মেজর(অব:) সৈয়দ আবু বকর সিদ্দিকঃ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আজও উইনস্টন চার্চিলকে শ্রেষ্ঠ ব্রিটন হিসেবে জাতি সন্মান করে | কারণ তিনি ব্রিটেনকে মহাযুদ্ধে বিজয়ী করেছিলেন; সমরে -শান্তিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন |
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাণ পুরুষ ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান | ভারতের টাইমস পত্রিকায় তখন প্রকাশিত সংবাদ ছিল-জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের তূর্য নিনাদ !
——"আই মেজর জিয়াউর রহমান ডু হিয়ারবাই ডিক্লেয়ার দি ইন্ডিপেন্ডেন্স অফ বাংলাদেশ" তাঁর এই তূর্য নিনাদ সাড়ে সাত কোটি মানুষকে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্ধিপনা এবং সাহস যুগিয়েছিল |
স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম প্রহর থেকে জিয়া নয় মাস রণাঙ্গণে মৃত্যুর সাথে পান্জা লড়েছেন |
যুদ্ধরত জিয়ার জন্য সবচেয়ে কঠিন এবং সংবেদনশীল বিষয় ছিল -তাঁর স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তাঁর দু শিশু সন্তান তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমান কে কোলে নিয়ে ঢাকা সেনানিবাসে যুদ্ধ বন্দি ছিলেন |এমন কঠিন বাস্তবতায়ও জিয়া যুদ্ধে পিছু হঠেননি ! মরণপণ যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন |
যুদ্ধের পর বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তরের বাকশালী নৈরাজ্যে জাতি যখন দিশা হারা ; তখন আরেক চতুর বাকশালী নেতা খন্দকার মোস্তাক আহমেদ ষড়যন্ত্র করেন | কিছু সেনা অফিসারের সশস্ত্র আক্রমণে আওয়ামী বাকশালী নেতা এবং রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয় | শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা দেশের বাহিরে থাকায় তাঁরা প্রাণে বেঁচে যান |
নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস – পনেরই আগস্ট অবিসংবাদিত নেতা মুজিব হত্যার পর বাকশালীরা সেদিন কোন প্রকার প্রতিবাদ করেনি !! কোন শোক মিছিল হয়নি ! বরং অধিকাংশ নেতাই আঠারোই আগস্ট খন্দকার মোস্তাক আহমেদের গঠন করা পার্লামেন্টে যোগদান করেন |
এদিকে সেনানিবাসের শৃঙ্খলা এবং চেইন অফ কমান্ড ফিরিয়ে আন্তে হবে ; তাই নতুন পার্লামেন্ট একজন পেশাদার সিনিয়র সেনা অফিসারের প্রয়োজনীয়তা বোধ করে | কারণ রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে নিরাপত্তা প্রদানে সেনা প্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ ব্যর্থ হয়েছিলেন |
সেনাবাহিনীতে পরবর্তী সিনিয়র এবং ডেপুটি চিফ হিসেবে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের নাম আগে আসে ; কিন্তু চতুর -ষড়যন্ত্র কারী মোস্তাক জেনারেল জিয়ার ব্যক্তিত্ব , দেশপ্রেম , পেশাদারিত্ব এবং সততাকে ভয় পেতেন | প্রাথমিক ভাবে মোস্তাক জিয়াকে সেনা প্রধান করতে চায়নি ; জিয়ার অবস্থান এবং রাজনৈতিক -সামরিক এবং পেশাদার ব্যক্তিদের সুপারিশে মোস্তাক জিয়াউর রহমানকে চব্বিশ আগস্ট সেনাপ্রধানের দায়িত্ব প্রদান করেন |
সেদিন ক্ষণজন্মা জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দ্বিতীয়বার সেনা প্রধান হবার গৌরব অর্জন করেন ; প্রথমবার হয়েছিলেন ছাব্বিশ মার্চ -একাত্তর ; যেদিন তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা করেন |
বাংলায় একটি প্রবাদ আছে "যুদ্ধে যার জীবন গড়া তাঁর জীবনে শান্তি কিসের ?" ; পঁয়ষট্টির যুদ্ধে তরুণ মেজর জিয়া পাকিস্তানের ক্ষেনকারাম সেক্টরে আল্ফ়া কোম্পানির অধিনায়ক হিসেবে ভারতের একটি ব্যাটালিয়নকে বিধ্বংস করে দিয়েছিলেন ; অর্জন করেছিলেন পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম বীর খেতাব -হেলাল -ই – যুররত |
পাঁচটি বছর যেতে না যেতে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে | তিনি অর্জন করেন আবারো বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বীর খেতাব -বীর উত্তম |
আবারো পাঁচটি বছর যেতে না যেতেই আরেকটি যুদ্ধ-অর্থাৎ তাঁর প্রথম বাংলাদেশের প্রিয় সেনাবাহিনী প্রধান হওয়ার মাত্র দুইমাস আটদিন পর অর্থাৎ ২ নভেম্বর রাতে তিনি গৃহ বন্দি হন |
তৎকালীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সি জি এস (চিফ অফ জেনারেল স্টাফ )ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশারফ , ছিচল্লিশ স্বতন্ত্রপদাতিক ব্রিগেডের সহায়তায় এক ক্যু এর মাধ্যমে সেনাপ্রধানের পদ দখল করে নেয় | স্বঘোষিত সেনা বাহিনী প্রধান হিসেবে খালেদ মোশারফ রাষ্ট্রপতি মোস্তাককে বন্ধিকরে ক্ষমতা চ্যুত করেন | মোস্তাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের আরেক প্রাণ পুরুষ তাজউদ্দীন আহমেদ সহ চার নেতাকে তিন নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয় | বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতির আসনে বসানো হয় |
তিন নভেম্বর থেকে ছয় নভেম্বর বাংলাদেশ পরিণত হয় অন্ধকার দায়িত্বহীন উশৃঙ্খল বাংলাদেশে |
পাশাপাশি এবং অন্যদিকে জাসদের হাসানুল হক ইনু এবং লেঃ কর্নেল (অব:)তাহেরের নেতৃত্বে বিপ্লবী উশৃঙ্খল বাহিনী তৈরী করা হয়েছিল ; তাদের উদ্দেশ্য ছিল জিয়াউর রহমানের ইমেজকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়া |
কর্নেল তাহেরের উশৃঙ্খল কিছু সদস্য এবং তার পরিবারের সদস্যদের ভূমিকা ছিল বিতর্কিত | ওই উশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে তাহের -ইনুদের দর্শনের সৃষ্ট স্লোগান ছিল -"সিপাহী -সিপাহী ভাই ভাই অফিসারের কল্লা চাই |" মূলত: তাদের এই অদ্ভুত দর্শন সেনাবাহিনীর জোয়ানরা কখনোই গ্রহণ করে নাই |
দেশপ্রেমিক বিচক্ষণ জিয়াউর রহমান তাদের এই ষড়যন্ত্র যথা সময়ে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন |
সেদিন ছয় নভেম্বর ঢাকা সেনানিবাসে -ঢাকা পদাতিকের অধীনে দ্বিতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর অফিসার এবং জোয়ানদের নেতৃত্বে ঘটে পাল্টা বিদ্রোহ | ক্ষমতাচ্যুত বন্দি সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের মইনুল রোডের বাড়ির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয় ; এমন এক জটিল ক্রান্তিকালে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে কিছু সশস্ত্র ব্যক্তি স্বঘোষিত সেনা প্রধান মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফকে হত্যা করে | এই ক্যু এবং পাল্টা ক্যুতে কিছু অফিসার এবং জোয়ান নিহত হন |
২ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির অফিসার এবং জোয়ানরা জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে ৭ নভেম্বর মধ্যরাতে / সকালে রেজিমেন্টের অধিনায়কের অফিসে নিয়ে আসেন |
আবার তৃতীয় বারের জন্য জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান হন | তিনি সেনাপ্রধান হিসেবে জাতির উদ্দেশ্যে প্রেস ব্রিফ করেন ; তিনি সেনাবাহিনী সহ সকল আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আন্তে আহ্বান জানান ; একটি সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে তিনবার দায়িত্ব পাওয়া পৃথিবীতে বিরল দৃষ্টান্ত |
এই সংবাদ ঘোষণার সাথে সাথে সিপাহী জনতা ঢাকার রাজপথে নেমে আসে |
বিপ্লব এবং শান্তির আনন্দ মিছিলে -সিপাহী -জনতার অগ্রভাগে চলে আসেন স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রতীক জিয়াউর রহমান | উশৃস্খল পরিস্থিতির চরম পর্যায় থেকে স্বস্তি ফিরে আসে ; এই দিনে সকল সেনানিবাসে শৃঙ্খলা ফিরে আসে | ফিরে আসে সামরিক এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা | শুরু হয় সমরে -শান্তিতে একজন দেশপ্রেমিক বীরের রাজনৈতিক কার্যক্রম |
সেদিন ১০ কোটি বাংলাদেশী স্বাধীনতার সত্যিকারের স্বরূপ দেখতে পায় |
দিনটির তাৎপর্যের উপর ভিত্তি করে ঘোষণা করা হয় জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস |
স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর উত্তম জিয়াউর রহমানের স্ত্রী আজ স্বৈরাচারের হাতে বন্দি ; ভারতীয় আধিপত্য আর দেশদ্রোহী স্বৈরাচারের হাতে আজ গণতন্ত্র বন্দি | বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব আজ হুমকির মুখে |
একটি গণআন্দোলনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের প্রতীক বেগম জিয়াকে মুক্ত করতে হবে ; সুষ্ঠু নিবাচনের মাধ্যমে ফিরিয়ে আন্তে হবে গণতন্ত্র ;
উৎসর্গ : লেখাটি দেশ মাতা বেগম খালেদা জিয়া কে উৎসর্গ করলাম ||
লেখক :
মেজর(অব:) সৈয়দ আবু বকর সিদ্দিক ,পি এস সি | লন্ডন |