ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর পবিত্র ঈদুল আজহা আজ (বুধবার)। ঈদুজ্জোহার চাঁদ হাসে ঐ/ এল আবার দুসরা ঈদ!/ কোরবানি দে, কোরবানি দে,/ শোন খোদার ফরমান তাগিদ…’ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই কাব্যসুর আকাশ-বাতাস মন্দ্রিত করে মনপ্রাণ ভরে তুলছে ঈদের আনন্দ রোশনাইয়ে।
বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং যথাযথ ধর্মীয় মর্যদা ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্যদিয়ে সারা দেশে মুসলিম সম্প্রদায় ঈদুল আজহা উদযাপন করবে। ঈদ উপলক্ষে মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে তিন দিনের সরকারি ছুটি। তবে এ সপ্তাহের শেষ দু’দিন শুক্র ও শনিবার হওয়ায় ছুটি দাঁড়িয়েছে ৫ দিনে।
মহান আল্লাহর অপার অনুগ্রহ লাভের আশায় ঈদুল আজহার জামাত শেষে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সামর্থ অনুযায়ী পশু কোরবানি করবেন। ইতোমধ্যে যার যার সাধ্যমত কোরবানির পশু কিনেছেন। রাজধানীতেও বরাবরের মতোই কোরবানির হাট ছিল জমজমাট। ইসলামের পরিভাষায় কোরবানি হলো- নির্দিষ্ট পশুকে একমাত্র আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে নির্দিষ্ট সময়ে তাঁরই নামে জবাই করা। মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে জবাই করা পশুর মাংস বা রক্ত কিছুই পৌঁছায় না, কেবল নিয়ত ছাড়া। ঈদুল আজহার অন্যতম শিক্ষা হচ্ছে, মনের পশু অর্থাৎ কু-প্রবৃত্তিকে পরিত্যাগ করা।
পবিত্র ঈদুল আজহার তাৎপর্য তুলে ধরে বরাবরের মতো এবারও দেশের সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করছে বিশেষ সংখ্যা। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, সবকটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও এফএম রেডিও ঈদ উপলক্ষে কয়েক দিনব্যাপী বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করবে।
পবিত্র এই দিনটিতে উৎসবের আমেজ দিতে রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও সড়ক দ্বীপসমূহে জাতীয় এবং ঈদ মোবারকখচিত পতাকা দিয়ে সুশোভিত করা হয়েছে। পাশাপাশি সকল সরকারি-বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা ও ঈদ মোবারকখচিত পতাকা উত্তোলন করা হবে। এ ছাড়াও নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবনগুলো আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হবে।
প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে বরাবরের মতো এবারও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বড় শহর থেকে অগণিত মানুষ নাড়ির টানে গেছেন গ্রামের বাড়িতে। যাত্রাপথ নির্বিঘ্ন করতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও কয়েকটি মহাসড়কে যানজট ছিল। সময়মত ছাড়তে পারেনি অনেক ট্রেন। তবুও হাসিমুখে বাড়ি ফিরেছেন অনেকে।
এদিকে রাজধানীর সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণস্থ জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে আজ সকাল ৮টায় ঈদের প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হবে। তবে আবহাওয়া প্রতিকূলে থাকলে ঈদের প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হবে সকাল সাড়ে ৮টায় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে।
প্রতি বছরের মতো এবারও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের সর্ববৃহৎ ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে সেখানেও ঈদ জামাতের সবপ্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার্থে বিশেষ ট্রেন ও বাস চলাচল করবে।
ঈদুল আজহা উপলক্ষে আজ কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের সকল কারাগার, সরকারি হাসপাতাল, ভবঘুরে কল্যাণ কেন্দ্র, বৃদ্ধাশ্রম, শিশুসদন, ছোটমনি নিবাস, সামাজিক প্রতিবন্ধী কেন্দ্র সরকারি আশ্রয় কেন্দ্র, সেফ হোমস, দুস্থকল্যাণ কেন্দ্র এবং শিশু ও মাতৃসদনগুলোতে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হবে।
রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে ৪০৯টি স্থানে ঈদ জামাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় জাতীয় ঈদগাহের প্রধান জামাতসহ ঈদুল আজহার ২৩০টি এবং উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ১৭৯টি জামাত অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত হবে।
উল্লেখ্য, ইসলামে কোরবানি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পবিত্র কুরআনে সূরা কাউসারে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে- ‘অতএব আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে সালাত আদায় এবং কোরবানি করুন’। সূরা হজে বলা হয়েছে ‘কোরবানি করা পশু মানুষের জন্য কল্যাণের নির্দেশনা’।
কোরবানির মূল উদ্দেশ্যই তাকওয়া বা খোদাভীতি। এ প্রসঙ্গে কুরআনে বলা হয়েছে- ‘এগুলোর গোশত আমার কাছে পৌঁছায় না। কিন্তু তোমাদের তাকওয়া পৌঁছে যায়।’
প্রায় চার হাজার বছর আগে আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি লাভের জন্য হজরত ইব্রাহিম (আ.) নিজ পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)’কে কোরবানি করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু পরম করুণাময়ের অপার কুদরতে হজরত ইসমাইল (আ.)-এর পরিবর্তে একটি দুম্বা কোরবানি হয়ে যায়। হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর ত্যাগের মহিমার কথা স্মরণ করে বিশ্বব্যাপী মুসলিম সম্প্রদায় জিলহজ মাসের ১০ তারিখে আল্লাহপাকের অনুগ্রহ লাভের আশায় পশু কোরবানি করে থাকে।
আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান মুসলিমের জন্য আল্লাহ কোরবানি ফরজ করে দিয়েছেন। এ জন্য ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কোরবানি করাই এ দিনের উত্তম ইবাদত। সেই ত্যাগ ও আনুগত্যের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সারা দেশের মুসলিম সম্প্রদায় আজ দিনের শুরুতেই ঈদগাহ বা মসজিদে সমবেত হবেন এবং ঈদুল আজহার দু’রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায় করবেন। নামাজের খুতবায় খতিব তুলে ধরবেন কোরবানির তাৎপর্য।
জিলহজ মাসের ১০ তারিখে ঈদুল আজহা উদযাপিত হলেও পরের দুই দিনও পশু কোরবানি করার বিধান রয়েছে। সামর্থবান মুসলমানদের জন্য কোরবানি ফরজ হলেও ঈদের আনন্দ থেকে দরিদ্র-দুঃস্থরাও বঞ্চিত হবেন না। কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির সমুদয় অর্থ এবং কোরবানি দেয়া পশুর মাংসের তিন ভাগের এক ভাগ তাদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হবে।