ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের ৬০টি আসনে ছাড় দেবে বিএনপি। এর মধ্যে ২০ দলীয় জোটের শরিকদের ৪২টি ও ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের ১৮টি আসন দেয়া হবে। রোববার দুই জোটের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে এ তালিকা চূড়ান্ত করা হয় বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। তবে শেষ পর্যন্ত দুই জোটকেই আরও চার-পাঁচটি আসনে ছাড় দেয়া হতে পারে।
এদিকে গত তিন দিন দফায় দফায় বৈঠক করে দলীয় প্রার্থীর তালিকা চূড়ান্ত করেছে বিএনপি। প্রতি আসনে একজন করে বিকল্প রেখে এ তালিকা করা হয়। আজ চূড়ান্তভাবে মনোনীতদের মধ্যে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিতরণ করা হতে পারে।
২০ দলীয় জোটের শরিকদের ৪২টি আসন দেবে বিএনপি। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীকে ২৪টি, এলডিপিকে চারটি, বিজেপিকে একটি, এনপিপিকে একটি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টিকে একটি, খেলাফত মজলিসকে একটি, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামকে একটি আসন দেয়া হবে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে ১৮টি আসন দেবে বিএনপি।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের স্বাক্ষরে ধানের শীষের মনোনয়ন দেয়া হবে। দলের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত একটি চিঠি প্রতিটি জেলার রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়েছে।
২০ দলীয় জোটের সঙ্গে আসন সমঝোতা করতে রোববার দিনভর বৈঠক করে বিএনপি। দুপুরে এলডিপি, এনপিপিসহ জোটের কয়েকটি শরিকের সঙ্গে বৈঠক করেন দলটির নেতারা। গুলশান কার্যালয়ে ওই বৈঠকে শরিকরা তাদের সম্ভাব্য তালিকা বিএনপির কাছে হস্তান্তর করেন। এরপর বিএনপির নীতনির্ধারকরা নিজেদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। পরে রাতে আবারও শরিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি নেতারা। সেখানে কোন কোন আসনে ছাড় দেয়া হবে তা জানিয়ে দেয়া হয়।
২০ দলীয় জোটের শরিকদের যেসব আসনে ছাড় দেয়া হয়েছে :
এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ (চট্টগ্রাম-১৪), মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ (কুমিল্লা-৭), শাহাদাত হোসেন সেলিম (লক্ষ্মীপুর-১), আবদুল করিম আব্বাসী (নেত্রকোনা-২) রয়েছেন। তবে দলটির পক্ষ থেকে আরও কিছু আসনের জন্য জোর প্রচেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শাহাদাত হোসেন সেলিম। এর মধ্যে এম ইয়াকুব আলী (চট্টগ্রাম-১২) ও অ্যাডভোকেট মঞ্জুর মোর্শেদ (ময়মনসিংহ-১০) অন্যতম।
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ (ভোলা-১), কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহিম (চট্টগ্রাম-৫), জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপার শফিউল আলম প্রধানের মেয়ে ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধান (পঞ্চগড়-২), মশিউর রহমান যাদু মিয়ার মেয়ে পিপলস পার্টি অব বাংলাদেশের রিটা রহমান (নীলফামারী-১), জমিয়তে ওলামায়ের মুফতি মোহাম্মদ ওয়াক্কাস (যশোর-৫), জমিয়তে ওলামায়ের শাহীনুর পাশা চৌধুরী (সুনামগঞ্জ-৩), বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টির সুকৃতি কুমার মণ্ডল (যশোর-৪)। সুকৃতি কুমার মণ্ডল বলেন, তাকে মৌখিকভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে। আজ মনোনয়নের চিঠি পেলে নিশ্চিত করতে পারব। খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক আহমেদ আবদুল কাদের (হবিগঞ্জ-৪), এনপিপির সভাপতি ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ (নড়াইল-২)।
