ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে বসে ঢাকায় দলটির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যে সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন, তাতে নির্বাচনী আচরণবিধির কোনো লংঘন হচ্ছে না। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কিছুই করার নেই।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এক অভিযোগ পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে ইসি। সোমবার নির্বাচন কমিশনারদের ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। গত রোববার বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তারেক রহমান দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নেয়া শুরু করেন।
বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য আহ্বান জানান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ওই দিন দুপুরে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, কেউ অভিযোগ করলে তারেকের কার্যক্রমের বিষয়ে ইসি ব্যবস্থা নেবে। এর কিছু সময় পর নির্বাচন কমিশনে এ সংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে আসে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল। প্রতিনিধি দলে থাকা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, আদালতের নির্দেশনা অনুসারে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কোনো বক্তব্য টেলিভিশন বা কোনো মাধ্যমে সরাসরি সমপ্রচার বা টেলিকনফারেন্সিং করা যাবে না।
এটি করে তারেক রহমান আদালতের আদেশ ভঙ্গ করার মাধ্যমে নির্বাচনী আচরণবিধিও ভঙ্গ করছেন। কারণ, নির্বাচনী আচরণবিধিতে আছে, দেশে বিদ্যমান সব আইন মেনে চলতে হবে। মহিবুল হাসান চৌধুরী আরও বলেন, বিএনপি যে কাজটি করছে, একজন দণ্ডিত আসামির দ্বারা সাক্ষাৎকার শুধু অবৈধ নয়, অনৈতিকও বটে। গতকাল নির্বাচন কমিশনের বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশনের সভায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, অনলাইনে তারেক রহমান মনোনয়নের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করছেন। যেহেতু তারেক রহমান দেশে নেই, সেক্ষেত্রে উনার জন্য আচরণবিধি প্রযোজ্য বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। তবে এ বিষয়ে হাইকোর্টের একটি নির্দেশনা রয়েছে। এটা সবাইকে মানতে হবে। এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনের এ বিষয়টি নিয়ে কিছু করণীয় নেই।
আওয়ামী লীগের এই অভিযোগের পরিপেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন সাফ জবাব দিলেও হাসিনা সরকারের তা মনঃপুত হয়েছে বলে মনে হয়নি।এই ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশে স্কাইপি এ্যাপটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।এমনকি বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান অফিসের ইন্টারনেট সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে গতকাল রাত থেকে।
নয়াপল্টনের সংঘর্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার নির্দেশ: ১৪ই নভেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে মনোনয়ন ফরম বিক্রির সময় পুলিশে সঙ্গে দলটির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ফৌজদারি অপরাধ। ঘটনাটির তদন্ত চলছে, এতে ইসির কোনো আপত্তি নেই। তাই তদন্ত করে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সচিব বলেন, ওই দিনের ঘটনায় আমরা মহা পুলিশ পরিদর্শককে (আইজিপি) পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে বলেছিলাম। তারা আমাদের অডিও, ভিডিওসহ পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেয়। সেসব নিয়ে নির্বাচন কমিশন বৈঠক বসে বিস্তারিত পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত দিয়েছে- নয়াপল্টনে ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। তাই পুলিশকে অধিকতর সুষ্ঠু তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেয়ার জন্য আমায় বলেছেন।
তিনি বলেন, তদন্তের বিষয়ে কেউ যেন বাধা না দেয়। একইসঙ্গে যারা ঘটনায় জড়িত নয়, তাদের যেন কোনোভাবেই হয়রানি না করা হয়, সে নির্দেশনাও দিয়েছেন নির্বাচন কমিশন। এ ধরনের ঘটনা যেন ভবিষ্যতে আর না ঘটে, সেজন্য প্রতিটি দল ও ভোটারদের সতর্ক থাকার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
