেছে এমন ভাবে যে, বাংলাদেশ’ রাষ্ট্রের জন্ম ভারতীয়দের আত্মদান বা অবদান হিসেবেই।
বর্তমান বাংলাদেশ সরকার তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাহক হিসেবে নিজেদের দাবী করে থাকে। কিন্তু কোন নাগরিক যদি খালি প্রকাশ্যে এই দলটির অবদানকে একটু সমালোচনা করে তা হলে তাকে পাকিস্তান পাঠিয়ে দেয়ার জন্য দলীয় লোকজন ঝাঁপিয়ে পড়েন। আইন-আদালত পর্যন্ত তার বারোটা বাজিয়ে ছাড়ে। অথচ ভারত একের পর এক এই অতি আবেগের মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে ছেলে খেলায় মেতে আছে কিন্তু এটা নিয়ে সরকারের কোন মাথা ব্যাথা নেই। আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদতো দূরের কথা। ভারত সরকারের সম্মতি না থাকলে এই রকম অবমাননাকর প্রোপাগান্ডা সিনেমা চলতে পারত না সেই দেশে।
এটা সত্য যে মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় অবদান রয়েছে। সেটা আমরা কেউ অস্বীকার করি না। কিন্তু এটা তো ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ছিল না কোন ভাবেই। আবার এটাও সত্য এটা ভারত একদম মানবতার খাতিরে করেছে এমনও না তার নিজস্ব ফায়দার কথা চিন্তা করে তারা এটা করেছে।
সুতরাং বর্তমানে বারবার তাদের চলচ্চিত্রে যেভাবে ৭১’ কে তাদের সেনাবাহিনীর বিজয় বলে হাইলাইট করা হচ্ছে (এটা আগে তেমন চোখে পড়েনি, লাস্ট কয়েকবছর ধরে বিজেপি আসার পর থেকে এই প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে) এটার তো সরকারি পর্যায়ে প্রতিবাদ করা দরকার।
এটাতো এই দেশের গণমানুষের মুক্তির সংগ্রাম ছিলো, ত্রিশ লাখ প্রাণ আমরা বিসর্জন দিয়েছি। তাহলে এখন এই ইতিহাসে ভারত আমাদের নাই করে দিচ্ছে এবং এই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে অফিসিয়াল কোন প্রতিবাদও আমরা করছিনা। তাহলে আর এতো এতো যুদ্ধের চেতনার গল্প আমাদের শুনিয়ে লাভ কি? ভারতের সাথে আমাদের এইসব বিতর্কিত বিষয়ে এবার একটা বোঝাপড়ায় যাওয়ার সময় হয়েছে। এখন যদি এগুলো বন্ধ করা না যায় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে তাদের পুরো একটি প্রজন্ম এই দেশের মুক্তিসংগ্রামকে ভারতীয় দান বলে জানবে।যা আমাদের জন্য এর চাইতে বেদনা ছাড়া আর কিছুই না।
এখানে আরো একটি ব্যাপার যেটা আমার খারাপ লেগেছে তা হলো এই ছবি পরিচালনা করেছেন মেঘনা গুলজার, তিনি নিজে খুবই মেধাবী মানুষ। উনার প্রতিভার প্রতি কোন অসম্মান আমার নাই। প্রখ্যাত কবি গুলজার এর কন্যা তিনি। তিনি এটার লিরিক লিখেছেন, তার মতো একজন সিনিয়র ব্যক্তি এই প্রোপাগান্ডার অংশ হয়েছে এটা তার ভক্তদের জন্য বিরক্তিকর। তারতো অন্তত আমাদের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা থাকার কথা। আবার তার বাংলাদেশী ভক্তের সংখ্যাও কম না।
বন্ধুরাষ্ট্র হয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এমন বিকৃতি আমাদের হতাশ করে। তাদের এই ইতিহাস ছিনতাইয়ের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হওয়া দরকার।