জাপা (জাফর) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ড. টিআই ফজলে রাব্বী (গাইবান্ধা-৩), দলের মহাসচিব মোস্তফা জামাল হায়দার (পিরোজপুর-১)। এই দলের পক্ষ থেকে আরও দু’টি আসনের জন্য জোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে আহসান হাবীব লিঙ্কন (কুষ্টিয়া-২) অন্যতম।
এসব শরিক ছাড়াও সাম্যবাদী দল সাধারণ সম্পাদক কমরেড সাইদ আহমেদ (নারায়ণগঞ্জ-৫), বাংলাদেশ লেবার পার্টি ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান (পিরোজপুর-১) আসনে মনোনয়ন চাইছেন। এ বিষয়ে সাইদ আহমেদ জানান, ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়কারী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান তাকে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে মনোনয়ন জমা দিতে বলেছেন। তবে তাকে এখনও আসনটির বিষয়ে নিশ্চিত করা হয়নি। মোস্তাফিজুর রহমান ইরান জানান, দীর্ঘদিন ধরে পিরোজপুর-১ আসনে কাজ করছেন বলে তিনি এ আসনের মূল দাবিদার। এছাড়া জোটের শরিক বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, ইসলামী ঐক্যজোট (একাংশ), বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টিও কয়েকটি আসনে মনোনয়ন চাইছে। তবে তাদের কোনো আসন দেয়া হয়নি।
নিবন্ধন হারানো জামায়াতে ইসলামীর একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা জানিয়েছেন, স্বতন্ত্র নয় আসন্ন নির্বাচনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করবেন দলটির প্রার্থীরা। এ বিষয়ে ঘোষণা আসবে আজকালের মধ্যে। জামায়াতের নায়েবে আমীর মিয়া গোলাম পরওয়ার জানিয়েছেন, তারা ৫৩টি আসনের তালিকা বিএনপিকে দিয়েছেন। ২৮ নভেম্বর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তারা মনোনয়নপত্র দাখিল করবেন। ধানের শীষে মনোনয়নপত্র দাখিল করা হবে কিনা তা বলতে রাজি হননি তিনি। জামায়াত সূত্র জানিয়েছে, বিএনপির প্রত্যয়ন নিয়েই মনোনয়ন দাখিল করা হবে। জামায়াত ৫৩ আসনের তালিকা দিলেও সেখান থেকে ক’টি পাবে? এ প্রসঙ্গে মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আলোচনায় এ বিষটি চূড়ান্ত হবে। জামায়াত যেসব আসনে নির্বাচন করতে চায় সেখানে নেতাকর্মীরা মাঠে নেমে গেছেন। জামায়াত আশাবাদী সম্মানজনক সংখ্যক আসনে জোটের মনোনয়ন পাওয়া যাবে।
তবে জামায়াতের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, ৫৩টি আসনের তালিকা দেয়া হলেও ৩৫টি আসন পেতে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ৩৮ আসনে নির্বাচন করা জামায়াত ৩৩টিতে জোটের মনোনয়ন পেয়েছিল। পাঁচটি আসনে বিএনপি ও জামায়াত দু’দলেরই প্রার্থী ছিল। গতবারের ৩৩টির ২৭টিতে এবারও জোটের মনোনয়ন চায় জামায়াত। গতবারের উন্মুক্ত পাঁচটি আসনের তিনটিতে জামায়াত দ্বিতীয় হয়েছিল। বিএনপির অবস্থান ছিল তৃতীয়। এগুলোতেও এবার জোটের মনোনয়ন চায় জামায়াত। নতুন করে রাজশাহী-১, বগুড়া-৪, ঢাকা-১৫, সাতক্ষীরা-১ ও চট্টগ্রাম-১৬ আসনে জোটের মনোনয়ন চায়।
জামায়াতের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নিশ্চিত করেছেন, বিএনপি এখন পর্যন্ত ২৫টি আসন ছাড়তে রাজি হয়েছে। জামায়াত আরও কয়েকটি আসনে ছাড় পেতে চেষ্টা করছে। তার দাবি, শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৩০টি আসন পেতে পারে। জামায়াতের চাওয়া ৩৫টির আসনের মধ্যে নীলফামারী-২, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩, রাজশাহী-১, চুয়াডাঙ্গা-২, ঝিনাইদহ-৩, ঢাকা-১৫ ও চট্টগ্রাম-১৬ আসনে বিএনপি ইতিমধ্যে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। ওই নেতা বলেন, প্রার্থী দিলেও অসুবিধা নেই। যেখানে বিএনপি মনোনয়ন পাবে, সেখানে জামায়াত থাকবে না। যেখানে জামায়াত পাবে, সেখানে বিএনপি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেবে। তবে ৯ ডিসেম্বর জোটের প্রার্থী চূড়ান্ত হবে।
