ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট তৃতীয় লিঙ্গকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তারপর থেকে ক্রমশ সমাজের মূল স্রোতে গ্রহণীয় হয়ে উঠছেন তারা। বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠান ঘিরেও ভাঙছে অচলায়তন।
কলকাতাসহ শহরতলিতে এবার রূপান্তরকামীরা হয়ে উঠেছিলেন পূজার মুখ। কিন্তু শহর ছাড়িয়ে সেই ছক ভাঙা ঢেউয়ের রেশ পৌঁছে গেছে জেলায়ও। দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটের অনীক দত্ত ওরফে অ্যানির বিয়েতে এবার পশ্চিমবঙ্গ সাক্ষী থাকলো রূপান্তরকামী বিয়ের।
মডেলিংয়ের সূত্রে আলাপ হওয়া একটি সম্পর্কের পরিণতি ছাদনাতলা। এমনটাই জানা গেল অ্যানির সঙ্গে জলপাইগুড়ির সাগ্নিক চক্রবর্তীর বিয়ের আসরে। তাদের দু'বছর আগের সেই সম্পর্ক পরিণতি পেলে বিয়েতে। বিয়েটা সমাজের চোখে কেমন দাঁড়াবে বা পরিবার কী ভাবতে পারে ইত্যাদির মধ্যে না গিয়ে তিনি সরাসরি মণ্ডপেই ধরলেন রূপান্তরকামী অ্যানির হাত। ৩১ অক্টোবর বউ ভাতের আসরে পেশায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সাগ্নিক চক্রবর্তী পরিষ্কার বললেন, সবকিছু আমি জানতাম। ও যে রূপান্তরকামী এটা জেনেও ওর সঙ্গে প্রেম করি।
তবে নতুন সম্পর্কে প্রবেশের জন্যই কী লিঙ্গ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত অ্যানির? অ্যানি জানালেন, কারো জন্য তিনি পুরুষ থেকে নারী হননি। নববধূর সাজে তিনি বলেন, আমার শরীরটা পুরুষের ছিল, কিন্তু মনটা ছিল নারীর। আত্মাকে কেউ বদলাতে পারে না। শরীরটাকে বদলানো যায়। শরীর ও আত্মাকে মিলিত করার জন্য অনীক থেকে অ্যানি হয়েছি। সাগ্নিকের সঙ্গে সম্পর্কের আগেই আমি লিঙ্গান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের সম্পর্কের জন্য নয়। নিজেকে সম্পূর্ণ করার জন্যই আমার এই সিদ্ধান্ত।
আর পাঁচজন রূপান্তরকামীর মতোই তার জীবনের অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন, অতীতে ভালো-খারাপ দু'রকমের অভিজ্ঞতাই আছে। আমি ছেলেদের স্কুলে পড়েছি। ফলে টিটকিরি শুনতে হয়েছে। কিন্তু শিক্ষকরা ভীষণ সাহায্য করেছেন। অবশ্যই কলেজের সিনিয়র এবং বন্ধুদের কথাও বলতে হয়।
অ্যানি একটি প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা করেন। পাশাপাশি তিনি একজন সুদক্ষ মেক-আপ আর্টিস্ট এবং নৃত্যশিল্পী। তিনি স্বনির্ভর। রূপ পরিবর্তনের পথে নিজের অস্ত্রোপচারের খরচ নিজেই বহন করেছেন। অ্যানি মনে করেন না বিয়েটাই জীবনের সব।
ক্যারিয়ার এবং পায়ের তলার মাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই দুটিতে সাফল্য এলে তবেই স্বপ্নপূরণ ঘটবে। তিনি স্পষ্টই বললেন, কলকাতায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা যে পূজার উদ্ধোধন করছে, তা অনেকটাই লোক দেখানো। যদি কলকাতায় তৃতীয় লিঙ্গের গ্রহণযোগ্যতা এতটাই হতো, তাহলে রাস্তায় বেরোলে টিটকিরি শুনতে হয় কেন? নিজেদের প্রচারের জন্য তৃতীয় লিঙ্গের ব্যবহার হচ্ছে। তবে এটা ঠিক যে, মানুষের মানসিকতায় বদল ঘটছে।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর সমাজ কতটা বদলেছে? অ্যানি বলেন, সু্প্রিম কোর্টের রায়ের পর মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কতটা পাল্টেছে এটা বোঝা মুশকিল। আমার ধারণা, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো আগের ভাবনাতেই আটকে আছে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ফলে আমরা আইনি বৈধতা পেয়েছি। সেটাই বড় কথা। তবে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি না পাল্টালে সমাজ পাল্টাবে না।
