তারেক রহমান ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন। তাকে চাইলেও ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে পারবে না। ব্রিটিশ সরকার যদি বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধ অনুযায়ী ইন্টারপোলের কাছে হস্তান্তর করতে চায়, তাহলে ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ আইনের আর্টিকেল ২, ৩ ও ৬ ধারা পরিবর্তন করতে হবে, যা কখনোই সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের সঙ্গে যেসব দেশের বন্দিবিনিময় চুক্তি, বহিঃসমর্পণ চুক্তি বা অপরাধী বিনিময় চুক্তি রয়েছে শুধু সেসব দেশ থেকেই অপরাধীকে ফেরত পাঠান যায়। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের এ ধরনের কোন চুক্তি নেই। ফলে তারেক রহমানকে ফিরিয়ে আনারও কোন ধরনের সুযোগ নেই। বরং উল্টো ব্রিটিশ সরকারের দায়িত্ব তার জন্য সব ধরনের নিরাপত্তা ও সুবিধা নিশ্চিত করা। কোন ব্যক্তিকে যদি রাজনৈতিক কারণে ব্রিটেন এসাইলাম মঞ্জুর করে আইন অনুযায়ী সেক্ষেত্রে তাকে সব ধরনের নিরাপত্তা দিতে হয়। এমনকি তার পরিবারের সদস্যরাও আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক আইনি কাঠামোতে এসব নিরাপত্তা ও সুবিধাদি পেয়ে থাকেন।
নিজ দেশে থাকাকালীন রাজনৈতিক হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন এমন ব্যক্তি দেশে ফিরে গেলে আবারও সেই হুমকির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়ে থাকেন। দেশের পরিস্থিতি তার নিরাপত্তার অনুকূলে না আসা পর্যন্ত ব্রিটেন তাকে আশ্রয় দিয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধুর খুনি নূর চৌধুরীকে কানাডা থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য অনেক দিন আগে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাকে ফেরত আনা যায়নি।
প্রশ্ন ওঠে, ইন্টারপোলের কাজটা তাহলে কী? ইন্টারপোলের কোন সদস্যরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা আসামি গ্রেফতারের জন্য ইন্টারপোল সদর দফতরের সহায়তা চাইতে পারে যেকোন সদস্যরাষ্ট্র। ইন্টারপোল সহায়তা করতে সম্মত হলে ওই আসামির অপরাধের ধরন ও গুরুত্ব অনুযায়ী তাকে ধরিয়ে দিতে একটি বার্তা বা রেড নোটিশ ছড়িয়ে দেয়া হয় ১৯০টি সদস্য রাষ্ট্রের পুলিশের মধ্যে। ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটেও সেই আসামির নাম, ছবি ও অপরাধের ধরনসহ বার্তা প্রকাশ করা হয়। কোন দেশের পুলিশ ওই আসামির অবস্থান শনাক্ত করলে কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় তাকে ফিরিয়ে আনার দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে ইন্টারপোল কোন আসামিকে গ্রেফতার করতে সরাসরি কোন অভিযান বা গোয়েন্দা নজরদারি করে না।
ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থী সৌদি নাগরিক ড. আল-মাসাবীকে সৌদি আরবে ফেরত পাঠানোর পক্ষে মত দেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জন মেজর। কিন্তু ব্রিটেনের ইমিগ্রেশন ট্রাইব্যুনাল মাসাবীর পক্ষেই রায় দেয়। এছাড়া উইকিলিক্স সম্পাদক সুইডেনের নাগরিক জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জকে ফেরত দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও সুইডেন একাধিকবার অনুরোধ জানালেও ব্রিটেন তাকে ফেরত না দিয়ে বরং নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছে।
১৯৪৮ সালের সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাপত্রের ১৪নং অনুচ্ছেদ মতে বিশ্বের সব মানুষের নিজ দেশের সরকারের নির্যাতন বা নিগ্রহ থেকে বাঁচতে অন্য কোন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশ ও ব্রিটেনসহ বিশ্বের সব দেশই এই আইনে স্বাক্ষরদাতা। তাছাড়া কাস্টমারি ইন্টারন্যাশনাল ল এবং ১৯৫১ সনের শরণার্থী কনভেনশন মতে এরূপ নিগৃহীত ভীত কোন ব্যক্তিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে দেশে ফেরত পাঠান যাবে না। সেই সঙ্গে যদি কোন ব্যক্তির তার দেশের বিচারে মৃত্যুদণ্ড শাস্তির সম্মুখীন হওয়ার আশংকা থাকে, ব্রিটেন সেই আশ্রয়প্রাপ্তকে ফেরত পাঠাতে পারবে না। তাই তারেক রহমানকে ব্রিটেন থেকে ফেরত দেয়াটা অনেকটাই অসম্ভব। আর দেয়া কখনও সম্ভব হলেও সেটা খুবই দীর্ঘ ও জটিল ব্যাপার হবে।
আসলে সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনের কৌশল হিসেবেই ইন্টারপোলের ভয় দেখাচ্ছে সরকার। যদিও এপর্যন্ত বাংলাদেশী ৫৭ নাগরিকের বিরুদ্ধে মোস্ট ওয়ান্টেড হিসেবে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি থাকলেও তাদের কাউকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারেনি সরকার। অথচ আদালত দ্বারা এখনও সাজাপ্রাপ্ত না হওয়া বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন আমাদের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা। সরকারের আসল উদ্দেশ্য ফিরিয়ে আনা নয়। বরং তারেক রহমানের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে আন্তর্জাতিক বিশ্বে তাকে কলংকিত হিসেবে দেখান। সরকার আমাদের পুলিশ বাহিনীকে যেভাবে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, এবার ইন্টারপোলকেও একইভাবে ব্যবহার করে রাজনীতি করার চেষ্টা করছে। যদিও এটা করা কখনোই সম্ভবপর নয়।
আমরা আমাদের নেতাদের সব অপকর্ম ও দুর্নীতির বিচার চাই। রাষ্ট্রের কোষাগার লুট করে আর গরিব মানুষের টাকা ছিনতাই করে রাজনীতির এই ভয়াবহ রাজনৈতিক-অর্থনীতির ধ্বংস চাই। এদেশে সরকারি কমিটি করে রাজনৈতিক বিবেচনায় হাজার হাজার মামলা প্রত্যাহার করা হয়, এমনকি ফাঁসি হলেও রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে মাফ পাওয়া যায়। এরূপ অপসংস্কৃতির অবসান আমাদের কাম্য হলেও এ থেকে সহসা মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। যেসব দুর্নীতির মামলায় তারেক জিয়ার বিচার হচ্ছে, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা, মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধেও একই রকমের হাজার হাজার মামলা ছিল। কিন্তু তারা ক্ষমতায় এসেই নিজেদের বিরুদ্ধে করা সাড়ে সাত হাজারের বেশি এরকম মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বিরোধী দলের কারও মামলা প্রত্যাহার করা তো দূরের কথা উল্টা নতুন নতুন মামলা দিয়ে তাদের জুলুম-নির্যাতন করা হচ্ছে। তাই তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এসব মামলা পরিচালনার কোন নৈতিক অধিকার এই সরকারের থাকা সঙ্গত নয়। বাংলা পুলিশ দিয়ে বিরোধী দলকে নির্যাতন করা সম্ভব হলেও ইন্টারপোলকে দিয়ে সেই কাজ করান কখনই সম্ভব নয়। এটা হয়তো সরকারও জানে।
ডক্টর তুহিন মালিক : সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