জামায়াতকে যেসব আসনে বিএনপি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেগুলো হল- ঠাকুরগাঁও-২ মাওলানা আবদুল হাকিম, দিনাজপুর-১ মাওলানা আবু হানিফ, দিনাজপুর-৬ আনোয়ারুল ইসলাম, নীলফামারী-৩ মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম, লালমনিরহাট-১ আবু হেনা মো. এরশাদ হোসেন সাজু, রংপুর-৫ অধ্যাপক গোলাম রব্বানী, কুড়িগ্রাম-৪ নূর আলম মুকুল, গাইবান্ধা-১ অধ্যাপক মাজেদুর রহমান, গাইবান্ধা-৪ ডা. আবদুর রহীম সরকার, বগুড়া-৪ মাওলানা তায়েব আলী, সিরাজগঞ্জ-৪ রফিকুল ইসলাম খান, পাবনা-১ আবদুল বাসেত, পাবনা-৫ ইকবাল হোসাইন, যশোর-২ আবু সাঈদ মুহাম্মদ শাহাদত হোসাইন, বাগেরহাট-৩ অ্যাডভোকেট আবদুল ওয়াদুদ, বাগেরহাট-৪ আবদুল আলীম; খুলনা-৫ মিয়া গোলাম পরওয়ার; খুলনা-৬ আবুল কালাম আযাদ, সাতক্ষীরা-২ মুহাদ্দিস আবদুল খালেক, সাতক্ষীরা-৩ মুফতি রবিউল বাশার, সাতক্ষীরা-৪ গাজী নজরুল ইসলাম, পিরোজপুর-২ শামীম সাঈদী, সিলেট-৫ মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী, সিলেট-৬ মাওলানা হাবিবুর রহমান, কুমিল্লা-১১ ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, চট্টগ্রাম-১৫ আ ন ম শামসুল ইসলাম, কক্সবাজার-২ হামিদুর রহমান আজাদ।
ঐক্যফ্রন্ট শরিকদের যেসব আসন ছাড়া হয়েছে :
বিএনপির ‘ধানের শীষ’ নিয়েই ভোটে যাচ্ছে ড. কামাল হোসেন নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। আসন ভাগাভাগির বিষয়টি সুরাহা করতে রোববার দুপুর ১২টায় রাজধানীর মতিঝিলে ড. কামাল হোসেনের চেম্বারে বৈঠক করেন ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা। একই ইস্যুতে রাতে আরেক দফা বৈঠক হয় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে। সেখানে চূড়ান্ত আলোচনা হয়।
সূত্র জানায়, যেসব আসনে ঐক্যফ্রন্টেকে ছাড় দিয়েছে বিএনপি সেগুলো হল- ড. কামাল হোসেনের মেয়ে ব্যারিস্টার সারা হোসেন (ঢাকা-১২), মোস্তফা মহসিন মন্টু (ঢাকা-৭), অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী (ঢাকা-৬), ঐক্য প্রক্রিয়ার সুলতান মোহাম্মদ মনসুর (মৌলভীবাজার-২), গণফোরামে যোগদানকারী আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এমএস কিবরিয়ার ছেলে শাহ রেজা কিবরিয়া (হবিগঞ্জ-১)। এছাড়া মফিজুল ইসলাম খান কামাল (মানিকগঞ্জ-৩) ও জানে আলম (চট্টগ্রাম-১০)-এ মনোনয়ন চাইছে গণফোরাম থেকে।
জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব (লক্ষ্মীপুর-৪), তানিয়া রব (ঢাকা-১৮), আবদুল মালেক রতন (কুমিল্লা-৪)। জেএসডি আরও দু-একটি আসনের জন্য দরকষাকষি করছে। তবে বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি বলে জানা গেছে। এসব আসনের মধ্যে রয়েছে- তৌহিদ হোসেন (চুয়াডাঙ্গা-১), মাসুম এম মহসীন (ঢাকা-১৮), শহিদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন (ফেনী-৩), বেলায়েত হোসেনের জন্য (লক্ষ্মীপুর-২)।
কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নাম (টাঙ্গাইল-৪) ও (টাঙ্গাইল-৮) এ দুই আসনের একটির জন্য থাকছে। (ঢাকা-১৩) আসনেও তার নাম রয়েছে। সেক্ষেত্রে (টাঙ্গাইল-৮) আসনের বদলে কাদের সিদ্দিকী রাজি হলে (ঢাকা-১৩) আসন ছাড়বে বিএনপি। এর বাইরে ইকবাল সিদ্দিকী (গাজীপুর-৩) আসনে রয়েছেন। গুলশান কার্যালয়ে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে তাদের বৈঠক হলেও বিষয়টি নিয়ে কোনো সুরাহা হয়নি বলে জানিয়েছেন ইকবাল সিদ্দিকী। তিনি জানান, তারা ৪৩টি আসনের জন্য একটি তালিকা ড. কামাল হোসেনের কাছে দিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির সিনিয়র নেতারা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানানো হয়েছে।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে (বগুড়া-২) আসনের বিষয়ে নিশ্চয়তা দেয়ার পর তিনি আরও দু-তিনটি আসনের বিষয়ে জোরালো অবস্থান নেন। এর মধ্যে দলের এসএম আকরাম হোসেন (নারায়ণগঞ্জ-২) আসনটি অন্যতম।