পুলিশ ও বিএনপি একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করছে, এক্ষেত্রে কেন পুলিশের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত দিল কমিশন, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, তদন্ত করার মূল দায়িত্ব পুলিশের। যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে তাই তাদের তদন্ত প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে পুলিশের ?ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ ঘটনায় তথ্য, উপাত্ত সংগ্রহ করে আমাদের কাছে উপস্থাপন করেছেন।
বিএনপির নেতাকর্মীদের মামলার তালিকার বিষয়ে ইসি সচিব বলেন, দলীয় নেতাকর্মীদের নামে মামলার যে তালিকা দেয়া হয়েছে, তা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দীর্ঘ তালিকার অনেক মামলাই তফসিল ঘোষণার আগে হয়েছে। এগুলো নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কিছুই করার নেই। তবে যেগুলো তফসিল ঘোষণার পর হয়েছে, সেগুলো নিয়ে নির্বাচন কমিশন আবার বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। মনোনয়নপত্র জমা দেয়া নিয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বিএনপির চিঠির বিষয়ে সচিব বলেন, তারা ব্যাখ্যা চেয়েছে। আমরা পরিষ্কারভাবে তার ব্যাখ্যা জানিয়ে দেবো।
প্রচারসামগ্রী না সরালে ব্যবস্থা: আগাম প্রচার কাজের অংশ হিসেবে পোস্টার ব্যানারসহ অন্যান্য প্রচার সামগ্রী সরিয়ে ফেলার সময় শেষ হয়েছে রোববার মধ্যরাতে। এখন কারো প্রচারসামগ্রী পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। গতকাল এ বিষয়ে জানতে চাইলে হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, সারা বাংলাদেশে ৯০ শতাংশ প্রচারসামগ্রী অপসারণ করা হয়েছে। যেহেতু শেষ দিন গতকাল (রোববার) ছিল, আজ (সোমবার) আমরা আবারও সবাইকে পত্র দিয়ে নির্দেশনা দিয়েছি। সংশ্লিষ্ট প্রার্থীরা যদি নামিয়ে না থাকে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় ব্যবস্থা নেবে। তিনি আরও বলেন, প্রতি উপজেলায় একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করেছি। আর সিটি করপোরেশনের প্রতি ৩ থেকে ৪টি ওয়ার্ডের জন্য একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
৯০ শতাংশ প্রচারসামগ্রী অপসারণের বিষয়টি সিটি করপোরেশনের নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসকরা নিশ্চিত করেছেন বলে জানান সচিব। তিনি বলেন, নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী, ম্যাজিস্ট্রেটরা শাস্তি দেবে। এক্ষেত্রে তারা স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা নেবে। পোস্টারে দলীয় প্রধানের ফটো রাখতে কোনো বাধা নেই উল্লেখ করে হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, রাজনৈতিকগুলোর ইচ্ছার বিষয় এটা। তারা চাইলে দলীয় প্রধানের ফটো নির্বাচনী পোস্টারে ছাপাতে পারেন। আগামী ৩০শে ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ২৮শে নভেম্বর। বাছাই ২রা ডিসেম্বর, প্রার্থিতা প্রত্যাহার ৯ই ডিসেম্বর। প্রতীক বরাদ্দ ১০ ডিসেম্বর, এদিন থেকেই প্রার্থীরা প্রচার কাজ চালাতে পারবেন। তবে ভোটগ্রহণের ৩২ ঘণ্টা আগে অর্থাৎ ২৮শে ডিসেম্বর রাত ১২টার মধ্যে ওই প্রচার কাজ বন্ধ করতে হবে।
‘থ্যাঙ্ক ইউ পিএম’ কর্তৃপক্ষ কে- দেখতে হবে:
সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের জন্য টেলিভিশনে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার নিয়ে নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেছেন, আমরা কোনো অভিযোগ পাইনি। কেউ অভিযোগ দিলে প্রচারকারী কর্তৃপক্ষ কে আমরা দেখবো। নির্বাচন ভবনের নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন ইসি সচিব।
হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘থ্যাঙ্ক ইউ পিএম, এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি। আনুষ্ঠানিকভাবে এখন তো কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ দেয়নি। কেউ অভিযোগ দিলে কর্তৃপক্ষ কে তা আমাদের দেখতে হবে। তিনি বলেন, বিটিভিসহ বেসরকারি টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন আকারে গেলে এতে কোনো সমস্যা নেই। এজন্য সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যম টাকা পাচ্ছে, সেজন্য সমস্যা নেই। বিজ্ঞাপন না হয়ে থাকলে কেউ অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে।
এ নিয়ে রোববার নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘থ্যাংক ইউ পিএম’ এটি আমি টেলিভিশনে দেখেছি। এটি প্রচারের জন্য বেসরকারি টেলিভিশনের নীতিমালা আছে। বেসরকারি টেলিভিশনকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ক্ষমতা বা ইচ্ছা আমাদের নেই। উনারা স্বঃপ্রণোদিত হয়ে এই প্রচার করতে পারেন। সেটা নির্বাচনী প্রচার হলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নিতাম। একটা সরকার আছে, সেই সরকারের কর্মকাণ্ড তারা প্রচার করছে।