অ্যানির সঙ্গে একমত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ট্রান্সজেন্ডার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের সদস্য রঞ্জিতা সিন্হা। তিনি বলেন, অনীকের বিয়েটা একটা বিপ্লব। সুপ্রিম কোর্টের রায় যা-ই থাক, আইন যা-ই বলুক, মানুষের চেতনাই আসল ব্যাপার। এটা শহরাঞ্চল নয়, একটা গ্রামীণ এলাকায় বিয়েটা হচ্ছে। সেখানে সবাই যে বিয়েতে অংশ নিয়েছেন সেটাই সদর্থক। মানে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যাপারে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি যে পাল্টাচ্ছে, সেটা স্পষ্ট। মানুষের মধ্যে এই সম্পর্কগুলো মেনে নেয়ার প্রবণতা বাড়ছে।
সমাজে তৃতীয় লিঙ্গের অবস্থান কোথায়? সেই নিরিখে অ্যানির বিয়ে কতটা তাৎপর্যপূর্ণ? রূপান্তরকামী আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠক রঞ্জিতা বলেন, আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে যেখানে মেয়েদেরই সম্মান নেই, সেখানে রূপান্তরিত মানুষেরা কীভাবে জায়গা পাবে? গ্রামাঞ্চলে এখনো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ঢিল ছুঁড়ে মারা হয়। সেদিক থেকে অ্যানিকে সাধুবাদ দিতে হয়।
খোলামেলা আলাপচারিতার এক পর্যায়ে রঞ্জিতা জানান, আমাদের সকলেরই কাজ সেরে ঘরে ফিরতে ভালো লাগে। সেজন্য সংসারের চাহিদাও স্বাভাবিক। কিন্তু সংসারের ভাগ্য সকলের হয় না। আমার সঙ্গে উত্তরপ্রদেশের একজন পুরুষের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সমাজের চাপে তিনি মেনে নিতে পারেননি। এদিকে আমিও লিঙ্গ পরিবর্তন করিনি, তাই বিয়ের মতো সম্পর্কে প্রবেশ করা হয়নি আমার। সাগ্নিককে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হয়। এই সাহস কতজনের থাকে?
সাগ্নিক বলেন, এই প্রেমের জন্য আমি শেষ অবধি দেখতে চেয়েছি। তাই দেখেওছি। সকলেরই তাই করা উচিত। তবে আমার বিয়েতে কোনো প্রতিবন্ধকতা আসেনি। বিষয়টা আমাকে অবাক করেছে। বাড়িতে কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে বাবা তাতে মত দিয়েছিলেন। মায়ের কিছু প্রশ্ন ছিল, সেটা বুঝিয়ে বলার পর তিনিও মত দেন।
পশ্চিমবঙ্গে এর আগেও রূপান্তরকামী বিয়ে হয়েছে। ২০১৬ সালে রূপান্তরকামী শ্রী ঘটকের বিয়ে ছিল রাজ্যের প্রথম রূপান্তরকামী বিয়ে। শ্রী বলেন, আমি আড়াই বছর আগে বিয়ে করেছি। তখন কাজটা অনেক কঠিন ছিল। এখন অনেক কিছু বদলে গেছে, ব্যাপারটা সহজ হয়ে গেছে। সামাজিক বিয়ে তো ঠিক আছে, আইনত স্বীকৃতিটা দরকার এবার।
বালুরঘাটের মানুষের মধ্যে এই বিয়ে নিয়ে কী প্রতিক্রিয়া? স্থানীয় নিউজ পোর্টাল ‘সংবাদ সারাদিন'-এর সম্পাদক পরিতোষ বর্মণ বলেন, বালুরঘাট এমন বিয়ে আগে কখনো দেখেনি। এমন বিয়ের অভিজ্ঞতা প্রথম হলেও সবাই এটাকে খোলা মনেই মেনে নিয়েছে।
তিনি বলেন, বালুরঘাট কখনোই অ্যানিকে ব্রাত্য হিসেবে দেখেনি। একদম প্রথমদিকে অবশ্য ওকে কিছু সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। তবে অ্যানি এখন খুব পরিচিত মুখ। বিভিন্ন মহলে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ওর যথেষ্ট পরিচিতি আছে। ফলে বিয়ে নিয়ে কারো বিরোধিতা করার প্রশ্ন নেই এখানে। আর পাঁচ-দশটা বিয়ের মতোই খুব সাধারণভাবে এই বিয়ে গ্রহণ করেছে বালুরঘাটের মানুষ। ওর জীবন সেটা ও কীভাবে কাটাবে, সেটা নিয়ে মানুষ ভাবিত নয়। ডিডব্লিউ।