ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টের স্বর্ণ হেরফেরের ঘটনায় তোলপার সৃষ্টি হয় সারাদেশে। স্বর্ণের হেরফেরের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। কিন্তু দুই মাস পার হলেও তদন্তের কোনো অগ্রগতি জানা যায়নি।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত কমিটি তদন্তের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি করতে পারেনি। দুই মাসে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ছাড়া তদন্তে তাদের কোনো অগ্রগতি হয়নি। এখন নতুন করে প্রতিবেদন জমা দিতে সাত দিনের সময় চেয়েছে তদন্ত কমিটি।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সমন্বয়হীনতায় ভোল্টের স্বর্ণ নিয়ে যে বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, তেমনি তদন্ত দীর্ঘায়িত হলে আবারও বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টের স্বর্ণ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ তদন্তের জন্য চলতি বছরের ২৩ জুলাই ৬ সদস্যের ‘উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন’ কমিটি গঠন করা হয়। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশে এ কমিটি করেন গভর্নর ফজলে কবির। তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এএনএম আবুল কাসেমকে। কমিটিতে আরও রয়েছেন বাংলাদেশে ব্যাংকের কারেন্সি অফিসার আওলাদ হোসেন চৌধুরী ও ডিপার্টমেন্ট অব কারেন্সি ম্যানেজমেন্টের মহাব্যবস্থাপক সুলতান মাসুদ আহমেদ। এ ছাড়া কমিটিতে আরও দুজন মহাব্যবস্থাপক ও একজন উপ-মহাব্যবস্থাপক রয়েছেন।
এই কমিটিকে দুই মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছিল, যার নির্ধারিত সময় ২৪ সেপ্টেম্বর (সোমবার) শেষ হয়েছে। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি কমিটি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ভল্টে জমা রাখা স্বর্ণের মানের পার্থক্য নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। তা দূর করতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তাদের দুই মাস সময় দেয়া হয়েছিল। আজকে (সোমবার) নির্ধারিত সময়ের শেষ দিন ছিল। কিন্তু কমিটির প্রতিবেদন এখনো প্রস্তুত হয়নি। তাই প্রতিবেদন তৈরি করতে কমিটি আরও সাত দিনের সময় চেয়েছে। আশা করছি, এ সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে কমিটি।
চলতি বছরের ১৭ জুলাই 'বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে ভুতুড়ে কাণ্ড' শিরোনামে একটি জাতীয় দৈনিকে খবর প্রকাশের পর নড়েচড়ে বসে সরকার। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের এক তদন্ত রিপোর্টের বরাত দিয়ে প্রকাশিত ওই খবরে বলা হয়, 'বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখা হয়েছিল ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণের চাকতি ও আংটি, তা হয়ে আছে মিশ্র বা সংকর ধাতু। ছিল ২২ ক্যারেট স্বর্ণ, হয়ে গেছে ১৮ ক্যারেট। দৈবচয়ন ভিত্তিতে নির্বাচন করা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত ৯৬৩ কেজি স্বর্ণ পরীক্ষা করে বেশির ভাগের ক্ষেত্রে এ অনিয়ম ধরা পড়ে।'
এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে তখন বলা হয়, 'ভল্টে জমা রাখা স্বর্ণে কোনো ধরনের হেরফের হয়নি। যেভাবে রাখা হয়েছিল, সেভাবেই আছে। স্বর্ণ মাপের ক্ষেত্রে ভুল যন্ত্র ব্যবহার ও মাপের পর এর পরিমাণ লেখার ক্ষেত্রে স্বর্ণকারের ভুলে এই জটিলতার সৃষ্টি হয়। স্বর্ণ অব্যবস্থাপনার খবর প্রকাশের ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।'
তখন এসব যুক্তিতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি সরকার। এরপরই উপর মহলের নির্দেশে গভর্নর ফজলে কবির গত ২৩ জুলাই ছয় সদস্যের উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করেন। যে কমিটি নির্ধারিত সময়ে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে ব্যর্থ হলো।
আর বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা মত দেন যে, 'মোট ছয় স্তরে স্বর্ণ সংরক্ষণ করা হয়। এনবিআর বলেছে, স্বর্ণের মানচ্যুতি ঘটানো হয়েছে। এ অভিযোগ সত্য হলে ভল্ট থেকে কখন স্বর্ণ বের করে বাইরে স্বর্ণকারের দোকানে পাঠানো হলো, স্বর্ণকারের দোকানে খাদ মিশিয়ে কখন আবার ভল্টে ফেরত রাখা হলো, তা দেখতে হবে। এসব দৃশ্য নিশ্চয়ই বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্যামেরায় ধারণ করা আছে। তা পর্যালোচনা করে দ্রুত জাতিকে জানাতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো কারণে বিলম্ব করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনাম আরও ক্ষুণ্ন হবে।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র দাবি করেছে, বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে ৯৬৩ কেজি স্বর্ণ জমা আছে। এর মধ্যে ১০ কেজি ৫৭ গ্রাম স্থায়ী স্বর্ণ, বাকিগুলো অস্থায়ী। সর্বশেষ ২০০৮ সালে নিলামে স্বর্ণ বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর আর নিলাম হয়নি। বর্তমানে এ পরিস্থিতির জন্য নিলাম স্থগিত রয়েছে।