ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তথাকথিত 'লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ গঠনে প্রচন্ড চাপের মুখে পড়ে গেছে নির্বাচন কমিশন।
যেনতেন প্রকারে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষ্যে ইসি প্রস্তুতি নিলেও দেশি-বিদেশি চাপে অংশগ্রহণকারী সব প্রার্থীর জন্য ‘সমতল মাঠ’ প্রস্তুতে প্রবল চাপের মুখে পড়ে গেছে। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহকারী প্রিজাইডিং-পোলিং অফিসারদের তালিকা প্রণয়ন, বেপরোয়া আচরণ এবং পর্যবেক্ষকদের ‘মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা’র নির্দেশনা দেয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে আন্তর্জাতিক মহল।
জাতিসংঘ,বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেমন ‘সমতল মাঠ’ তৈরি চাপ দিচ্ছেন; তেমনি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীনও চায় নির্বাচনে জনগণের ভোটের প্রতিফলন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্টের দাবি। ইতিমধ্যেই ঐক্যফ্রন্ট থেকে শতাধিক ডিসি-এসপি ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অপসারণ চেয়ে ইসিতে চিঠি দেয়া হয়েছে।
ওই চিঠিতে যাদের নাম দেয়া হয়েছে সেই ডিসি-এসপি এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক পরিচিতি, প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের নামে ক্ষমতাসীন আ.লীগের পক্ষে কাজ করার সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণসহ অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। ইসিতে জমা দেয়া বিএনপির অভিযোগপত্রে কর্মকর্তাদে নাম দেখে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকায় কর্মরত বিদেশি ক‚টনীতিকদের চোখ ছানাবড়া। তাদের বক্তব্য; সিইসিকে কথায় নয়, কাজে নিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে হবে।
তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশন প্রায় প্রতিদিন নিরপেক্ষ নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে আলোচনার আয়োজন করছে। প্রতিদিন দফায় দফায় বৈঠকের পর কঠোর বার্তা, বিবৃতি দিচ্ছে। ঐক্যফ্রন্টসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অনিয়ম, পুলিশের ক্ষমতাসীনদের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিযোগসহ নানা ধরনের অভিযোগ জমা পড়ছে। কিন্তু সিইসি ও অন্যান্য কমিশনাররা নিজেদের মতো করে কথার ফুলঝুড়ি ছিটাচ্ছেন।
বাস্তবে তাদের কথায় মাঠে কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। পুলিশ বাহিনীর কয়েকজন সদস্যদের বিরুদ্ধে বিতর্কিত ভুমিকার অভিযোগ উঠার পরও কারো বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
উপরন্ত সিইসির কড়া নির্দেশনার বদলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হালকা বার্তা দিচ্ছেন। এটা যেন কবি কুসুমকুমারী দাশের কবিতার মতো ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’। ইসিতে চলছে কথার ফুলঝুড়ি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড গঠনে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গতকালও নির্বাচন কমিশনে দুইজন সচিব, কয়েকজন বিভাগীয় কমিশনারসহ ২২ জন জেলা প্রশাসক (জেলা রিটানিং অফিসার) ও পুলিশের ৭০ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিতর্কিত কর্মকাÐ ও দলবাজির চিত্র তুলে ধরে তাদের তালিকাসহ ১৩ দফা দাবিনামা দিয়েছে। এসব দাবিতে সুনির্দিষ্টভাবে তাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের সম্পর্কে জানতে ইসিকে বাড়তি পরিশ্রম করতে হবে না। চিঠিতে তাদের সম্পর্কে যেসব তথ্য দেয়া হয়েছে সেগুলোর সত্যতা যাচাই করে ইসি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
ঐক্যফ্রন্ট থেকে ইসিতে যে ১৩ দফা লিখিত দাবি জানানো হয়, তার সারসংক্ষেপ হলো, মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ ও জমাদানের জন্য বিএনপি অফিসের সামনে বিশাল গণজমায়েতে পুলিশি হামলা ও এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনের নির্বিকার ভুমিকা, এক থানা অথবা নির্বাচনী এলাকায় কর্মরত কর্মকর্তাদের অন্য থানা বা নির্বাচনী এলাকায় ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা হিসেবে পদায়ন, বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে তথাকথিত জরিপ প্রতিবেদন সমতল নির্বাচনী মাঠ তৈরিতে প্রতিবন্ধকতা, বঙ্গভবনে সংসদ সদস্য পদ প্রার্থী প্রেসিডেন্ট পুত্রের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সভা এবং আপ্যায়ন।
চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দিন আহমদের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব ও জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবের সঙ্গে চট্টগ্রামে বিভাগের সকল রিটার্নিং অফিসার (জেলা প্রশাসক) ও পুলিশ সুপারদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক, এনটিএমসি ও বিটিআরসির বিতর্কিত কর্তকর্তাদের সরিয়ে নিরপেক্ষ কর্মকর্তা পদায়ন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের জন্য সকল দল ও প্রার্থীর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির জন্য জনপ্রশাসনের দলবাজ ও রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারি কর্মকর্তাদের অবিলম্বে প্রত্যাহার।
আসন্ন নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন সমতল নির্বাচনী মাঠ তৈরির স্বার্থে থানা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ না দেয়া, পুলিশ বিভাগের রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারি কর্মকর্তাদের অবিলম্বে প্রত্যাহার, তফসিল ঘোষণার পরও নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থী বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিষয়ে ডকুমেন্টারি মুভি ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় বিবিধ বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ।
সিটি করপোরেশন ও সরকারি মালিকানাধীন ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে বোর্ড এবং ডিজিটাল বিল বোর্ডে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও এমপিদের ছবি সংবলিত কথিত উন্নয়ন প্রচারণা বন্ধ এবং গণহারে আ.লীগপন্থী কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের নির্বাচন কর্মকর্তা নিয়োগ না দেয়ার দাবি জানানো হয়। একই সঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাক্ষরিত বিস্তারিত বিবরণে ১৩ দফার সার্বিক বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
সিইসি বরাবর মির্জা ফখরুল ইসলাম এক চিঠিতে লিখেছেন, সম্প্রতি সারাদেশের প্রত্যেকটি নির্বাচনী এলাকায় ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগের তালিকাভুক্ত প্রতিটি ব্যক্তির বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুলিশ তাদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে আ.লীগের অনুগত কিনা তা যাচাই-বাছাই করছে। যা ইতোপূর্বে বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে নজিরবিহীন। এ ধরনের কাজ নির্বাচনী মাঠ তৈরির স্বার্থে ব্যত্যয় বিধায় থানা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ না দেয়া থেকে বিরত রাখার জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে জোর দাবি জানাচ্ছি।
আরেক দফায় বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তাদের তালিকা দিয়ে তাদের সকল প্রকার দায়িত্ব থেকে বিরত থাকার দাবি জানানো হয়। তালিকা জমা দিয়ে নির্বাচন ভবন থেকে বেরিয়ে সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল সাংবাদিকদের বলেন, এখনো নৌকার পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তারা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য সব আয়োজন যেন করে রেখেছে সরকার ও প্রশাসন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বৈঠকের পর সিইসি – পুলিশকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের তথ্য সংগ্রহ করতে নিষেধ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা।
তিনি জানান, একাদশ জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগামী ১৫ ডিসেম্বরের পর থেকে পুলিশের সঙ্গে মাঠে থাকবে সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা।
গতকাল আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে আইনশৃঙ্খলা-বিষয়ক বিশেষ সভায় সিইসি এসব কথা বলেন। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ১২ দফা নির্দেশনা দেন সিইসি। তিনি বলেছেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের তথ্য সংগ্রহ করার কথা আমরা বলিনি। এটা আপনারা করবেন না। কারণ, এটা নিয়ে নানা শ্রশ্ন উঠেছে। যারা ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা, তারা বিব্রত হন। আমরা এটা চাই না।